শুক্রবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

কবিদের গদ্য লেখা

হোসেন আবদুল মান্নান

কবিদের গদ্য লেখা

একটা বিষয় নিবিড় অভিনিবেশ নিয়ে লক্ষ করলে দেখা যায় যে, বাংলা সাহিত্যের আলোচিত কবিরা যখন গদ্যের ভিতর দিয়ে নিজের আত্মজীবনী, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বা চিঠিপত্র রচনা করেছেন তা যেন গতানুগতিক ধারার লেখালেখির চেয়ে একটু ভিন্ন মেজাজ বা স্বাদের হয়ে উঠেছে। এটা তাঁর স্বভাবজাত কবিত্বকলার শক্তির বলেই হয়েছে। এর কারণ প্রধানত তাঁদের স্বনির্বাচিত ও আলংকারিক শব্দের গাঁথুনিতে এসব রচনা উপস্থাপন করা। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো গদ্য পাঠ করে আজও পাঠককে বলতে শুনি, এটা যে পুরোটাই আধুনিক গদ্য কবিতার মতন। আমাদের ভাষা ও সাহিত্যে যাঁরা কবি হিসেবেই স্বনামে খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাঁদের গদ্য, গল্প বা উপন্যাসও যে সমকালকে ছাড়িয়ে গেছে তা অনেকেই হয়তো জানি না। যুগ যুগ ধরে তাঁদের নামের আগে কেবল কবি বিশেষণটি উজ্জ্বল হয়ে আলো বিচ্ছুরিত করে চলেছে। তাঁদের গল্প, উপন্যাস, চিঠিপত্র বা আত্ম-কাহিনি বিপুলভাবে সমাদৃত, আলোচিত বা পঠিত হলেও তিনি কবি হয়েই বেঁচে আছেন এবং থাকবেন। বোধকরি, কবির অভিধা পাওয়া এমন কীর্তিমান মানুষগুলো নিজেরাও অন্য কিছু হতে চান নি। কবি এবং কবিতার মধ্যে বাস করে কবিতায়ই নিজেকে বিলীন করে দিয়েছেন।

 

২.

বাংলাভাষা ও সাহিত্যের সবচেয়ে বড়ো কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যদি সামনে মেলে ধরা যায়, তাহলে দেখতে পাই, তিনি বিশ্বকবি, ঋষিতুল্য এক দার্শনিক, যুগদ্রষ্টা, মহাসমুদ্রের মতন অতলস্পর্শী পান্ডিত্য নিয়ে এক বিস্ময়কর ভাষাবিদ। কিন্তু বিগত একশো বছরের অধিককাল ধরে বিশ্বের বহু ভাষাভাষীর মানুষ তাঁকে গীতাঞ্জলির কবি হিসেবেই চিনেছেন। অথচ কবিতার বাইরে গিয়ে তিনি সাহিত্যের সব শাখায় অতুলনীয় সফলতা, দাপুটে স্পৃহায় হয়েছেন আত্মবিশ্বাসী, আমৃত্যু পরম্পরাহীন একা এবং একজন হয়ে বিচরণ করে গেছেন। গদ্যের ভিতরেও যে এক ধরনের ছন্দ, ভাব-বিশ্লেষণ এবং অনুকার অনুপ্রাসের বন্ধন থাকে তিনি তাঁর অনাগত পাঠককে অকাতরে এসব উপহার দিয়ে গেছেন। তিনি তাঁর কালোত্তীর্ণ ছোটগল্প, স্মরণীয় গীতালি, বরণীয় উপন্যাস, নাটক বা ছিন্নপত্রের চিঠিতে এমন হাজারও প্রমাণ রেখে গেছেন। গদ্য বা গদ্য কবিতারও তিনি শ্রেষ্ঠ রূপকার হয়েছেন। তাঁর কালজয়ী গদ্য থেকে অংশবিশেষ-

“আমি শীত গ্রীষ্ম বর্ষা মানিনি, কতবার সমস্ত বৎসর ধরে পদ্মার আথিত্য নিয়েছি, বৈশাখের খররৌদ্রতাপে, শ্রাবণের মুষলধারাবর্ষণে। পরপারে ছিল ছায়াঘন পল্লীর শ্যামশ্রী, এ পারে ছিল বালুচরের পা-ুবর্ণ জনহীনতা, মাঝখানে পদ্মার চলমান স্রোতের পটে বুলিয়ে চলেছে দ্যুলোকের শিল্পী প্রহরে প্রহরে নানা বর্ণের আলোছায়ার তুলি। এই খানে নির্জন-স্বজনের নিত্যসংগম চলেছিল আমার জীবনে। অহরহ সুখদুঃখের বাণী নিয়ে মানুষের জীবনধারার বিচিত্র কলরব এসে পৌঁচচ্ছিল আমার হৃদয়ে। মানুষের পরিচয় খুব কাছে এসে আমার মনকে জাগিয়ে রেখেছিল। তাদের জন্য চিন্তা করেছি, কাজ করেছি, কর্তব্যের নানা সংকল্প বেঁধে তুলেছি, সেই সংকল্পের সূত্র আজও বিচ্ছিন্ন হয়নি আমার চিন্তায়। সেই মানুষের সংস্পর্শেই সাহিত্যের পথ এবং কর্মের পথ পাশাপাশি প্রসারিত হতে আরম্ভ হলো আমার জীবনে”। -সূচনা, সোনার তরী।

৩.

