শিরোনাম
শুক্রবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

আন্দালিব রাশদী

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

 পর্ব-১৪

পূর্ব প্রকাশের পর

 

এক পক্ষ মনে করে নেতার কাছ থেকে যতটা সম্ভব বেশি আদায় করে থিয়েটার হল এবং সার্বিকভাবে নাটকের উন্নয়ন করতে হবে। অন্য পক্ষ মনে করে তাকে ঢুকতে দিলে সংস্কৃতিচর্চার বারোটা বেজে যাবে। কর্তাভজা নাটক লিখতে ও মঞ্চস্থ করতে হবে। মোস্তফা হোসেন মন্টু টের পাচ্ছে তার সংহত অবস্থান এবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাচ্ছে। উপদেষ্টা পরিষদও মনে করছে নেতাকে দূরে রাখা ভীষণ ভুল হয়ে গেছে।

নেতা চাইলেন গরম ডিম নাটকটি আবার মঞ্চস্থ হোক। অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে তিনি রঙ্গ থিয়েটারের ওপর অবিচার করেছেন তিনি নিশ্চিত হতে চান। মন্টু ভাই বললেন, হুট করে নাটক নামানো যায় না। চলমান নাটকে এক-দুই দিনের অতিরিক্ত শো করা যায়। পুরনো নাটক মঞ্চে আনতে নতুন নাটকের সমান অর্থ ও সময় ব্যয় হয়। কাজেই এখনই গরম ডিম নামানো সম্ভব নয়। তবে এটা আমাদের সবচেয়ে সফল নাটক। নেতা বললেন তাহলে স্ক্রিপ্টটা দাও। আমি বাংলা পড়তে জানি।

রেশমা নামে একজনকে নতুন একটি নাটকের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে রাখার জন্য নির্দেশ দিয়ে নেতা নাটকের স্ক্রিপ্ট নিয়ে নিজের মেডিকেল চেকআপ করাতে সিঙ্গাপুর চলে গেলেন। সপ্তাহ দুয়েক পর ফিরে এসে কয়েকটি জায়গায় লাল কালির আন্ডারলাইন করা স্ক্রিপ্ট মন্টু ভাইকে ডেকে তার হাতে ফেরত দিলেন। বললেন, কই কোথাও তো আমার নাম দেখলাম না। কিন্তু দলের লোকজন যে বলেছে, আমাকে নিয়ে মশিউজ্জামান এই নাটক বানিয়েছিল।

মন্টু ভাই বলল, আমি তো তখন রঙ্গ থিয়েটারে ছিলাম না। তবে নাটকটা দেখেছি।

এবার তিনি বলতে শুরু করলেন, নদী থেকে বালু তুলে শত শত ট্রাক বালু পাচার করছে এই লোকটি কে? সরকারি কলেজের এক অংশ দখল করে পার্টির অফিস বানিয়েছে এই লোকটি কে? ব্রিজ প্রজেক্টের টাকার ৭০ ভাগ নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়ে নিয়েছে এই লোকটি কে? আইএ পড়া মেয়েকে কলেজের গেট থেকে তুলে এনে দিনের পর দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে এই লোকটি কে? বিরোধী দলের নেতাকে খরচ করে দিতে শুটার মামুনকে দিয়ে গুলি করিয়েছে, এই লোকটি কে? এ রকম আরও কিছু প্রশ্ন করে তিনি বললেন, নাট্যকাররা নিজেদের কী ভাবেন? এই লোকটিকে শুধু তারাই চেনেন? আমরা চিনি না?

মন্টু ভাই বলে, পাঠক আর দর্শকরা নিজের বুদ্ধিবিবেক খাটিয়ে চেনে নেন। চিনলেও অধিকাংশ সময় বলেন না কে। কোনো কোনো পাঠক আবার চরিত্রের মধ্যে নিজেকেও আবিষ্কার করে ভাবেন এ চরিত্রটি আমার কিংবা আমার খুব কাছাকাছি। এটাই যদি ঘটে, মানে চরিত্র যদি পাঠক ও দর্শকদের ভাবাতে পারে এটাই নাট্যকারের সাফল্য। নেতা বললেন, আমার সেই মেধা আছে বলেই তো চিনতে পেরেছি।

এটা নাট্যকারের সাফল্য। আমরা পাঁচ মাস পর মশিউজ্জামানের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে গরম ডিম আবার মঞ্চস্থ করব, এবার অবশ্য অধিকাংশ অভিনেতাই হবে নতুন।

নেতা জিজ্ঞেস করলেন মূল চরিত্রটি কে করছে?

