পুরনো শার্ট-প্যান্ট পরা কৃশকায় বৃদ্ধ মানুষটা আর দশজনের মতন নয়। একেবারে আলাদা প্রকৃতির। মনে হয় কাম-কাজ নাই ভবঘুরের সাক্ষাৎ বন্ধু। আসলে দুনিয়ায় মানুষের কত রঙের কাজ থাকে, নেশা থাকে পেশা থাকে। মানুষ সারাদিন ঘুরেফিরে এর কাছে ওর কাছে যায়, কায়িকশ্রমের বিনিময় নেয়, দেনা-পাওনা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিচিত্র কাজ কারবার করেই দিন কাটায়। মানুষের রুটিরুজি বলে কথা। আয় রোজগার না থাকলে খাবে কী? আসলে এই খাবারটাই পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ জিনিস। সবাই যেন এটার তাড়নাই উদয়াস্ত অস্থির থাকে। কোথাও এক রতি শান্তি নাই। তাই সংসারের প্রত্যেক সক্ষম মানুষের কিছু একটা কাজ থাকে এবং থাকতে হয়। কথায় বলে, ‘বসে খাইলে রাজার ভান্ডারও খালি হইয়া যায়’। কাজেই কাজ করার কোনো বিকল্প নাই।
এভাবে চিন্তা করলে আদমপুর বাজারের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রবীণ ও পুরনো মাস্টার মুখলেস মিয়ারও একটা কাজ আছে। সেও সারাদিন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে পত্রিকা পড়ে, চা খায়, গল্প করে, পত্রিকার কাগজ হাতের মুঠোয় নিয়ে বাজারময় হাঁটে আর সব শ্রেণির মানুষের গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখে। তবে তার নজরদারিটা বিপরীত দিক থেকে আসা পথচারীর পক্ষে বুঝা সহজ নয়। মুখলেস স্যারের চশমার পাওয়ার অনেক বেশি থাকায় ঈগল পাখির চোখের মতন মানুষের ওপর তার দৃষ্টিনিবদ্ধ হয় খুব দ্রুত এবং এক পলকে। এটা সাধারণ মানুষ ধরতে পারে না। সবাই জানে স্যার একজন সাদা মনের মানুষ। বই পড়ে আর বই গিলে খায়। নিজের সংসারের খবর ছাড়া দুনিয়ার খবরাখবর নিয়া বেড়ায়। বইপত্র ও পত্রিকার লেখার খোঁজ-খবর ব্যতীত তার আর কোনো চাহিদা নাই।
২) আদমপুর বাজারটা ব্রিটিশ আমল থেকেই বিশাল একখানা সাপ্তাহিক হাট। গরুছাগল মহিষ থেকে জংলার গাবফল পর্যন্ত এ বাজারে ওঠে। এখানে পাওয়া যায় না- এমন জিনিস বঙ্গ মুল্লুকে নাই। এই বাজার নিয়ে গ্রামের মানুষের মধ্যে একটা জনশ্রুতি আছে, কারও মুখের বেশি রুচি থাকলে বা খাওয়া পছন্দ করা মানুষকে বলে ‘তোর মুখটা যেন আদমপুরের বাজার’। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা এক সময়ে বিরাট বিরাট গুদামঘরে ভর্তি ছিল বাজারটা। পাটের সেই সোনালি দিনের আড়তদারি, বড়ো বড়ো কামান, কাঠের পাল্লা, শতশত বস্তাটানা মজুর, কুলির ডাকাডাকি, নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা ঘরের সমান পাটের নৌকা ইত্যাদি এখন আর নাই বললেই চলে। তবুও ঘর আছে সেই জৌলুস নাই, মালিক আছে সেই ধূতিপরা ফর্সা ভুঁড়িওয়ালা মহাজন নাই। লোকে বলে, নদী মরে গেলেও নদীর রেখাটা নাকি থাকে।
