শুক্রবার, ১ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

আন্দালিব রাশদী

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

পর্ব-১৫

পূর্ব প্রকাশের পর

 

কিন্তু নেতার ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা এবং ক্ষমতা ব্যবহার তাকেও আতঙ্কিত করে তোলে, তার পত্রিকা ঘিরে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার অধিকারীদের চারপাশের মতোই একটি পরগাছা শ্রেণি গজিয়ে উঠেছে। তাদের ননসেন্স ভ্যালু উপেক্ষা করা যায় না। তারা এমনকি তার সভাপতিত্বেরও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি সাধারণ সম্পাদককে বলেন, বেশ প্রেস কনফারেন্স করুক। আমি এটাতে থাকতে চাই না, তুমি এটা সামলাবে। আমি আজই ঢাকা চলে যাচ্ছি, তোমার সঙ্গে কথা বলে পরশু আসব।

বাসা থেকে প্রেস ক্লাব আসা এবং ফিরে যাওয়া পর্যন্ত পথে আক্রান্ত হতে পারে এমন আশঙ্কার কথা ভেবে মন্টু ভাই কোতোয়ালির ওসির সঙ্গে দেখা করল। তার ধারণা ছিল ওসির ধমক খাবে। প্রেস কনফারেন্স করতে নিষেধ করবেন এবং এমনও হতে পারে নাসিমা জামানের অভিযোগের দোহাই দিয়ে তাকে গ্রেফতারও করতে পারে।

কিন্তু ওসি উল্টো তাকে বললেন, বউকে বলবেন প্রেস ক্লাবে জোরগলায় কথা বলতে। কাল একটা পেট্রল টিম দিয়ে দেব আপনার বাড়ির ধারেকাছে থাকবে, প্রেস ক্লাবে আসার পথে ফলো করবে, আবার শেষেও বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে। শালার দিন শেষ হয়ে আসছে। শালা আমারে করবে বদলি, তোর দৌড় আমার জানা আছে।

শেষ বাক্যটা স্বগতোক্তি। ওসির সঙ্গে নিশ্চয়ই তার কোথায় গরমিল কিছু ঘটেছে। নেতা ওসিকে বদলি করতে চান, ওসি তার থোড়াই পরোয়া করেন। কোতোয়ালিতে তার মাত্র চার মাস হয়েছে।

শেহেরজাদের কাছে চারজন সন্তান রেখে গত রাতে এ ফোর সাইজের এক পাতায় হাতে লেখা বিবৃতির পঞ্চাশটি ফটোকপি করে টিয়াকে নিয়ে মন্টু ভাই যখন প্রেস ক্লাবের দিকে যাচ্ছে চৌরাস্তার মোড়ে দুটি মোটরসাইকেলের চারজন আরোহী তাদের আটকায় এবং রিকশা থেকে নেমে আসতে বলে। মন্টু ভাই পেছন ফিরে দেখতে চেষ্টা করে কোথায় পেট্রল বাহিনী। হতাশ হয়।

ঠিক তখনই সাদা পোশাকের দুজনকে বহন করা একটি বাইক তাদের সামনে দাঁড়ায় এবং পেছনের জন চিৎকার করে বলে মানিক আর রবিউল বাঁচতে চাইলে এক্ষণ ভেগে যা, নইলে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক গুলি করব।

জাদুকরি কাজ হলো, চারজনের দুই বাইক দ্রুত চলে গেল এবং দুজনের বাইকটি একবার রিকশায় আগে একবার রিকশার পেছনে থেকে তাদের প্রেস ক্লাব পৌঁছা পর্যন্ত দৃষ্টিসীমার মধ্যেই ছিল।

প্রেস ক্লাবের ভিতরে ঢুকে টিয়া ও মন্টু ভাই দুজনেই অবাক। টেবিলে মাইক সাজানো, দুটি টেলিভিশন চ্যানেলের মাইক্রোফোন ও ক্যামেরা। চেয়ার প্রায় সবই দখল হয়ে আছে, হেড টেবিলে পাঁচটি চেয়ার। প্রেস ক্লাবের সেক্রেটারি তাকে মাঝখানের চেয়ারটিতে বসাল। পেছনে ব্যাকড্রপে কালো ক্যানভাসে সাদা রঙে পুরু হরফে লেখা শহীদ কাজী মশিউজ্জামান আকন্দের বিধবা ও বোবা স্ত্রী মোস্তারিন জাহান টিয়ার সংবাদ সম্মেলন।