উপযুক্ত কাউকে এখনো পাইনি, আগের সেই অভিনেতা রণেশদা তো দুই মাসের মধ্যে ফিরে আসবেন বলে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান চলে গেছেন, সাড়ে তিন মাস হয়ে গেল, কবে আসবেন বুঝতে পারছি না।

তিনি বললেন, কথাটা মনে করিয়ে ভালো করেছো, তার আসা না আসা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। দাঁড়াও, একটা জরুরি ফোন সেরে নিই।

এ সময় তিনি ফোনে নির্দেশ দিলেন, শোন, হাতে সময় কম। ফজরের আজানের আগে রণেশের বাড়িটা পুরোটার দখল নিয়ে নিবি। দরকার হলে কয়েক রাউন্ড ফায়ার করে দিস। সাবধান, মানুষের গায়ে যেন না লাগে, আমি রক্ত সহ্য করতে পারি না।

ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে কেউ জিজ্ঞেস করে থাকতে পারে, কবে?

তিনি বললেন, কবে মানে? শালারা ঘাস খাস নাকি? অপারেশন হবে আজ রাতে, ফজরের আগে সব সাফসাফা চাই।

তিনি এবার নাটকের দিকে মনোযোগ দিয়ে বললেন, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব আনোয়ার হোসেন যে নেই সে জন্য কি সিরাজউদ্দৌলা নাটক বন্ধ হয়ে আছে? কষ্ট করে তোমাদের আর রণেশের বিকল্প খোঁজার দরকার নেই। আমাকে নিয়ে নাও। আমি পারব। নাটকের অভিজ্ঞতা আমার চল্লিশ বছরের। জনগণের সঙ্গে নাটক করেই তো এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। আমাকে নাও।

এবার মন্টু ভাই বলল, তাহলে তো নাটকটা রিয়েলিস্টিক হয়ে যাবে। আমরা রিয়েলিস্টিক কিছু করি না। আমাদেরটা স্যুররিয়েল-পরাবাস্তব।

নেতা বললেন, মন্টু মিয়া! তুমি সেদিনের ছেলে, নাকে টিপলে মায়ের দুধ গলগল করে বেরিয়ে আসবে। আমাকে পরাবাস্তব শেখাতে যেও না। সময় থাকতে ভালো হয়ে যাও। শালার মশিউজ্জামানকে বলেছিলাম, ভালো হয়নি। ভালো না হলে কী হয় দেখলেই তো।

ত্রুটিপূর্ণ উচ্চারণের কারণে বাদপড়া রেশমা নামে একজনকে নতুন নাটকে নায়িকার চরিত্রে রাখার জন্যই নেতা মন্টুকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। মন্টু তখন বলল, আমাদের কাজটা আমাদের করতে দিন। কে কোথায় ফিট হবে আমি জানি।

নেতা বললেন, মন্টু মিয়া, এত জানা ভালো না, আমরাও তো কমবেশি জানি। আমাদের নলেজটাও কাজে লাগাও। হজে চলে যাব, তাই ভাবছিলাম তোমার সঙ্গে হাতটা মিলিয়ে যাই, তুমি হাত বগলতলায় ঢুকিয়ে রাখলে মোসাফা করব কেমন করে?

