শুক্রবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

চানাচুরওয়ালা

হোসেন আবদুল মান্নান

চানাচুরওয়ালা

যাত্রীবোঝাই ট্রেন, রেললাইন, রেলস্টেশন আর প্ল্যাটফরমে গিজগিজ করা মানুষ এসব দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে হোসেন মিয়া। ট্রেন দেখলে আগে যেমন একটু ভয় ভয় লাগত এখন তার কাছে একদম পানিভাত মনে হয়। এটা কিচ্ছু না। ট্রেনটা পাগলা হাতির মতন চিৎকার করতে করতে যখন স্টেশনে প্রবেশ করে তখন সকলেই সতর্ক হয়ে গেলেও হোসেনের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, তার মধ্যে ভয়-ডরের কোনো বালাই নেই। সে নবাবের মতন ধীরে সুস্থে লাইনটা পার হয়ে যায়। তার যেনো নির্বিকার একটা ভাব-সাব। ইদানীং সে অনর্থক এবং একবারে অপ্রয়োজনেই এটা করে। তখন দু’পাশ থেকে কিছু মানুষ তার নাম ধরে ডাকতে থাকে,

হোসেন তাড়াতাড়ি পার হও, ট্রেন চলে আসছে ইত্যাদি। কেউ কেউ বলে,

ও তো দেখছি একদিন ট্রেনে কাটা পড়েই মরবে---

একদিন স্থানীয় একজন মুরব্বি রাগত স্বরে বলেছিলেন, ‘মনে হয় তোর জন্য ট্রেনেকাটা মরণটা লেখা হয়ে গেছে’।

হোসেন বিরক্ত হয়। উত্তর দেয়,

‘ট্রেন কী উড়াল দিয়া আইবে? ভয়ের কি আছে? বিশটা বছর তো এই গাড়ির ওপরেই কাটাইছি, কিছু হইলে আগেই হইত। আমারে সাবধান করা লাগবে না বরঞ্চ আপনারা সাবধানে থাইকেন’।

২.

দশ বছর বয়স থেকেই হোসেন শিশু চানাচুরওয়ালা। ট্রেনের ফেরিওয়ালা হিসেবে চানাচুর বিক্রি করে। চানাচুরের টিনের বাক্সটা গামছার ফিতা দিয়ে গলায় ঝুলিয়ে- ‘গরম মচমচে চানাচুর লাগবে চানাচুর।’ সুন্দর সুরেলা আওয়াজ তুলে ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

হোসেনের বাক্সটা বেশ পরিষ্কার ঝকঝকে ও তেলতেলে, সামনের দিকটা সাদা ও স্বচ্ছ কাচ দিয়ে ঢাকা। দূর থেকে চিনাবাদাম মিশ্রিত হলুদ রঙের চানাচুরগুলো দেখা যায়। দু’পাশে ছোট ছোট কৌটা রাখা আছে, কোনোটায় গুঁড়ো পিঁয়াজ-মরিচ, কোনোটায় বিট লবণ, কোনোটায় এক্সট্রা চিনাবাদাম থাকে। অল্প বয়েসী চানাচুর বিক্রেতা হিসেবে হোসেনের নাম আছে। তার হাতের আঙুল ও মুখ সমান গতিতে চলে। তার বেচাকেনাও অন্যদের চেয়ে বেশি। তাই এই বয়সেই সে সংসারের হাল ধরে নেয়। স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করার কোনো সুযোগই হয়নি তার।

৩.

হোসেনের বাবা আজিজ মিয়া এলাকার একজন দিনমজুর শ্রেণির মানুষ। সে কখনো চায় নাই তার একমাত্র ছেলে একজন চানাচুরওয়ালা হোক। সমাজের দৃষ্টিতে চানাচুরওয়ালা পেশাটা পছন্দসই নয়। এর চেয়ে গ্রামের দিনমজুরের সম্মান অনেক বেশি। কিন্তু ছেলে তা বুঝতে চায় না। কারণ চানাচুর বিক্রিতে লাভ ও রোজগার ভালো। তাছাড়া ট্রেনে করে সারাদিন ঘুরে বেড়ানো যায়। গায়ে কাদামাটি লাগার সুযোগ নেই। স্বাধীন পেশা এটা। তাই হোসেন তার নিজের কাজ নিজেই বেছে নেয়। তবে এতে তার মা জমিলা খাতুনের মৌন সম্মতি আছে এবং জমিলাই ছেলের প্রতিদিনের চানাচুর তৈরির দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। এখানে বাবার ইচ্ছা বা মতামত বেশি গুরুত্ব পায় না। মা ও ছেলে উভয়ই খুশি। আগের টানাপড়েনের সংসার এখন ভালো চলছে।