জগদ্বিখ্যাত কবিদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের গদ্যেও রয়েছে এক কাব্যময় জ্যোতির আলোকচ্ছটা। তাঁর বর্ণনায় রয়েছে প্রাণময় গতি ও ছন্দোবদ্ধ উচ্ছ্বাস। প্রেম দ্রোহ বিরহ ভালোবাসা ধর্মকর্ম সবই তাঁর কাব্যে, গীতিতে উদ্ভাসিত হয়েছে প্রবলভাবে। একই সঙ্গে তাঁর গদ্যের শব্দ বিন্যাস ও চিত্রকল্পে এর ব্যতিক্রম হয়নি। তাঁর গদ্যের ভিতরেও মান অভিমান ক্রোধ, হৃদয়ের গহিন ভিতর থেকে স্ফুরিত স্পন্দন ভেসে আসে। নিচের উদ্ধৃতি থেকে তা স্পষ্ট হয়ে যায়।

“যদি কোনো দিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকিত্বের পরম শূন্য থেকে অসময়ে নেমে আসতে হয়, তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল। সেই নজরুল অনেক দিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন, পূর্ণত্বের তৃষ্ণা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুণ এই ধরায় এসেছিল অপূর্ণতার বেদনায় তারই

বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে আপনাদের মাঝে কেঁদে গেল”।

-যদি আর বাঁশি না বাজে।

৪.

রবীন্দ্র-পরবর্তী আধুনিক যুগের বাংলাভাষী কবিদের মধ্যে পঞ্চপা-ব বা কল্লোল খ্যাত কবিরাই উল্লেখযোগ্য। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র এবং শিক্ষক হিসেবেও এঁদের পৃথক নিজস্ব ভুবন ছিল। এঁদের অন্যতম প্রধানজন বুদ্ধদেব বসু। বস্তুত রবীন্দ্রনাথের পরে তিনিই বহুমাত্রিক ও সব্যসাচী লেখক। বলা হয়, সংস্কৃত ভাষা থেকে ‘মেঘদূতের’ অনুবাদ, সম্পাদনা ও ভূমিকা রচনা করা তাঁর সেরা কাজেরই অংশ। তাঁর কবিতার ভাষায় ও আঙ্গিকে রয়েছে এক সপ্রতিভ মোহনীয় প্রতিভার স্বাক্ষর। গদ্য কবিতা তাঁদের হাত ধরেই জনপ্রিয়তা পায়। সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ থাকলেও গদ্য বা প্রবন্ধ রচনায় তিনি ছিলেন অতুলনীয় এক কৌশলী। তাঁর স্মৃতিধর্মী রচনা, গবেষণাপত্র এবং উপন্যাসের পাতায় পাতায় রয়েছে আধুনিক গদ্যশৈলীর এক অভূতপূর্ব চিত্রপট। তাঁর গদ্য-

“আমার মনে হয় যৌবনকে নিয়ে কবিরা চিরকালই কিছু বাড়াবাড়ি করেছেন। এত স্তব, এত স্তুতি, এত ছন্দ; সে কার উদ্দেশ্যে? কত মুগ্ধ ভক্তের অর্ঘ্য নিবেদন শতাব্দীর স্রোত পার হয়ে এসে পড়ছে কায়িক যৌবনের একটি মনোহারিণী প্রতিমার পায়ে, যার রূপের অনেকখানি কবিকল্পনা থেকেই আহরিত। আর যেহেতু কবিরা বেশির ভাগই পুরুষ, সেই প্রতিমা নারী দেহেরই অবয়ব দিয়ে গড়া”।

-উত্তরতিরিশ থেকে।

৫.

