পাখিটার যেন ব্যস্ততার অন্ত নেই।
এ গাছে ও গাছে এ ডালে ও ডালে ওড়াউড়ি কিংবা ঘোরাঘুরির যেন শেষ নেই। শহিদ মিনারের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে সে নেচে বেড়ায়। যেখানে যাকে পায়, অমনি তাকে শুধায়... গান গেয়েছিস তো, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...?
পাখিদের রাজ্যে গান তো সবাই গায়। গান গাইতে গাইতেই তারা রাতের আঁধার তাড়ায়, সুর্যিমামার ঘুম ভাঙায়, ফুলেদের মুখে হাসি ফোটায়। গানই তাদের সব কাজের মূলমন্ত্র। আর তাছাড়া আজকের এই দিনে কোন পাখিই বা পারে গান না গেয়ে থাকতে! আজকের এই গানে হাসি এবং কান্না দুই-ই থাকে মিলেমিশে। মায়ের চোখের জল অথবা পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনাধারার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় এই গানের ভিতরে। মাটির ঘ্রাণ এবং আকাশের রোদ্দুর দুটোই একসঙ্গে থাকে এই গানে। হাজার কণ্ঠে প্রভাতফেরির এই গান গুঞ্জরিত হয়ে উঠলে তখন এ দেশের পাখিরা কী করে! ঘুমভাঙা চোখে তাকায় এদিক ওদিক। কুয়াশার চাদর সরিয়ে অবাক চোখে মানুষ দ্যাখে। মানুষ আর মানুষ। যেনবা মানুষের ঢল। সবার কণ্ঠে একই গান, একই সুর। পাখিরাও তখন ভাই হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে গেয়ে ওঠে এই গান।পাখিটার গায়ের রং সাদা-কালোয় মিশেল দেয়া। কালো বলতে একেবারে কুচকুচে কালো, মেঘ কালো আঁধার কালো। সাদাটুকু স্রেফ ধবধবে সাদা, চৈতী চাঁদের মতো, হাস্নাহেনা ফুলের মতো। রঙের বৈপরীত্যে মানিয়েছে বেশ। যেন বা গায়ে তার ডোরাকাঁটা জামা। নাম তার দোয়েল। বাংলাদেশের। মানুষ বলে জাতীয় পাখি। কত শত পাখির মধ্যে সে আলাদা। শহর নগরে কাকের সংখ্যাই বোধহয় বেশি। বাপরে বাপ! পাখিদের রাজ্যে এমন নিকষ কালো রঙের আর কোনো পাখি আছে কিনা কে জানে! সারা দিন কেবল কা কা চিৎকার। ভারি ঝগড়াটে গলার স্বর। অনেক সময় পাখিদেরও বিরক্তি বোধ হয়। কিন্তু আজকের এইদিনে একটুও বিরক্ত হয় না দোয়েল। বরং মনে মনে বলে কী করবে ওরা! ওটাই যে ওদের মাতৃভাষা! মা বলো আর মাতৃভাষা বলো, তার আবার সুন্দর-অসুন্দর কী! মা মানেই সুন্দর। মাতৃভূমি বলো মাতৃভাষা বলো, সব সুন্দর। অতুলনীয় সুন্দর।
দোয়েল পাখি লেজ নাচিয়ে গেয়ে ওঠে-সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি। হঠাৎ সে ডান দিকের ডানার তলে ঠোঁট গুঁজতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়, চোখ সরু করে তাকায়। খুব কাছেই অন্য একটি ডালে বসে আছে একঝাঁক অচেনা পাখি। বিদেশি সাহেব সুবোর মতো চেহারা। হ্যাঁ, অচেনাই তো মনে হচ্ছে। ওই যে একেবারে সামনের ওটা কি মেমসাহেব নাকি! এক লাফে দোয়েল একটু এগিয়ে যায় ওদের কাছে। খুব কাছের একটা ডালে বসে জিজ্ঞেস করে।
তোমরা কারা?
মেমসাহেব মতো পাখিটা বলে,
আমরা তো ভাই বিদেশি পাখি। শীত এলেই আমরা আসি তোমাদের দেশে। প্রতিবছরই আসি।
অ। তোমরা তাহলে আমাদের অতিথি।
হ্যাঁ, তা বলতে পার।
বাঙালি অতিথিপরায়ণ জাতি। নিশ্চয় তোমাদের অসম্মান হবে না।
দলছুট এক অতিথি পাখি শহিদ মিনারের মাথার উপরে উড়তে উড়তে ঘুরতে ঘুরতে এসে দলের মধ্যে ঢুকে পড়ে। মেমসাহেব পাখিটা তাকে শুধায়,
কোথায় ছিলিরে এতক্ষণ?
দলছুট পাখি একটু দম নিয়ে বলে,
ওই তো ওখানে। শহিদ মিনার দেখছিলাম।
মেমসাহেব পাখি জিজ্ঞেস করে,
শহিদ মিনার কাকে বলে জানিস?
ওই যে শহিদ মিনার।
ওর মধ্যেই মা আছে, দুপাশে সন্তান আছে,
জানিস এ সব?
তা তো জানি না।
তাহলে আর উড়ে উড়ে কী দেখলি তুই?