অবাক হওয়ারই কথা, এ ধরনের কোনো ব্যাকড্রপ তারা তৈরি করেনি, কিন্তু করার জন্য কাউকে এক পয়সাও দেয়নি, আসলে ব্যাকড্রপ যে দরকার হতে পারে এটা তাদের মাথায়ও আসেনি। এসব চেয়ার-টেবিল সাজানোর পয়সাই বা কে দিল। টেবিলে ৫০০ এমএল পানির পাঁচটি বোতল সাজানো। প্রেস ক্লাবের সেক্রেটারি একটি সূচনা বক্তব্যে জানালেন এ সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া কোনো বক্তব্যের দায় প্রেস ক্লাব বহন করবে না। তবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর দরোজা সবার জন্যই অবারিত থাকবে। মন্টু ভাই নিজের এবং টিয়ার পরিচয় দিয়ে বললেন, যেহেতু কাজী মশিউজ্জামানের বিধবা স্ত্রী বর্তমানে আমার স্ত্রী মোস্তারিন জাহান টিয়া জন্ম থেকেই মূক বা বোবা হওয়ার কারণে আমাদের মতো কথা বলতে অক্ষম, সম্প্রতি স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত দুটি সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তার বক্তব্য লিখে এনেছেন। আমরা তার বক্তব্য সবার হাতে হাতে তুলে দিচ্ছি। তার পরও সংক্ষেপে তার বক্তব্যের মোদ্দাকথা তুলে ধরছি। তিনি বলেছেন : ক) আমার বর্তমান স্বামী মোস্তফা হোসেন মন্টুর সঙ্গে আমার প্রয়াত স্বামী কাজী মশিউজ্জামানের জীবদ্দশায় কখনো দেখাই হয়নি, কাজেই তার সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্ন অবান্তর।

খ) রেশমা নামক নারীকে শয্যাশায়ী করতে আমার স্বামীর আহ্বানের বিষয়টি সম্পূর্ণ বানোয়াট ও উদ্দেশ্যমূলক।

গ) একটি মহলের প্ররোচনায় রেশমার বড় বোন রুশনাও আমার সাবেক স্বামী কাজী মশিউজ্জামানের বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ করেছিলেন।

ঘ) গরম ডিম নামক একটি সামাজিক নাটককে কেন্দ্র করে আমার স্বামীকে গ্রেফতার ও হত্যা করা হয়।

ঙ) আমার সাবেক স্বামীর বোন নাসিমা জামান কোনো একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির প্ররোচনায় আমার সাবেক স্বামীর ভিটেবাড়ি দখলের জন্য চক্রান্ত করছেন।

চ) আমার আশঙ্কা একইভাবে আমার বর্তমান স্বামী মোস্তফা হোসেন মন্টুকেও গ্রেফতার করে একইভাবে ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারের নামে হত্যা করার ষড়যন্ত্র চলছে।

ছ) সবশেষে আমার চারটি সন্তান আমি তাদের নিয়ে যাতে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকতে পারি সবার কাছে সে সহযোগিতাই কামনা করি। আল্লাহ সবার সহায় হোন।

তারপর সংবাদিকরা তাকে ছেঁকে ধরে। তাদের প্রশ্ন : আপনার বক্তব্য থেকে আমরা বুঝতে পারি এসব ঘটনার পেছনে প্রভাবশালী একজনের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ইন্ধন রয়েছে। তিনি কে?

টিয়ার বোবা ভাষা ভাষান্তরিত করে শুনিয়ে দিই, তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী ও ক্ষমতাশালী মানুষ। তার নাম প্রকাশ্যে এনে নিজেদের জীবনের আর ঝুঁকি নিতে চাই না। আমি একজন স্বামী হারিয়ে বিধবা হয়েছি, তিন বাচ্চা এতিম হয়েছে এখন মন্টু সাহেবের কিছু হলে আমি পুনরায় বিধবা হব এবং চারটি বাচ্চা এতিম হবে।

নেতার পত্রিকার সহকারী সম্পাদকই এবার নেতার নাম উল্লেখ করে বললেন, আপনি কি তার কথা বলছেন?

টিয়া নিশ্চুপ থাকে?

তাকে নিশ্চুপ দেখে একজন সাংবাদিক বলেন, বোবারা সাধারণত কালা হয়ে থাকে। তিনি হয়তো আপনার প্রশ্ন শোনেনইনি।

আমাকে বলতেই হয়, আপনার ধারণা সঠিক নয়। শত বোবার মধ্যে দশজনও কালা হন না। আমার স্ত্রী আপনার প্রশ্ন শুনেছে এবং এ প্রশ্নে মৌনতা অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্য একজন সাংবাদিক বললেন, মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ। তার মানে আপনি স্বীকার করছেন উচ্চারিত নামটিই সেই খুনি।

তখনই ছোট প্যাকেটে হালকা নাশতা বিতরণ শুরু হয়ে যায়। মন্টু ও টিয়াও দুই প্যাকেট পায়। মন্টু ও টিয়া নিরাপদেই বাসায় পৌঁছে। কিন্তু মনে তাদের প্রশ্ন রয়ে যায় এই সংবাদ সম্মেলনের অর্থ কে ব্যয় করল।

মন্টু প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদককে জিজ্ঞেস করে, আমার তো এত টাকা নেই, তবু কত খরচ করেছেন, তাকে বলেন, দিয়ে দেব।

তিনি বললেন, আমাদের কোনো খরচ হয়নি। চিন্তা করবেন না।

খাবার?

