শুক্রবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

নতুন বইয়ের উৎসবে বইমেলা

মোস্তফা মতিহার

নতুন বইয়ের উৎসবে বইমেলা

ভাষা শহীদদের স্মৃতির স্মরণে ও শ্রদ্ধা নিবেদনে নিয়মিত আয়োজনের অংশ হিসেবে বাংলা একাডেমির আয়োজনে চলছে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা। বরাবরের মতো এবারের মেলাতেও বইয়ের উৎসবে মেতে উঠেছেন বইপ্রেমীরা। এবারের মেলার মূল প্রতিপাদ্য ‘পড়ো বই গড়ো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট জায়গা নিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের বইমেলা। এর মধ্যে একাডেমি প্রাঙ্গণে ১২০টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭৩টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৫১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৬৪টি ইউনিট অর্থাৎ মোট ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৯৩৭টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। মেলায় ৩৭টি প্যাভিলিয়ন রয়েছে। যার মধ্যে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১টি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩৬টি। বইমেলার বিন্যাস গতবারের মতো অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। তবে কিছু আঙ্গিকগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিশেষ করে মেট্রোরেল স্টেশনের অবস্থানগত কারণে গতবারের মেলার বাহিরপথ এবার একটু সরিয়ে মন্দির-গেটের কাছাকাছি স্থানান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া টিএসসি, দোয়েল চত্বর, এমআরটি বেসিং প্লান্ট এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন অংশে মোট আটটি প্রবেশ ও বাহিরপথ রয়েছে। গত বছরের মতো শিশুচত্বর মন্দির-গেটে প্রবেশের ঠিক ডান দিকে বড় পরিসর রাখা হয়েছে। এবার লিটল ম্যাগাজিন চত্বর স্থানান্তরিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চের কাছাকাছি গাছতলায়। সেখানে প্রায় ১৭০টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন বিকাল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার এবং সন্ধ্যায় থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রতি শুক্র ও শনিবার মেলায় সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ‘শিশুপ্রহর’ থাকছে। বইমেলার প্রবেশ ও বাহিরপথে পর্যাপ্ত সংখ্যক আর্চওয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ পুলিশ, র‌্যাব, আনসার ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। নি-িদ্র নিরাপত্তার জন্য মেলা প্রাঙ্গণজুড়ে তিন শতাধিক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা রয়েছে। সমগ্র মেলা প্রাঙ্গণের দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি হয়ে শাহবাগ, মৎস্য ভবন, ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত এবং দোয়েল চত্বর থেকে শহীদ মিনার হয়ে টিএসসি, দোয়েল চত্বর থেকে চাঁনখারপুল, টিএসসি থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত নিরাপত্তার স্বার্থে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত ৬৩ প্রকাশক : মূল মেলা থেকে বিচ্ছিন্ন অংশে বরাদ্দ পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত ৬৩ জন প্রকাশক। মেট্রোরেল স্টেশনের পাশের গেটের কাছে বিচ্ছিন্ন অংশে স্টল দেওয়াতে এই প্রকাশকদের পক্ষে মেলা চালিয়ে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ক্রেতা তো দূরের কথা দর্শনার্থীরাও বিচ্ছিন্ন এই অংশে আসেন না- এমনটি জানালেন ক্ষতিগ্রস্ত প্রকাশকরা। বিচ্ছিন্ন অংশে স্টল বরাদ্দ পাওয়া প্রকাশনা সংস্থাগুলো হলো- জোনাকী প্রকাশনী, মুক্তদেশ, কথামেলা, ইলমা, বর্ণমালা, শৈলী প্রকাশন, রচয়িতা, পানগুছি, আলোর ঠিকানা, প্রিতম প্রকাশ, গতিধারা, সিয়ান পাবলিকেশন্স, হুদহুদ প্রকাশন, দেশজ, দ্বিমিক, সুলেখা, মেঘনা, কাকাতুয়া, বৈতরণী, মাছরাঙা, ছায়া প্রকাশন, কবিতাচর্চা, এপিপিএল, অক্ষর, মানবাধিকার, স্বনির্ভর, কেন্দ্রবিন্দু, নবকথন, বাসিয়া, কালের চিঠি, বই পুস্তক, শিলালিপি, রৌদ্রছায়া, প্রত্যয়, কারুকাজ, নৃ-প্রকাশন, অস্তিত্ব, নবকথন, যোদ্ধা, লালন বিশ্ব সংঘ, এক রঙা এক ঘুড়ি, গল্পকার, সাঁকোবাড়ি, মৌ প্রকাশনী, অর্জন, আইডিয়া, মানচিত্র, বীকন, বলাকা, পানকৌড়ি, পাতা প্রকাশন, চর্চাগ্রন্থ, ঝিনুক, কিডজ কারাভ্যান, সিদ্দিকীয়া পাবলিকেশন্স, কণ্ঠস্বর, উপকথা ইত্যাদি।