মানুষ দেখলাম। হাজার হাজার মানুষের মিছিল। শত শত ফুলের মালা। আহা, উপর থেকে উড়ে উড়ে দেখার মজাই আলাদা।
মেমসাহেব মুখ ভেংচিয়ে বলে,
তোর তো সব কিছুতেই মজা। আজ এখানে কেন এত মিছিল, কেন এত ফুলের মালা, সেই কথাটা বল দেখি!
না, দলছুট পাখির মুখে কোনো কথা নেই। অকারণেই দু’বার পাখা ঝাপটায়। দোয়েল এবার এগিয়ে এসে বলে,
আহা, ওকে এত ধমকাচ্ছ কেন ভাই? সে সব কথা তো এই আমাদের মধ্যেই অনেকে মনে রাখে না।
তাই নাকি?
তবে আর বলছি কী! সেই ১৯৫২ সালের কথা ক’জনই বা ঠিক মতো জানে! মায়ের মুখের ভাষার জন্য তেমন লড়াই পৃথিবীর আর কোথাও হয়েছে কোনো কালে? এই দেশে হয়েছে, এই এখানে।
ভাষার জন্য লড়াই?
বিদেশি অতিথি পাখিদের মধ্যে একজন অতি উৎসাহে মুখ বাড়িয়ে দেয়। আপন মনেই সে বলে, ভাষা তো এমনিতেই পাওয়া যায় মায়ের মুখ থেকে। তার জন্য আবার লড়াই কীসের?
দোয়েল পাখি হেসে ওঠে ফিক করে। তারপর পাখা নেড়ে বলে,
ঠিক বলেছ ভাই, মাতৃভাষা মায়ের কাছে থেকে এমনিতেই পাওয়া যায়। সবাই তা-ই পায়। কিন্তু...
কিন্তু কী! এ দেশের মানুষ কি তা পায়নি?
পেয়েছে। কিন্তু এ দেশের মানুষের মাতৃভাষা চর্চার অধিকার কেড়ে নিতে চেয়েছিল পাকিস্তানিরা।
তাই নাকি!
এ দেশের মানুষকে তাই মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য লড়তে হয়েছে। পুলিশের গুলিতে মরতে হয়েছে।
গুলিতে মরার কথা শুনে দেশি-বিদেশি অনেক পাখির বুক কেঁপে ওঠে। তাদের কণ্ঠে ঝরে পড়ে বিস্ময়,
বলো কী! ভাষার জন্য মৃত্যু?
হ্যাঁ, তাই। বাংলা ভাষার দাবি জানাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে রফিক শফিক সালাম বরকতসহ আরও অনেকে। এ দেশে তাদের বলে ভাষা-শহিদ। সেই শহিদদের স্মৃতি জাগিয়ে রাখতেই বাঙালি গড়েছে শহিদ মিনার।
মেমসাহেব পাখি বলে,
বাব্বা, তুমি এত জানো!
দোয়েল এতক্ষণে লজ্জায় মুখ নিচু করে। অন্য দেশি পাখিরা জানায়,
বাংলাদেশের জাতীয় পাখি যে! বাঙালি জাতির অনেক খবরই সে রাখে।
ও, তাই বুঝি! সেই থেকে এই শহিদ মিনার।
না না, এটা বায়ান্ন সালের সেই শহীদ মিনার নয়।
দোয়েল পাখি খুব পন্ডিতের মতো জানায়, তারপর কত ভাঙাগড়া হয়ে গেল। কত যে রক্তপাত আর কত যে অশ্রুজলের মূল্যে পাওয়া এই বাংলাদেশ! সব কিছুর মূলে ওই শহিদ মিনার।
বর্ণনার এই ভঙ্গি দেখে মেমসাহেব পাখি খুব খুশি। আনন্দের সঙ্গে সে বলে, তোমার কাছে ইতিহাসের গল্প শুনতে খুব মজা তো! আরও অনেক শোনাও না ভাই!
আচ্ছা, সে একদিন শোনাব না হয়। আজ শুধু শুনে রাখ-বাঙালির ভাষা বাংলা ভাষা বড়ই মধুর ভাষা। বাঙালির দেশ এই বাংলাদেশ খুবই মনোরম এক দেশ। এই দেশ ছিল পরাধীন। তখনকার শাসকরা বাঙালির মুখ থেকে বাংলা ভাষা কেড়ে নেওয়ার জন্য নানান রকম ফন্দি আঁটে। কিন্তু কাজ হয়নি কিছুতেই। বায়ান্ন সালের এই একুশে বাংলা মায়ের সোনার ছেলেরা বুকের রক্ত ঢেলে প্রতিষ্ঠা করে মাতৃভাষার মর্যাদা।
গল্পের মাঝখানে হঠাৎ ব্রেক কষতে হয় মেমসাহেব পাখির জন্য। পাখা ঝাপটিয়ে সে সহসা বলে ওঠে,
ওটা কী হচ্ছে দোয়েল ভাইয়া? শহিদ মিনারের সামনে হাত উঁচিয়ে ওরা সবাই কী বলছে?
দোয়েল পাখি সংক্ষেপে জানিয়ে দেয়, ওরা দেশ গড়ার শপথ গ্রহণ করছে।
এটুকু বলার পর সবাইকে সে আহ্বান জানায় চলো, আমরাও ওদের মাথার উপরে ডানা মেলে ছায়া দিই, এই একুশে আমরাও শপথ নিই।
তারপর পাখিরা উড়ে যায়। আপন ভাষার কূজনে ভরিয়ে দেয় আকাশ বাতাস।