আমাদের কবি, স্বাধীনতার কবি শামসুর রাহমান। তিনি বাংলা কবিতার রাজ্যের এক নিঃসঙ্গ শেরপা। অনেকে মনে করেন, বাংলা সাহিত্যের কাব্যকাঠামোর আধুনিক বিন্যাস ঘটেছে তাঁর কবিতার ভিতর দিয়েই। তাই তিনি আধুনিক ভাষা ও কাব্যের পুরোধা কবি ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শক্তিমান, প্রতিবাদী ও শানিত কবিতার কবি তিনি। কবিতার বাইরেও তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য গদ্য। গীতিকবি হিসেবেও তাঁর পরিচিতি ছিল যথেষ্ট আলোচনায়। যদিও সেখানটায় তুলনামূলক বিচারে পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হতে পারেননি তিনি। সেখানে তাঁর সফলতা আসে খুবই সীমিত। তিনি একাধারে কবি, সম্পাদক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার ছিলেন। তবে তাঁর গদ্যও হয়ে উঠেছে কাব্যময় শিল্পিত। তাঁর লেখার অংশ থেকে।

“সে-সব দুপুর এখন ধূসর ছায়া, এবং রকমারি ছায়া আমার বর্তমানকে ভরিয়ে রাখে তাদের ফিসফিসে কণ্ঠস্বর দিয়ে। কোনও কোনও ধূসর গোধূলিতে যখন দৃষ্টি ছড়িয়ে দিই অদৃশ্য করুণ রঙিন পথে, তখন একটি কি দুটি মুখ, আবছা কোনও কথা কিংবা অস্পষ্ট স্মৃতি, কোনও গানের কলি হঠাৎ মনে পড়ে যায়। মনের ভেতরে বাজতে থাকে বেহাগের সুর।’’

-কালের ধুলোয় লেখা থেকে।

৬.

আল মাহমুদ এক সময়ে বাংলা কবিতার বরপুত্রের পরিচয় লাভ করেছিলেন। তাঁর কাব্য প্রতিভা নিয়ে বাংলা ভাষার কবিদের মধ্যে কৌতূহল বিদ্যমান রয়েছে এবং আরও অনেক দিন চলমান থাকবে এমন বিশ্বাস কবির নিজেরই ছিল। তিরিশের কবিদের পরে তাঁর কবিতায় ভাটি বাংলার নদীনির্ভর জনজীবনের প্রেম-বিরহের কাহিনি মূর্ত হয়ে উঠেছে। বিখ্যাত সোনালী কাবিনের কবি নামে তাঁর যশকীর্তন হলেও তাঁর আরও অসংখ্য শিরোনামের কবিতা কালোত্তীর্ণ হয়ে আছে। আল মাহমুদ বাংলা ভাষায় মহাকাব্যও রচনা করেছেন। তাঁর কাব্যের ছন্দে শব্দের মাধুকরী ব্যবহার, অনুপ্রাস ও উপমার সংযোজন তাঁকে জীবদ্দশায় আলাদা খ্যাতি এনে দিয়েছিল।

এ-সব ছাপিয়ে আল মাহমুদ তাঁর গল্পে, স্মৃতিকথায় ও উপন্যাসে অসাধারণ মৌলিকত্ব নিয়ে আসেন। গদ্যের ভিতরে তিনি তাঁর অঞ্চলের বহুল প্রচারিত শব্দগুলোকে তুলে আনেন নিপুণ কৌশলে। তাঁর গদ্যের বর্ণনা শৈলী, কাহিনির ধারাবাহিকতা, স্থান, কাল পাত্রের অপূর্ব বিন্যাস পাঠককে অবলীলায় মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। বিশেষ করে তাঁর ব্রাহ্মণবাড়িয়াকেন্দ্রিক গল্পসমগ্রে বিচিত্র ও ছোট ছোট মহৎ চরিত্রের বিপুল উন্মেষ ঘটেছে। যা পাঠককে স্বতঃস্ফূর্ততায় টানে এবং ভবিষ্যতের গন্তব্যের দিককে ইঙ্গিত করে।

নিচের খন্ডাংশে দেখা যায়,

“সুরহীন গান তেলহীন প্রদীপের মতো, এই মহাজন বাক্য আধুনিক কবিদের মানলে চলে না। কারণ আধুনিক লিরিক-কবিদের গীতিধর্মী কবিতাগুলো তো কোনো সুরকার, কণ্ঠশিল্পী বা বাদনযন্ত্রের আধিপত্যের মধ্যে মাথা নত না করেও মানব জাতির হৃদয় সংগীতে পরিণত হয়েছে। মানুষের কবিতা যে

সংগীতের বস্তুধর্মী সহযোগিতা এবং কোনো সুকণ্ঠীর ধ্বনিমাধুর্য ছাড়াই চিন্তার আধ্যাত্মিক ইঙ্গিতের দ্যোতনায় পর্যবসিত হতে পারে তা কে না জানে। এ রহস্য আবু জাফরেরও অজানা থাকার কথা নয়।’’

-দিনযাপন।

                লেখক : গল্পকার, কলামিস্ট ও গবেষক

সর্বশেষ খবর