 

ইমদাদুল হক মিলন

কথাসাহিত্যিক

এবারের বইমেলা শুরু থেকেই দারুণ জমজমাট। বিশেষ করে মেট্রোরেলের সুবিধা থাকার কারণে শুরু থেকেই মেলায় ক্রেতা-দর্শনার্থীদের ভিড় বেড়েছে। সাধারণত যেটা হয়, মেলার শুরুর দিকে দর্শনার্থীরা ঘুরেফিরে বই পছন্দ করেন। পুরোদমে বই কেনা শুরু করেন ১৫ তারিখের পর থেকে। এবারও তেমনটাই ঘটবে। মেলায় আমার বই এসেছে তিনটি। অন্ধকার নামতে পারেনি, চোর এসে গল্প করেছিল এবং বাবান ও ঘুঘু পাখির সংসার।

 

মোস্তফা কামালের ঐতিহাসিক উপন্যাস কারবালা উপাখ্যান

সময় প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মোস্তফা কামালের নতুন উপন্যাস ‘কারবালা উপাখ্যান’। ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক কারবালার কাহিনি অবলম্বনে লেখা বইটিতে উঠে এসেছে মহানবী (সা.)-এর চার খলিফার শাসনকাল এবং ইমাম হাসান-হোসেনের জীবন ও কর্মসহ নানা ঘটনা। দীর্ঘ সময়ের গবেষণা, পরিবর্ধন, পরিমার্জন শেষে উপন্যাসটি প্রকাশ করেছেন লেখক। প্রতি মেলায় লেখকের একাধিক বই থাকলেও এবারের গবেষণা ও  ইতিহাসনির্ভর এ বইটির কাজ করতে গিয়ে লেখক এবার আর অন্য কোনো বই লিখতে পারেননি।

আলোচনায় আসিফ নজরুলের ‘আমি আবু বকর’

বইমেলার শুরু থেকেই আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুলের উপন্যাস ‘আমি আবু বকর’। ইতোমধ্যে বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণ শেষ হয়ে গেছে। ইতিহাসের একটি বিশেষ সময়কে তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসটিতে। ‘আমি আবু বকর’ বর্তমান ছাত্র রাজনীতির প্রতিচ্ছবি। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে নির্যাতন এবং এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক বিশ্ববিদ্যালয় তরুণের কাহিনি। বিশেষত গণরুমে নির্যাতন, শিক্ষার্থীদের শিবির অপবাদ দিয়ে মারধর, শিক্ষক রাজনীতির পরিস্থিতি এসেছে এই উপন্যাসে। চলমান প্রাসঙ্গিক অন্য ইস্যুগুলোও আলোচিত হয়েছে।

 

মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন
প্রকাশক, অন্বেষা

যাতায়াতে মেট্রোরেলের সুবিধায় এবারের বইমেলা অন্য সময়ের তুলনায় ভিন্নতা পেয়েছে। এ বছরও তরুণ-তরুণী, শিক্ষার্থী পাঠকদের সংখ্যাই বেশি। এর বাইরেও প্রবীণ পাঠকও আমাদের বাড়তি প্রেরণা দিচ্ছে। এসব পাঠকের বেশির ভাগই গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক বইগুলোর প্রতি আগ্রহ  দেখাচ্ছেন। বইমেলায় অন্বেষা প্রকাশনী ৬০টির মতো বই প্রকাশ করেছে। এখন পর্যন্ত যতটুকু দেখেছি, তাতে আমরা প্রকাশকরা আশাবাদী  যে, এবারের বইমেলা ভালো হবে।


ওসমান গণি
প্রকাশক, আগামী

ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টকে না দিয়ে বাংলা একাডেমি নিজেই মেলা আয়োজনের পরিকল্পনা ভালো। তবে বাস্তবায়নে কিছু ত্রুটি রয়েছে। এগুলো সমাধান করা গেলে এ আয়োজন অন্য উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে মনে করি। মেলায় ৩০০-এর বেশি প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান থাকার কথা নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বইমেলায় বহু অপ্রকাশক, মৌসুমি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা পাইরেসি বই, অবৈধ অনুবাদ বই প্রকাশ করে। এ অসঙ্গতিগুলোর বাইরে এবার নান্দনিুক, সুন্দর একটি বইমেলার প্রত্যাশা করছি।