খাবারও আকাশ থেকে পড়েছে। চিন্তা করবেন না, যিনি এসব করেছেন নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবেন।

বাসায় ঢোকার সময় চোখ পড়ল গেটবরাবর রিকশায় এক বুড়ো বসে আছেন। মন্টু একটু এগিয়ে যায় এবং বলে, বাবা তুমি? তুমি কখন এসেছো? এখানে কী করছো?

ঘণ্টাখানেক হবে। তোর কি কোনো বিপদ হয়েছে? বলে তিনি এক শ টাকার একটি বান্ডিল দিয়ে বললেন, দশ হাজার আছে, রেখে দে বিপদে কাজে লাগবে। তারপর তিনি রিকশাওয়ালাকে বললেন চালাও।

বাবা নামো।

নামল না।

পরদিন স্থানীয় এবং রাজধানীর পত্রিকায়ও সংবাদ বেরোল সন্দেহের তীর নেতার দিকে। তার নামধাম এবং ছবিও ছাপা হয়েছে। এমনকি নেতার পত্রিকায়ও। এ যেন হঠাৎ স্লুইস গেট খুলে গেছে। ঢাকার একটি পত্রিকা নেতা ও স্বজনদের দুষ্কর্মের ফর্দ ছেপে দিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্ত দিয়ে এমনকি প্রশাসন এবং পুলিশের কর্মকর্তারাও কথা বলতে শুরু করেছেন। নেতার গৃহকর্মীদের একজনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। ডাক্তার বলেছেন, স্বাভাবিক মৃত্যু কিন্তু জনতার একটি পক্ষ বলছে, না, খুন করা হয়েছে। খুনের বদলে খুন চাই। তার বাড়ি ঘেরাও ও আক্রান্ত হয়। তিনি পিস্তল হাতে নিয়ে বন্ধ দরজার আড়ালে বসে ছিলেন। ভিতরে থাকা একজন শুভানুধ্যায়ী পরামর্শ দিয়েছেন, পিস্তল ব্যবহার করলে এখান থেকে জীবন্ত বেরোতে পারবেন না। তিনি ওসিকে ফোন করেছেন। ওসি বলেছেন, স্যার আমি তো বদলির অপেক্ষায় বসে আছি। আমাকে সরিয়ে যাকে আনতে চেয়েছেন সে আসতে চাচ্ছে না, উল্টো আপনি যে ডিওটা লিখেছেন ফটোকপি আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। বুঝতে পারছেন স্যার, আমার তো কাজে মন বসছে না।

তিনি বললেন, এবার বিনয়ের সঙ্গে, ওসি সাহেব ওরা তো আমাকে মেরে ফেলবে আমাকে বাঁচান ভাই, আমি ভুল করে ফেলেছি, এবার ঢাকা গিয়ে আমার চিঠিটা প্রত্যাহার করে নেব।

এক দফা ভাঙচুর ও লুটপাটের পর পুলিশ পৌঁছল। সেকেন্ড অফিসার জিজ্ঞেস করল, আপনার পারসোনাল সিকিউরিটি ফোর্স কোথায়? আপনার টর্চার সেলের সৈনিকরা কোথায়?

এর মধ্যে দ্রুততার সঙ্গে নেতার বিরুদ্ধে তার বাড়িতে নিহত গৃহকর্মী খুনের মামলা নিয়ে নিলেন কোতোয়ালির ওসি। এত দুঃসাহস! গত অল্প দিনের খবর হচ্ছে একই দলে তার নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করা তরুণ এক নেতার আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে। তিনি পলিটিক্যাল সেক্রেটারির খাস লোকদের একজন হয়ে উঠেছেন। আগামী সাধারণ নির্বাচনে নমিনেশনও প্রায় নিশ্চিত। সুতরাং কোরআন শপথ করে আনুগত্য প্রকাশ করা তার রাজনৈতিক ও লাঠিয়াল প্রিয়জনেরা একই দলে শিবির পাল্টাতে শুরু করেছে, ওসি হয়তো তার আগমনের পথই মসৃণ করে তুলছেন। সম্ভবত এ কারণেই তিনি চেষ্টা করেও ওসিকে বদলি করাতে পারেননি, তার অগোচরে বেড়ে ওঠা নিজ দলীয় প্রতিপক্ষ সম্ভবত তার অনুরোধ নিষ্ক্রিয় করতে ভূমিকা রেখেছেন।

দশ.

সে রাতে ওসি এলেন কাজী মসিউজ্জামান আকন্দের বিধবা স্ত্রী এবং তার বর্তমান স্বামী মোস্তফা হোসেন মন্টুর সঙ্গে দেখা করতে। সহযোগিতার জন্য মন্টু তাকে ধন্যবাদ দিল এবং প্রেস ক্লাব যাওয়ার পথে সাদা পোশাকের হস্তক্ষেপের কারণেই যে গন্তব্যে পৌঁছতে পেরেছিল সে কথাও জানাল।

[চলবে]

সর্বশেষ খবর