হোসেন ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছে। এ যেনো ট্রেনের চাকায় বাধা বালকের জনান্তিকে বেড়ে ওঠা। ট্রেনে ঘোরা জীবন বলে কথা। এরই মধ্যে তার সমবয়সী কিছু বন্ধু ও পরিচিত জন হয়েছে। বাড়ির কাছে স্টেশন থাকায় রাত বিরাতেও আসা যাওয়ার কোনো অসুবিধা নেই। অনেক সময় স্টেশনের প্ল্যাটফরমে গাড়ি এসে থামলেও হোসেন সহজেই ধরে ফেলতে পারে। সে এখন ভৈরববাজার থেকে ময়মনসিংহের গৌরীপুর জং পর্যন্ত দৈনিক আপ-ডাউন করে। ট্রেনের নিত্যদিনের যাত্রী এবং কর্মচারীগণও তাকে চিনে গেছে। শুধু ট্রেনের কম্পার্টম্যান্টের ভিতরে নয় তাকে মাঝেমধ্যে ছাদেও উঠতে হয়। ছাদের নিম্ন আয়ের যাত্রীদের কাছেও তার চানাচুর পৌঁছাতে হবে। গলায় বাক্স নিয়ে হোসেন বানরের মতো চোখের পলকে ট্রেনের ছাদে ওঠে আর নামে। তার বাড়ন্ত শরীর আর বেতের মতন হাত পা বিদ্যুৎগতিতে চলে। চলন্ত ট্রেনের ছাদ বরাবর সে হাঁটে, গান গায়, এক বগি থেকে অন্য বগিতে নির্ভয়ে লাফিয়ে পার হয়ে যায়। এটা তার কাছে খুব সহজ একটা কাজ বলে মনে হয়। পড়ে যাবার দুশ্চিন্তা কখনো তার মনে উঁকি দেয় না। ভৈরববাজার থেকে উত্তর দিকে সররাচর, কিশোরগঞ্জ, আঠারো বাড়ি বা গৌরীপুর স্টেশনে ট্রেন থামলে সে সচরাচর নিচে নামে এবং দুপুরের জন্য হালকা লাঞ্চ করে নেয়। এটাও তার প্রতিদিনের রুটিনের মতন। তাছাড়া এ স্টেশনগুলো তুলনামূলকভাবে বড়ো এবং জনবহুল। তবে সে সবচেয়ে বেশি সময় পায় গৌরীপুর ও ভৈরববাজারে। এ দু’জায়গায় ট্রেনের ইঞ্জিনকে সামনে পিছে আনতে বাধ্য হয়।

৪.

হোসেন এখন অনেক পরিচিত এক চানাচুর-বালক। অনেকে তাকে নাম ধরে ডাক দেয়-চিৎকার করে বলে, ‘ওই হোসেন এদিকে আয়, ভালো করে পিঁয়াজ মরিচসহ চানাচুর দে’। হোসেনের মুখে কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই, অবসাদ নেই, টগবগে তরুণ। তারুণ্যের শক্তিকে বলীয়ান সে। যুবক হওয়ার পথে এগিয়ে তার বয়স। এখন বেশি দৌড়াদৌড়ি মানে বেশি আয়-রোজগার। এভাবে বছরের পর বছর হোসেন চানাচুর বিক্রি করে চলেছে। কিন্তু ট্রেনে দুর্ঘটনার কোনো ইতিহাস নেই তার জীবনে। একবার শুধু গছিহাটা স্টেশনের প্ল্যাটফরমে কালু নামের লম্বা মতন এক বদমাশ কুলির মাথার বস্তার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে তার গলার চানাচুরের বাক্সটা পড়ে গিয়ে কাচটা ভেঙে গিয়েছিল এবং কিছু মাল নষ্ট হয়েছিল। আর কোনো এক্সিডেন্ট রেকর্ড নাই। সে বারও তার নিজের কোনো দোষ ছিল না, সে তার মতন চানাচুর বিক্রি করছিল। কুলি বেটাই খারাপ মানুষ ছিল, সে জেনেশুনেই ধাক্কা দেয়। ঘটনা জানার পর, সে দিন হোসেনের মা-ও কালুর ব্যাপারে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে নালিশ করেছিল। দিন যায় সপ্তাহ যায়, হোসেন মাঝে মাঝে কালু কুলিকে গচিহাটা স্টেশনে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানতে দ্যাখে। কিন্তু সে একদিন জানতে পারে, সেই কুলি কালুমিয়া কয়েক দিনের ব্যবধানে মারাত্মক এক অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ঘরবন্দি হয়ে পড়ে আছে। কী আচানক বিচার! তার নাকি কোনো চিকিৎসা নাই। একেই বলে প্রকৃতির বিচার।