মুখলেস মাস্টার গত ষাট বছর যাবৎ এই বাজারের অলিগলি ধরে হাঁটে। একেবারে বিনা কাজে হাঁটে। রবি ঠাকুর বলেছেন, “বিনা কাজের সেবা মাঝে পাইনি আমি ছুটি”। এটাই তার আনন্দ। তাকে চেনে না এমন ব্যবসায়ী একজনও পাওয়া যাবে না। বাজারে ঢুকে দোকানের সামনের গলি দিয়ে হাঁটে আর চিন্তা করে কোথায় বসবে। তবে নিজে থেকে কারও দোকানে ঢুকবে না মাস্টার, কেউ মাস্টারসাব বলে ডাকলেই ভিতরে যান তিনি। আবার কেউ চা খাওয়ার জন্য না বললে তিনি নিজে তার ইচ্ছার কথা বলেন না। এটাই তাঁর নৈতিকতা। তার আদর্শ। প্রতিদিন তিনি কত কাপ চা খান সে হিসাবনিকাশ শুধু তার কাছেই, অন্য কেউ বলতে পারবে না। আড়তে বসে চা খাওয়ার সময় মনে মনে তার চোখ নিবিষ্ট থাকে টাকা-পয়সা লেনদেনের দিকে নয় বরং সেখানে পুরনো বইপত্র কোনায় কানায় ধুলাবালির তলে পড়ে আছে কি না সেদিকে। বিলের জলে ভাসমান বাঁশের কঞ্চিতে বসা মাছরাঙা পাখিটা যেমন ছোট্ট একটা পুঁটিমাছ শিকারের জন্য এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে তার অবস্থাও তদ্রুপ। তবে সব দোকানে বই শিকার হয় না। এই যেমন সেদিন হরি বাবুর ক্যাশে বসে লালচে রংচার কাপে ঠোঁট লাগাতেই মাস্টার দেখল অতি পুরাতন একপাশে মলাটবিহীন একখানা বইয়ের মতো নিচে পড়ে আছে। মুহূর্ত বিলম্ব না করে ডান হাতের দুই আঙুলে কাপটা হরিকর্তার কাপের উল্টো দিকে রেখে দিল মাস্টার। হালকা পাতলা মানুষ মুখলেস মাস্টার, ওজন হবে চল্লিশ কেজির কম। শরীরে মেদ মাংসের চিহ্ন নেই। যা আছে তা-ও ঝরে পড়ছে নিত্য হাঁটার কসরতে। এখন জামা-কাপড় পরলে মনে হয় হ্যাঙারে ঝুলে থাকা শার্টটা বাতাসে উড়ছে। এর ভিতরের হাড্ডিসর্বস্ব দেহ নিয়ে তিনি অন্তহীন হাঁটছেন। এবার মাস্টার হরি বাবুর সামান্য অনুমতি নিয়ে বেশ ঋজু ভঙ্গিতে ঘাড় কাত করে ক্যাশবাক্সের নিচ থেকে বইটা টেনে এনে সযতেœ পরিষ্কার করতে করতে বাবুকে বললেন, দেখুন বইটা কেমন ময়লা জায়গায় পড়ে আছে। আমি এটা নিয়ে বাঁধাই করে রাখতে চাই। ইতোমধ্যে দুজন খরিদদার এসে বাবুর ওপর খানিকটা তাড়া দেওয়া শুরু করলে মাস্টারকে হ্যাঁ বা না কিছু বলার পূর্বেই বই হাতে তিনি উধাও হয়ে পড়লেন।
হরি বাবুও মনে মনে বরঞ্চ খুশি হয়েছে। ভাবছে, কাজের সময় মাস্টারটা এসে ঝামেলা করলো, বই নিয়া সে চলে গেলেই ভালো।