নতুন নাটক মঞ্চে নামার পরদিনই নেতার এক ঘনিষ্ঠজনের মালিকানাধীন পত্রিকায় সংবাদ বেরোল, রঙ্গ থিয়েটারের মন্টুর যৌন লাঞ্ছনার শিকার বিশিষ্ট নাট্যাভিনেত্রী রেশমা নাটক থেকে বাদ পড়েছেন। অভিনেত্রী রেশমা জানিয়েছেন মোস্তফা হোসেন মন্টুর শয্যাসঙ্গী হতে অস্বীকার করায় তাকে প্রথমে কেন্দ্রীয় চরিত্র থেকে এবং পরে নাটক থেকেই বাদ দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও কয়েকজন বিগত বছরগুলোয় মোস্তফা হোসেন মন্টুর যৌন লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। ভুক্তভোগীদের একজন জানিয়েছেন তারা মন্টুর গ্রেফতার ও বিচার দাবিতে প্রতিবাদ মিছিল করবেন এবং জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দাখিল করবেন।

মন্টু ছাপা খবরসহ কয়েকটি পত্রিকা টিয়ার সামনে রাখে এবং বলে আরও খারাপ কিছুর জন্য মানসিক প্রস্তুতি রেখো।

টিয়া ইশারায় বলল, অসুবিধে নেই। রেশমার বড় বোন রুশনাও মশিউজ্জামান আকন্দের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেছিল। এসব দেখার অভ্যাস আমার আছে।

মন্টু যে টিয়ার সব কথাই বোঝে এমন নয়। টিয়ার ঘরের বিভিন্ন স্থানে টুকরো টুকরো কাগজ এবং এটার সঙ্গে ওটার সঙ্গে বাঁধা কিছু পেনসিলও আছে। টিয়া দ্রুত লিখে দেয়। যেমন আগের কথাটিতে সবটাই ইশারার ভাষায় কিন্তু রুশনা নামটি হাতে লেখা।

পরদিন খবরের কাগজে বেরোল কাজী মশিউজ্জামান আকন্দের বোন বলেছেন, তার পরিবার ক্রসফায়ারে নিহত তার ভাইয়ের মৃত্যুর পুনর্তদন্ত চায়।

নেতার দলের নারীফ্রন্টে সদ্য যোগ দেওয়া স্বামীর কাছ থেকে সদ্য তালাক পাওয়া নাসিমা জামান তার বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পুনর্তদন্ত দাবি করে আদালতে আবেদন জানিয়েছেন। আবেদনে যেসব বিষয় উঠে এসেছে সেগুলো হচ্ছে : আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সুনাম ক্ষুণ করার জন্য পরিকল্পিতভাবে এটাকে ক্রসফায়ারের মৃত্যু বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। মশিউজ্জামানের মৃত্যুতে কার লাভ হয়েছে? সভাপতির পদ কার দখলে গেছে? মশিউজ্জামানের সুন্দরী স্ত্রীকে বিয়ের নামে কে নিজের কবজায় নিয়ে নিয়েছে? মশিউজ্জামানের বাড়ি এখন প্রকৃত পক্ষে কার দখলে? এ প্রশ্নগুলোর জবাবের মধ্যেই মশিউজ্জামান হত্যার প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে পাওয়া যাবে।

নাসিমা জামান আশ্বাস পেয়েছেন সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন পাবেন। বর্তমান কাউন্সিলর নেতার দলের হলেও এখন আর তার সুনজরে নেই। নেতা সাধারণত যে ধরনের নারীর প্রতি আকৃষ্ট হন নাসিমা জামান সে ধরনের আকর্ষণীয় কেউ নন। মন্টু ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করতে সম্মতি দিয়ে এগিয়ে আসায় পরবর্তী রাজনৈতিক আশ্বাসগুলো পেয়েছেন। মশিউজ্জামান হত্যাকান্ডের বেনিফিশিয়ারি চিহ্নিত করে মোস্তফা হোসেন মন্টুকে হেনস্তা করে কার্যসিদ্ধি করার পর নেতা নিশ্চয়ই নাসিমাকে ভুলে যাবেন এবং তাকে কাউন্সিলর মনোনয়ন না দেওয়ার একশ একটা যুক্তিসংগত কারণ খুঁজে বের করবেন।

পরদিনের খবরটি ফলোআপ সংবাদ। সংবাদদাতা বিশেষ অনুসন্ধানে জানতে পেরেছেন মশিউজ্জামানের স্ত্রী মোস্তারিন জাহান ওরফে টিয়ার সঙ্গে মোস্তফা হোসেন মন্টুর সম্পর্কটি অনেক দিনের। মৃত্যুর আগে এ নিয়ে মশিউজ্জামানের সঙ্গে তার স্ত্রীর দ্বন্দ্ব চলে আসছিল।