আরেকবার হয়েছিল, তিনটা জিআরপি পুলিশের কনস্টেবল একসঙ্গে ফন্দি করে তার অনেক চানাচুর খেয়ে পয়সা না দিয়ে চলে গেছিল। পয়সা চাইলে তারা তাকে গাড়ি থেকে ফেলে দিতে চাইছিল। কিন্তু হোসেন কোনো অভিশাপ না দিয়ে এদেরকে মাফ করে দেয়। কারণ এরা রাতদিন ট্রেনেই থাকে এবং সব সময় দেখা সাক্ষাৎ হয়ে যায়। তাছাড়া পানিতে বাস করে কুমিরের সঙ্গে মুখ কালা করা যায় না।

৫.

দেখতে দেখতে হোসেনের বয়স এখন বিশ বছর। বাবা আর কাজকর্ম তেমন করতে পারে না। বয়স যত না এর চেয়ে বেশি অসুস্থতা তার। অ্যাজমা শ্বাসকষ্ট রোগ। এখন ছেলের রোজগারের ওপরই সংসার। তবুও মা-বাবার চিন্তা হোসেনের বিয়ে দিতে হবে। এটা তাদের ওপর ফরজ। এ ছাড়া ছেলেটা কত বছর ধরে ট্রেনে ট্রেনে দৌড়াচ্ছে, তারও একটা সংসার হলে বাবা নাতি-নাতনি দেখে যেতে পারবে।

একদিন ঘটা করেই গ্রামের কিছু আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীকে নিয়ে হোসেনের বিয়ের কথাবার্তা পাকা হলো। আগামী মাসেই বিয়ে। গ্রামের এক গরিব চাষির মেয়ে। গরিব হলেও এদের জাত বংশ ভালো। এক সময় এরা এলাকার মাথা ছিল। মানুষের সময় তো সমান যায় না। পাত্রীর নাম জোছনা বেগম। লেখাপড়া নাই তবে আরবি পড়া জানে এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। স্বভাব চরিত্রে খুব সুনাম আছে। রান্নাবান্নার কাজে দক্ষ।