অচিন্ত্য চয়ন
প্রকাশক, দেশ পাবলিকেশন্স
বেশ কয়েক বছর পর বইমেলা শুরু থেকেই জমজমাট মনে হচ্ছে। ক্রেতা-দর্শনার্থীর সমাগম ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তবে এবারের বইমেলায় বেশ কিছু অব্যবস্থাপনা ও অসংগতি অনেক প্রকাশককেই ভোগাচ্ছে। সেগুলো ঠিক থাকলে আরও ভালো হতো। দেশ পাবলিকেশন্স থেকে এবার প্রায় ৩০টির বেশি নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে। এর প্রায় অর্ধেকের  বেশি এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। বাকিগুলো শিগগিরই প্রকাশ পাবে। আশা করছি এবারের মেলায় ভালো সাড়া পাব।

 

বাংলা একাডেমির স্বেচ্ছাচারিতার কারণে আমাদের এখন পথে বসার মতো অবস্থা হয়েছে

-মঞ্জুর হোসেন, স্বত্বাধিকারী, জোনাকী প্রকাশনী

একটা সিন্ডিকেটের কাছে বাংলা একাডেমি বাধ্য। স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে বাংলা একাডেমি আমাদেরকে মেলার মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন একটা অংশে স্টল দিয়েছে। বাংলা একাডেমির স্বেচ্ছাচারিতার কারণে আমাদের এখন পথে বসার মতো অবস্থা হয়েছে। আমাদেরকে যেহেতু মূল মেলা থেকে বিচ্ছিন্ন একটা অংশে ফেলেছে তাই আমাদের দাবি হচ্ছে, মেট্রোরেল স্টেশনের পাশের গেটটিকে বাহির পথের পরিবর্তে প্রবেশপথ হিসেবে খুলে দেওয়া হোক। তাহলেও আমরা কিছু পাঠক পাব।

 

বিগত বছরের সব অব্যবস্থাপনাকে এবার হার মানিয়েছে বাংলা একাডেমি

-আদিত্য অন্তর, স্বত্বাধিকারী, প্রকাশনা সংস্থা ইত্যাদি

এবার কোনো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব না দিয়ে বাংলা একাডেমি দায়িত্ব তাদের নিজেদের মধ্যেই রেখেছে। যার কারণে আমরা ভেবেছিলাম অন্যান্যবারের তুলনায় এবারের মেলা অনেক গোছানো হবে। কিন্তু বিগত বছরগুলোর সব অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মকে হার মানিয়েছে বাংলা একাডেমি। অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের হিসেবে বাংলা একাডেমি নিজেদের রেকর্ড নিজেরাই ভেঙেছে। স্টল ও প্যাভিলিয়নের ডায়াগ্রাম পর্যন্ত ঠিক করতে পারেনি বাংলা একাডেমি। এ ছাড়া লটারির নামে নিজেদের পছন্দের প্রকাশকদের সুবিধাজনক স্থানে স্টল ও প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দিচ্ছে। এতে বেশির ভাগ প্রকাশক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। 

 

অভিযোগের তীর বাংলা একাডেমির দিকে

এবারের মেলার শুরু থেকে এক সপ্তাহ পার হওয়ার পরও অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলা অব্যাহত রয়েছে বলে প্রকাশক, লেখক ও পাঠকদের অভিযোগের তীর বাংলা একাডেমির দিকে। মেলার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং নিয়মিত ধুলা নিবারণের জন্য পানি না ছিটানো এবং প্রতিদিন মশক নিধনের সার্বিক ব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও সেসবের কিছুই এখন পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়নি। যার কারণে প্রকাশক, লেখক ও পাঠকদের বেশির ভাগই মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্রামাগার না থাকা, শৌচাগার ব্যবস্থা অপরিচ্ছন্ন ও পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা না থাকায় মেলায় আগতরা আর অংশগ্রহণকারী প্রকাশক ও বিক্রয়কর্মীরা প্রতিনিয়তই নানা ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। অব্যবস্থাপনার অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য বাংলা একাডেমির পরিচালক ও মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোনকল রিসিভ করেননি।

সর্বশেষ খবর