জেলার সংস্কৃতি অঙ্গনের কৃতী পুরুষ মশিউজ্জামানের মৃত্যু উভয়ের ষড়যন্ত্রের ফল কি না এ নিয়ে তদন্তকারী খতিয়ে দেখবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। উল্লেখ্য, আদালত নাসিমা জামানের আবেদন পুলিশ সুপার বরাবর পাঠিয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন।

মন্টু ভাই এ পত্রিকাও টিয়ার সামনে তুলে ধরে।

টিয়া খবরটা পড়ে এবং শূন্য দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে। সামনে মন্টু কিন্তু কিছুই তার চোখে পড়ছে না, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। হাতের ইশারায় কিছু একটা বোঝাতে চাচ্ছে। মন্টু ভাই পাঁচ বছরের দাম্পত্য জীবনে এই প্রথম টিয়ার কথা কিছুই বুঝল না। শুনল কেবল একটানা কিছু গোঁ-গোঁ শব্দ।

মন্টুর এই বুঝতে না পারাও তাকে ক্ষুব্ধ করল। এবার চিৎকার করে কেঁদে ফেলল। মন্টু বারবার জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে, তোমার কী হয়েছে?

ওদিকে পটিতে বসা দুজনের চতুর্থ সন্তান তন্ময় চিৎকার করছে, মা আমার হয়ে গেছে। আমার হয়ে গেছে মা। ওয়াশ করে দাও।

দ্রুত কাগজে একটুখানি লিখে কাগজটা মন্টুর দিকে ছুড়ে দিয়ে টিয়া ছেলের কাছে চলে যায়। মন্টু দ্রুত লিখিত চিরকুট পড়ে : আমি জানতাম না আমাকে আবার বিধবা হতে হবে। তোমাকে ক্রসফায়ারে দেবে।

ক্রসফায়ার তার মাথায় আসেনি, টিয়ার মাথায় এসেছে। মন্টু ভাইয়ের মনে হলো যা-ই ঘটুক টিয়াকে ভেঙে পড়তে দেওয়া যাবে না। টিয়ার সামনে গিয়ে বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে বলল, শালারা কচুও করতে পারবে না।

টিয়া এবার হাতের চারটা আঙুল দেখিয়ে ক্রমান্বয়ে চারবার হাতের তালু নামিয়ে যা বলল, এটা তাকে লিখে দিতে হয়, তখনই মন্টু বুঝেছে। টিয়া বলেছে আমার চারটে বাচ্চা, এত ছোট, এত ছোট, এত ছোট এবং এত ছোটো। আমার বাচ্চাগুলোকে কি এতিম হতে হবে?

মন্টু বলে প্রশ্নই আসে না।

টিয়া বলল, অসুবিধে নেই। তোমার সঙ্গে চার বাচ্চাসহ আমিও মরব। আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না।

নয়.

পরিকল্পনা টিয়ারই, প্রেস ক্লাবে যাবে সংবাদ সম্মেলন করবে। যেহেতু বোবা নারীর মুখের ভাষা সাংবাদিকরা বুঝবেন না, এক পাতার মধ্যে লিখিত একটি বিবৃতি দেবে।

মন্টু ভাই বলল, এসব ঝামেলায় তোমার জড়ানোর দরকার কী?

টিয়া বলল, আমি তো জড়িয়েই আছি। তোমাকে ক্রসফায়ারে দেবে। নাসিমা আমার বাচ্চাদের বাড়ি থেকে বের করে দেবে, আমি বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করব-এ হতে পারে না।

প্রেস ক্লাবের সভাপতি রাজি ছিলেন না, কিন্তু সাধারণ সম্পাদক বললেন, আমরা যে নেতার দালাল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছি এই বদনাম ঘোচানোর জন্য ছোট হলেও এটা একটা সুযোগ। হাতছাড়া করা ঠিক হবে না মান্নান ভাই। এই তালুকদার আবদুল মান্নান তখনো মশিউজ্জামানকে যখন ক্রসফায়ারে দেওয়া হয়, হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছিলেন।

[চলবে]

সর্বশেষ খবর