হোসেন সিদ্ধান্ত নিল, বিয়ের পরেও সে তার নিত্যনৈমিত্তিক ট্রেনের কাজ একদিনের জন্যও কামাই দেবে না। প্রতিদিনের মতো ভোরের ট্রেন ধরতে হবে। এখন তার মাথার ওপরের বোঝা আরও ভারী হয়েছে। মা বাবা, নিজের স্ত্রীসহ সংসারে একজন মানুষ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাকে আরও অধিক পরিশ্রম করতে হবে। চানাচুর ভাজায় এবার মা’র সঙ্গে যুক্ত হলো নতুন বউ। এবার যেনো সুখী ও ভালো সময়ের মুখ দেখছে হোসেনদের গোটা পরিবার। পাড়াপড়শিতে বলাবলিও করছে, হোসেনের বউয়ের রাশি ভালো। তারা এখন আগের চেয়ে হাসিখুশি এবং সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে এসেছে। বছর দুই এমনি করে কেটে যায়। পরিবারে আরেকজন সদস্য যোগ হয়। তার ঘরের আলো হয়ে আসে একটা ছেলে সন্তান। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, মাত্র সাত দিনের জন্য অসুস্থ বাবা আজিজ মিয়া নাতির মুখ দেখে যেতে পারেনি। বাবার মৃত্যুর সপ্তাহের মধ্যেই হোসেনের পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। লোকে তাকে সান্ত¡না দিয়ে বলছে, আল্লাহ হোসেনের বাবাকে নিয়ে গিয়ে আরেকটা বাবাকে পাঠিয়েছে। এসব কথায় হোসেন খুব শান্তি পায়, তার শোক-তাপ সবকিছু নিমিষে ভুলে যায়। প্রকাশ না করলেও বাবার জন্য দিবানিশি তার গুমরে গুমরে প্রাণ কাঁদে। নীরবে নিভৃতে চোখের জল ফেলে। ইদানীং সে প্রায়ই অন্য মনস্ক হয়ে যায়। বেঁচে থাকতে বাবাকে সে অনেক কষ্ট দিয়েছে, কথা শুনে নাই, বারবার ট্রেনের চানাচুরের ব্যবসা ছাড়তে বলেছে তা-ও মানে নাই ইত্যাদি। আজ তার খুব মনে পড়ছে, অসুস্থ ও গরিব বাবার কথা। বাবার মুখটা বারবার তার চোখের সামনে ভেসে আসলে ট্রেন ছেড়ে ভরদুপুর বেলায় নান্দাইল রেলস্টেশনের পেছনের বয়স্ক কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলায় বসে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল হোসেন। তখন বাবার জন্য ভালো ওষুধ পথ্য কিনে দিতে পারেনি। ভালো খাবার দিতে পারেনি এসব কথাই মনে পড়ছিল। যাক এখন নিজের ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বাবাকে ভুলতে চায় হোসেন। বাবা তো কারও চিরকাল থাকবে না, এটাই দুনিয়ার রীতি।

৬.

সারা দিন ট্রেন দৌড়ানোর পর আজ হোসেনের মুখের ওপর একটা কালো বিষণœতার ছাপ পড়ে আছে। এটা কখনো হয় না। দীর্ঘদিনের ট্রেন চলাচলে এমনটা আগে কেউ দেখেনি। রাতে ঘরে ফিরতেই মা জমিলা খাতুনের মনটা নড়ে উঠলো। তার ভিতরটায় হু হু করে বাজলো। ছেলের মুখ তো মায়ের মন। এটাই দুনিয়ার রীতি হয়ে আছে।

বাবা, তোমার কিছু হইছে?

না মা, আজ মনটা কেমন যেনো অস্থির অস্থির লাগছে। ভাবছি চানাচুরের ব্যবসাটা আর করব না।

মা বিচলিত।

কোনো সমস্যা হইছে কি না, পুলিশ বা ছিনতাইকারী ধরছে কিনা- এসব কথা একের পর এক জিজ্ঞেস করে চলেছে মা।

হোসেন বললো,

মা, বাবা কখনো চাইত না আমি চানাচুর বিক্রি কইরা চলি। জীবদ্দশায় বাবার কথা রাখতে পারি নাই। এইবার সিদ্ধান্ত নিতে চাই, বাজারে তরিতরকারি ও সবজির ব্যবসা করব।

আচ্ছা বাবা, তুমি যা চাও তা-ই কইরো। তোমার ওপর আমরা কিছু জোর করবো না।

হোসেন তার স্ত্রীকেও তার সিদ্ধান্তের কথা জানায়।

স্ত্রীও তার নতুন ব্যবসার কথায় মৌন সম্মতি দেয়। কারণ চানাচুরওয়ালার বউ কথাটা শুনতে তারও কখনো ভালো লাগেনি। বরং সবজির ব্যবসাটাই ভালো হবে। এতে সম্মান বেশি আছে।

হোসেন ভাবছে, এবার দুয়েক দিন বিশ্রাম নিয়ে নতুন ব্যবসায় মন দিবে।

৭.

বিকাল থেকে মানিকখালী রেলস্টেশন ও তৎসংলগ্ন প্ল্যাটফরমের চা স্টলে এমনিতেই নানা শ্রেণির মানুষের জটলা লেগে থাকে। এরা বেশির ভাগ উদ্দেশ্যবিহীন ও কর্মহীন। দিনের শেষে সন্ধ্যা বেলায় ট্রেনের আসা-যাওয়া দেখে, মানুষজন দেখে। অনেক দিন পরে হোসেন আজই ট্রেনে চড়েনি। তাই সেও আর ১০ জনের মতো সূর্যাস্তের আগে স্টেশনে গিয়ে হাঁটছে, এর-ওর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ, কথাবার্তা বলছে। এখন থেকে আর ট্রেনে ফেরি করে চানাচুর বিক্রি করবে না তা-ও দু’চার জনকে জানাচ্ছে। তাছাড়া নতুন ব্যবসা শুরু করার বিষয়ে পরামর্শ নিচ্ছে। ভাবছে শাক-সবজির ব্যবসার জন্যও একটা পুঁজির দরকার এবং বাজারে বসার জন্য একটু জায়গারও ব্যবস্থা করতে হবে। এলাকার মুরব্বি, বাজার কমিটির নেতা, মেম্বার গণ্যমান্যদের সঙ্গে দেখা করতে হবে ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করছে।

৮.