৩) মাস্টার বইটা নিয়ে সোজা বাজারের বাইরে তার মহল্লার নিজের ডেরায় ফিরে আসেন। চিকন ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে পথেই কয়েক পৃষ্ঠা গিলে নিল মাস্টার। বাড়িতে যাওয়া অবধি তার সহ্য হচ্ছিল না। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে, কী আচানক ব্যাপার! এমন একটা বিরল বই এভাবে অবহেলায় কেউ ফেলে রাখে। এই বেটারা শুধু ব্যবসাই বুঝলো, বিদ্যার দাম দিল না। কথায় বলে, জহুরি চিনে জহরের মূল্য। ঘরে এসে মাস্টার দেখলো এতকাল ধরে নানাভাবে তার সংগ্রহে যত বই আসছে, আজকের এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গায়ের জামাটা না খুলেই ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লো মাস্টার। তার ঘরে চেয়ার বলতে এই একটাই। যদিও পড়ার নিমিত্ত ছোট্ট একটা কাঠের চারপায়া টেবিলও আছে তার। আসবাবপত্র বলতে একটা আলনার পরে হরেকরকম বইয়ের এলোপাতাড়ি স্তূপ। মধ্যে একটা মাঝারি সাইজের খাট যেখানে তার রাত কাটে অর্থাৎ বালিশের ওপর মাথা রাখার স্থান। মাস্টারের একমাত্র কন্যা মরিয়মের বিয়ে হয়ে যায় ১০ বছর আগে। স্বামীর সঙ্গে সে শহরে থাকে। সহধর্মিণী চলে যায় তা-ও ৬/৭ বছর হবে। এখন ভাইদের সঙ্গেই বাস করেন। তারা যা দেয় তা-ই খায়। মাস্টার খুব মোলায়েম হাতে বইটা তুলে ধরলো তার ত্রিকালদর্শী চোখের আলোয়। প্রথম পৃষ্ঠার পরে নিবিড় অভিনিবেশে চোখ মেলে দেখলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি প্রেস থেকে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এটা মুটামুটি নিশ্চিত যে, কলকাতায় তখনো বইমেলা নামে কিছু শুরু হয়নি। মহাভারতের মূল চরিত্রের ভূমিকা বিষয়ক দেড় শ পৃষ্ঠার এক আকরগ্রন্থ এটা। মাস্টারের আজন্ম নেশার সঙ্গে এ বই বেশ মানানসই বটে। কাজেই তুলনামূলকভাবে তার কাছে এ বইয়ের যত্ন-আত্তি বেড়ে যায়। যেই কথা সেই কাজ, পরদিন দুপুরে বাঁধাই করার জন্য বই হাতে রওয়ানা দেয় মুখলেস মাস্টার। একটা সময়ে আদমপুর বাজারে অনেকগুলো বইপুস্তক ও ছাত্র-ছাত্রীদের খাতার মলাট বাঁধার ঘর ছিল। এখন এতগুলো নেই বললেই চলে, তবুও নদীর একেবারে দক্ষিণ ঘাটের দিকে ধীরপায়ে যেতে থাকেন মাস্টার। সেখানেই দোকান থাকার কথা। পাকিস্তান আমলেও তিনি সেই এলাকায় এ ধরনের দোকান দেখেছেন। তাছাড়া এই বাজারের মানচিত্রটা মাস্টারের মুখস্থ। সে মাঝে মাঝে গর্বের সঙ্গে নতুনদের বলে, শোনো আমাকে দুটি চোখ বেঁধে তোমরা আদমপুর বাজারের মধ্যে ছেড়ে দাও দেখবা আমি ঠিকই চিনে যেতে পারবো। বইটি দোকানে রেখে বাঁধাইওলাকে কঠিন সতর্ক করে নির্দেশনা দিয়ে বাজারে প্রবেশ করেন মুখলেস স্যার। আজ তার মনটা বেশ ফুরফুরে বলা যায় খোশমেজাজে হাঁটছেন। বাজারে কারও ঘরে বসার নিয়ত নাই তার। কিন্তু কী আশ্চর্য! যে সাহারা তাকে কোনো দিনও দাম দেয় না আজ এদের ঘরের সামনে দিয়ে পার হতে না হতেই স্বয়ং বড়ো বাবু রাধানাথ সাহা তার নাম ধরে জনসমক্ষে ডেকে উঠলেন, আরে মাস্টার কেমন আছো?
আসো আসো।
আরে বস,
চা খাও ইত্যাদি।
রাধা বাবু শিক্ষিত মানুষ কলকাতার লেখাপড়া। এন্ট্রান্স পাস করা ব্যবসায়ী এ বাজারে দ্বিতীয় নেই। এটা বাজারময় সবার জানা। আজকে বাবুর মনও খুব প্রসন্ন। বহুদিনের পুরনো বড় অঙ্কের একটা বকেয়া বিল পেয়েছে তারা। নরসিংদী জুটমিলস কর্তৃপক্ষ এ বিলটা কয়েক বছর যাবৎ আটকে রেখেছিল। এর মধ্যেই মাস্টারকে দুধ চার সাথে দুইটা সিঙ্গাড়া দেওয়ার আদেশ হয়ে গেছে। এই ফাঁকে বাবু নিজেই ধর্মকর্মের বিষয়ে আলোচনা শুরু করে দিলেন। মাস্টারের সঙ্গে আরও একজন বাবুর চেলা সেখানে উপস্থিত আছেন।
বাবু বললেন,
ভগবান কী না পারেন বল মাস্টার? সেই কবে থেকে লাখ টাকার আশা আমি ছেড়ে দিয়ে বসে আছি। আর আজকে কথা নাই বার্তা নাই টাকা আমার হাতের মুঠোয়। ওপরওয়ালার সংকেত ছাড়া কী এসব হয়?
মাস্টারও বললেন,
বাবু, সমাজে এখনো সততার দাম আছে। সবাই জানে আপনি একজন সৎ ব্যবসায়ী। তাছাড়া আল্লাহ সবসময় ধৈর্যধারণকারীকে পছন্দ করেন।
প্রসঙ্গক্রমে মাস্টার গতকালকে পড়া মহাভারতের দু-চারটা শ্লোক শুনিয়ে দিলে রাধা বাবু তো গলে বিস্মিত হয়ে গেলেন।
আরে মাস্টার তুমি যে আমাকে মুগ্ধ করে দিলা। বলতে বলতে দোকানের গদিতে বাঁধা বাল্মিকী রামায়ণের ছেঁড়া কপিটা তাকে তুলে দিলেন।
বললেন, তুমি পড়ো মাস্টার। লেখা পড়া জিনিসটা সবার কাজ না। এটা সকলের হয় না।
৪) মুুখলেস স্যার আজ বাড়িতে থাকবে বলে মনস্থ করে আছেন। ঘরের ভিতরে দলা হয়ে এলোমেলোভাবে পড়ে থাকা বইপত্তর, জামাকাপড় ধোয়া- মোছার কাজ করবেন। মন চাইলে সূর্য ডোববার আগে বাজারে এক চক্কর মেরে আসবেন। এর জন্য আগে থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কিছু নাই। শরীর মন চললেই হলো। দুপুর গড়িয়ে বিকেল আসবে আসবে করছে; সূর্য পশ্চিম- দক্ষিণ দিকে খানিকটা হেলে গেছে। এমন সময় মোটা গাছের চারা সাইজের দুইটা কচু কাঁধে নিয়া বেতাল গ্রামের রমিজ মিস্তরি বাজার থেকে বাড়ি ফিরছে। তাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস না করলেও স্বইচ্ছায় তারস্বরে চিৎকার করে বলে যাচ্ছে ‘একটু আগে বাজারে আগুন লাগছিল। ডিজেলের টিন পইড়া আগুন ধরে, এতে কয়টা ঘর নষ্ট হয়ে যায়। সাথের ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরিটাও পুইড়া ছাই হয়ে গেছে’। লাইব্রেরি শব্দটা মাস্টারের কানে পৌঁছাতেই তিনি থতমত খেয়ে হঠাৎ চমকে ওঠেন। আরেকটু নিশ্চিত হওয়ার জন্য বাড়ির বাইরে এসে নিজে আগুনের ব্যাপারটা শুনলেন। কালবিলম্ব না করে ময়লা জামাটা গায়ে ঝুলিয়েই বাজারের দিকে ছুটলেন মাস্টার। আকস্মিক নিকটাত্মীয়ের কোনো মারাত্মক দুঃসংবাদ শুনলে সচরাচর মানুষ যেমন করে মাস্টার তা-ই করলেন। কার দোকান পুড়েছে, কয়টা গেল এসব তার কাছে জানা বা শোনার বিষয় না। তার মাথায় কেবল ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরির শত শত বইয়ের কি হলো- একটাই চিন্তা। মাস্টার যেন বাতাসের বেগে উড়াল দিয়ে বাজারে পৌঁছে যায়। ডানে বাঁয়ে কোথাও না তাকিয়ে সোজা লাইব্রেরির সামনে গিয়ে থামলো। পোড়া বই দেখে তার মনটা ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। অশ্রুসজল তার দুই চোখ। বিড়বিড় করে বলছেন, আহা! গত চল্লিশ বছর ধরে লাইব্রেরিটাতে বসি, বই পড়ি, চা খাই এমন একটা ক্ষতি কীভাবে হলো? তিনি দেখছেন, তখনও কিছু মানুষ নদী থেকে মগ বালতি, মাটির কলসি ইত্যাদি দিয়ে পানি এনে আগুনে ছিটিয়ে দিচ্ছে।
এখন চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময়। ব্রহ্মপুত্রের পানি কমে গিয়ে তলানিতে জমে আছে। মৃত নদীর বুকে একহাঁটু জল আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু নি®প্রাণ ডিঙি নৌকা, কোশা নৌকা ও মাছ ধরার মৌসুমি খড়া জালের পুরনো বাঁশ শুকিয়ে খাড়া হয়ে আছে। বাঁশের মাঝখানে দু-চারটা জলজ পাখি পোকামাকড়ের আশায় বসে সতর্ক চঞ্চু সঞ্চালন করছে। পানি আনতে অনেক পথ হাঁটতে হচ্ছে। অথচ বর্ষায় এই নদীতেই জোয়ার আসে, তখন কখনো কখনো দুই পাড় পূর্ণ হয়ে উঠে। নদীটা যেন হৃতযৌবন ফিরে পায়। আসলে ব্রহ্মপুত্র এখন চার মাসের নদী। বাকি আট মাস খাল নালার মতোনই মনে হয়।
এখন আগুন নিভে গেছে। অসংখ্য বই সম্পূর্ণ বা আংশিক পুড়ে গেছে। ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরির মালিক ও তার কর্মচারীরা মনের দুঃখে এসব বই বাইরে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। তখন একেবারে বিনা প্রয়োজনে সেখানে একদল শিশু এসে হাজির। বাজারের কোলেই এদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বলা যায় টুকাই শ্রেণির শিশু এরা। পোড়া বই সরিয়ে সরিয়ে পয়সা বা মূল্যবান জিনিস খুঁজছে। এটা হয়তো এদের কাছে মজার খেলা বিশেষ।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মুখলেস স্যারও এদের দলে যোগ দিলেন। বললেন, ‘ওরে বালকগণ ভিতরের পাতা ভালো আছে এমন বই পাইলে আমার কাছে দিও’। বালকরা গভীর মনোযোগ দিয়ে টাকা পয়সা বা কলম খুঁজতে ব্যস্ত; আর মাস্টার খুঁজছে আস্ত ভালো বই। তার কাছে বইয়ের কালো অক্ষরগুলোই যেন স্বর্ণমুদ্রা মতন। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আদমপুর বাজার কমিটির মাইকিং কানে আসছে। আগুন লাগার কারণ উদঘাটনে বিশেষ কমিটি হয়েছে। রাত ৯টায় জরুরি সভা বসবে। তখন সবাই যে যার মত করে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। বালকগুলো নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল ‘এই বুইড়াটা কত বেয়াক্কল দ্যাখ, পুড়া বইয়ের কালিতে তার চেহারাটা ভূতের মতো হয়ে গেছে।
একজন বলছে, মনে হয় চুর হইবে। দেখছস না রাইত হয়ে গেছে তবু যায়
না।
আরেকজন বলছে, না, চুর হইলে নিশ্চয় আমরার মতো টেকা পয়সা খুঁজতো। কিন্তু ওই বেটা তো শুধু পুড়া বই জমাইতেছে। চুর কি বই পড়ে?
বালকদের নেতাটি এবার মুখ খুললো এবং তাৎক্ষণিকভাবে এর একটা সুন্দর সমাধানও করে দিল,
“চল বাড়ি যাইগা। আর আমার কথা শুইন্না রাখ, এই বুইড়াও একজন বড়ো চুর। তবে সে হইল বই চুর”।
লেখক : গল্পকার ও প্রাবন্ধিক