আজকের আবহাওয়াটাও চমৎকার, যাকে বলে নাতিশীতোষ্ণ। সন্ধ্যার পর পর বিনা কারণেই স্টেশনে অন্য দিনের চেয়ে অতিরিক্ত লোকসমাগম হয়েছে। তখন ভৈরববাজারের দিক থেকে একটা লোকাল ট্রেন আসার কথা থাকলেও আজ হঠাৎ কী কারণে একটা স্টেশন আগেই ওটাকে থামিয়ে রেখে চিটাগং থেকে আসা বাহাদুরাবাদ মেইল ট্রেনকে পাস করে দিচ্ছে স্টেশন মাস্টার। কেউ বলতে পারছে না, অসময়ে এই মেইলট্রেন কেন? দুর্ঘটনায় কোনো লাইন বন্ধ হয়েছে কী? তা-ও বলতে পারছে না।  এ ট্রেন আবার সব স্টেশনে নয়, কেবল দু’চারটা বড় স্টেশনে থামে। ননস্টপ মেইলট্রেন এবং দ্রুত গতিসম্পন্ন হওয়ায় খুব তাড়াতাড়ি চলে আসে। এসব তখন হোসেনের মাথায় নেই, তার চিন্তা কেবল আগামীকাল থেকে সবজির দোকান চালু করা। হর্ন বাজিয়ে ট্রেনটা দৈত্য-দানবের মতন স্টেশনের কাছাকাছি চলে আসছে, সেটা দেখেও হোসেন আনমনা হয়ে ওপারে যেতে চাচ্ছে। তবে আজ চিৎকার করে তাকে কেউ বাধা দিচ্ছে না। তার হিসাব, ‘সারা জীবনে কত হাজারবার লাইন ক্রস করে আসলাম গেলাম কখনো কোনো সমস্যা হইল না, আর এটা তো মাত্র দুই-তিন সেকেন্ডের ব্যাপার’। এ কথা ভেবে হোসেন যেই লাইনটা পার হতে যাচ্ছে অমনি ঝন্ করে একটা ছোট্ট শব্দ হলো। আলোআঁধারির মধ্যে কেউ দেখল বা দেখলো না। এমনকি দ্রুতগামী ট্রেনের আলোতে দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ভাসমান মানুষের কারো তেমন একাগ্র দৃষ্টিও ছিল না। পলকের ভিতরে ট্রেনটা পার হয়ে গেলে তাৎক্ষণিক কিছু মানুষ চিৎকার করতে করতে দৌড়ে যাচ্ছে, বলাবলি করছিল, এই মাত্র কে একজন ট্রেনে কাটা পড়েছে। হোসেনের পা দুইটা শরীর থেকে ছিটকে গিয়ে খানিকটা দূরে পড়ে আছে। তার অর্ধেক শরীর থেকে টিপকলের পানির মতন লাল রক্ত বের হয়ে রেললাইনের পাথরের চিপায় বেড়ে ওঠা সবুজ ঘাসকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। তখনো হোসেনের বিচ্ছিন্ন হওয়া দেহখানি থরথর করে কাঁপছিল। তার কালো চোখ দুটো আকাশের দিকে উন্মীলিত, তবে মুখে কোনো ভাষা ছিল না। আশ্চর্য! কাছে এসে টর্চের হলুদ আলোয় তার মুখটা দেখে স্থানীয় দর্শকদের সবাই তাকে চিনে ফেললো। আরে, ও তো দেখছি, পশ্চিমপাড়ার আজিজ মিয়ার একমাত্র ছেলে চানাচুরওয়ালা হোসেন। কিন্তু তার চানাচুরের বাক্সটা গেল কোথায়? 

 

                লেখক : গল্পকার ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর