শুক্রবার, ২২ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

হারানো বিজ্ঞপ্তি

ইকবাল খন্দকার

হারানো বিজ্ঞপ্তি

গল্প

রতন এই এলাকার সুপরিচিত ঘোষক। মাইক্রোফোনের সঙ্গে বহু বছরের সখ্য তার। মৃত্যু সংবাদ, হারানো বিজ্ঞপ্তি, মঞ্চ-নাটকের খবর, খেলার খবর, ওয়াজ মাহফিলের খবর, নির্বাচনি প্রচারণা- একসময় কোনোটাই বাদ দিতে পারতো না সে। রিকশায় বসে ‘ভাইসব’ ‘ভাইসব’ বলে প্রচার করতে হতো গ্রাম থেকে গ্রামে। তবে আগের সেই ব্যস্ততা নেই রতনের। সব ব্যস্ততা চলে এসেছে আসমতের কাছে। অথচ এই কাজের বিশেষ কোনো প্রস্তুতি বা প্রশিক্ষণ নেই তার। একদিন রতনের অনুপস্থিতিতে মাইক্রোফোন ধরেছিল। মিনিটখানেক কথা বলেছিল। তারপর ইউনিয়ন চেয়ারম্যানসহ অনেকের পক্ষ থেকে প্রশংসা আর প্রশংসা।

এলাকাবাসীর কাছে আসমত এখন তারকা। সে যখন মাইকিং করতে করতে রিকশা দিয়ে যায়, তখন গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে রাস্তার দুই পাশের মানুষ। যারা ঘরের ভেতর থাকে, তারা বেরিয়ে আসে তাকে দেখার জন্য। তার এই তারকাখ্যাতিতে হতাশ হয়ে রতন এখন ঘোষণার কাজে স্থায়ী ইস্তফা দিতে চাচ্ছে। আর ঝুঁকতে চাচ্ছে কৃষিকাজের দিকে। আসমতের মাসিক রোজগার ঈর্ষণীয়। তবে তার সংসারে খরচও কম না। বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানের বিশাল পরিবার হলে যা হয়। সে নয় সদস্যের এই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাই টানাটানির মধ্য দিয়েই সংসার চালাতে হয় তাকে।

আপাতত সংসারের টানাটানি দূর করার জন্য মূল পেশার পাশাপাশি অন্য একটা পেশায় যুক্ত হতে চায় আসমত। হতে পারে সেটা ছোট কোনো ব্যবসা। কিন্তু পুঁজি পাবে কোথায়? তার কাছে তো জমানো টাকা নেই। হতাশার ব্যাপার হলো, এখন গরমের মৌসুম। এই মৌসুমে ওয়াজ, নাটক, কনসার্ট হয় না বললেই চলে। তাই আয়-রোজগারও কম। আসমত একটা হারানো বিজ্ঞপ্তির প্রচার শেষে বাড়ি ফিরছিল। এমন সময় রতনের সঙ্গে দেখা। সে ধরে নেয়, দুজনের মধ্যে কথাবার্তা হবে না। যেহেতু রতন আজকাল তাকে দেখলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। আসমতের ভাবনা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে কথা বলে ওঠে রতন। জানায়- আলাপ আছে।

আসমতকে নিয়ে একটু নিরিবিলি জায়গায় যায় রতন। বলে- আমি জানতে পেরেছি, তোর কিছু টাকার দরকার। আমার হাতে যদি দেওয়ার মতো টাকা থাকতো, তাহলে অবশ্যই দিতাম। তবে একটা রাস্তা দেখাতে পারি। এই রাস্তা ধরে এগোতে পারলে তোর আর কারও কাছে হাত পাততে হবে না। উল্টো তুইই মানুষকে ধার দিতে পারবি। তো আমি তোকে যে রাস্তাটার কথা বলছি, সেটা খুব সোজা। তুই যে কাজ করিস, সেই কাজের সঙ্গেই রিলেটেড। আমার যদি এখন আগের ডিমান্ডটা থাকতো মানে তুই যদি আমার জায়গাটা দখল করে না নিতি, তাহলে তোকে পরামর্শ দিতে আসতাম না। যা করার নিজেই করতাম।

আসমত রতনকে রহস্য করতে মানা করে। বলে যা বলার পরিষ্কার করে বলতে। সে ডানে-বামে তাকায়। তারপর বলে- আমি এমন একটা ব্যবস্থা করতে চাই, যাতে প্রতিদিনই তোর কাজ থাকে। প্রতিদিনই ইনকাম হয়। আরও ক্লিয়ার করে বললে, আমি তোকে প্রতিদিন এক বা একাধিক নিখোঁজ ব্যক্তির নাম-ঠিকানা দেবো। তুই প্রচার করবি। প্রতিটা প্রচারণার জন্য ১ হাজার টাকা করে পাবি। পাবি মানে, এখনই পাচ্ছিস। কারণ, আমি তোকে অ্যাডভান্স করবো।

বলতে বলতে আসমতের হাতে টাকার একটা বান্ডেল তুলে দেয় রতন। যদিও প্রথমে সে নিতে চায় না, তবু শেষ পর্যন্ত না নিয়ে পারে না। রতন বলে- তোর মনে অনেক প্রশ্ন, বুঝতে পারছি। সমস্যা নেই, প্রশ্ন করতে চাইলে পরে করিস। এখন না। আর আগামীকাল সকালে রেডি থাকিস। আমি একজনের নাম দেবো। ঠিকানা দেবো। আর প্রথম দিনের কাজ হিসেবে পারিশ্রমিকটাও একটু বেশি পাবি। এমনিতে পাঁচ শ-এক হাজার পাস না? প্রথম দিন হিসেবে আগামীকাল দুই হাজার পাবি।

পরদিন সন্ধ্যা। মাইকিং শেষ করে বাড়ি ফেরে আসমত। এর একটু পরেই তার কাছে আসে রতন। জানতে চায় মাইকিং কেমন হলো। আসমত উত্তর দেয় না। সে জানতে চায় যার নামে মাইকিং হলো, তার পরিচয় কী। ঠিকানাই বা কী। রতন বলে- তোর এত কিছু জেনে লাভ আছে? তুই কাজ করেছিস, টাকা পাবি। আর ‘ঠিকানা কী’ মানে? ঠিকানা তো জানিসই। কাগজে লিখে দিলাম না? মাইকিংয়ে যেটা তুই বলে এলি।

আসমত বলে- কিন্তু আমি তো শুধু ‘পুবপাড়া নিবাসী’ বলেছি। যেহেতু কাগজে এইটুকু ঠিকানাই লেখা ছিল। অথচ আমাদের গ্রামের পুবপাড়ায় আবদুল হামিদ নামে কেউ নেই। তার মানে এটা অন্য কোনো গ্রামের পুবপাড়া, অন্য কোনো পুবপাড়ার আবদুল হামিদ। তোর কাছে আমার অনুরোধ, ওই আবদুল হামিদের পরিবারের যে কারো সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে।

পরে কথা বলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নেয় রতন। তারপর রাত পোহাতে না পোহাতেই আবার এসে হাজির হয় সে। আর আসমতকে ধরিয়ে দেয় নতুন কাগজের টুকরো। সে টুকরোটায় চোখ বুলায়। দেখে নিখোঁজ ব্যক্তির নাম লেখা ‘আবদুল গণি’। আর লেখা ‘পুবপাড়া নিবাসী’। আসমত প্রশ্ন করতে চায়। কিন্তু এর আগেই রতন বলে- তুই কী জিজ্ঞেস করবি, আমি জানি। এই জন্য উত্তরটা দিয়ে দিচ্ছি। আবদুল হামিদ এবং আবদুল গণি আপন ভাই। অতএব বিষয়টা পরিষ্কার, দুইজনের বাবা একই ব্যক্তি। আর সেই ব্যক্তিটার ব্যাপারেই তোকে সতর্ক থাকতে হবে। অর্থাৎ কিছু বুঝতে দেওয়া যাবে না।

          আসমত সন্দেহ আর অবিশ্বাসের চোখে তাকায় রতনের দিকে। রতন তবু স্বাভাবিকই রাখে নিজেকে। বলে- আবদুল হামিদদের আরও তিনটা ভাই আছে। তাদের সবার নামেই মাইকিং করতে হবে। কবে কারটা যাবে, সেটা আমি তোকে বলবো। আর টাকা যা দিয়েছি বা দেবো, এটাই কিন্তু শেষ না। তুই যদি আরও চাস, দেওয়া যাবে।

রতনের কথায় অপার এক রহস্যের গন্ধ পায় আসমত। তবু সে বিস্ময় প্রকাশ করে না। কিছু জানতে চায় না। বরং খুব স্বাভাবিক কথাবার্তা বলে বিদায় দেয় রতনকে। তারপর রওনা হয়ে যায় পুবপাড়ার উদ্দেশ্যে। সে এখন আবদুল হামিদদের বাবার খোঁজ করবে। তার সঙ্গে একান্তে কয়েক মিনিট কথা বলবে যে কোনো উপায়ে। সে আশাবাদী, এই কয়েক মিনিটেই সেই অপার রহস্যের জট খুলে যাবে। আর সামনে চলে আসবে ওইসব উত্তর, যেগুলো তার জানা জরুরি।

এরপর আসমত আশপাশের বিভিন্ন গ্রামের মোট আটটা পুবপাড়া খুঁজে বের করে। কিন্তু এমন কাউকে পায় না, যাকে মানুষ আবদুল হামিদ বা আবদুল গণির বাবা হিসেবে চেনে। সে তবু খোঁজাখুঁজি থামায় না। গ্রামের পর গ্রাম চষতে থাকে। অবশেষে তার পরিশ্রম সার্থকতা পায়। সে খোঁজ পেয়ে যায় বৃদ্ধ লায়েস খোনকারের। যার বয়স প্রায় এক শ বছর। যাকে মানুষ চেনে এবং ডাকে ‘হামিদের বাপ’ বলে।

আসমত লায়েস খোনকারের বাড়ির সীমানায় প্রবেশ করতেই এগিয়ে আসে টগবগে এক যুবক। যার বয়স পঁচিশের এদিক-ওদিক। সে সালাম দেয়। আসমত জবাব দিয়ে প্রশ্ন করতে চায় লায়েস খোনকার সম্পর্কে। কিন্তু এর আগেই যুবক বলে- আপনি একা এসেছেন নাকি? রতন ভাই আসেনি? কিন্তু মা তো উনাকে খুঁজেছিলেন। জরুরি কী দরকার নাকি আছে।

: আপনি কি আমাকে চেনেন? কিছুটা বিস্মিত হয়েই প্রশ্নটা করে আসমত।

: কেন চিনবো না? আপনাকে চেনে না, এলাকায় এমন কোনো লোক আছে?

: লায়েস খোনকার সাহেব আপনার কী হয়?

: নানা। আপন নানা। আর আবদুল হামিদ, আবদুল গণি উনারা আমার মামা। যদিও দেখিনি কোনোদিন। শুধু তাদের গল্প শুনেছি।

: দেখবেন না কেন? নিখোঁজ হওয়ার আগে কি উনারা বাড়িতে থাকতেন না? নাকি আপনার আসা-যাওয়া ছিল না?

: আসা-যাওয়া থাকবে না কেন? আসা-যাওয়া না থাকলে নানাকে দেখতো কে? নানা তো আমাদের ওপরই পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলেন।

: ‘আমাদের’ বলতে?

: আমার আর আমার মার ওপর। উনার যখন দরকার হতো, তখনই আমরা চলে আসতাম। আর উনাকেও আমাদের বাড়িতে নিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম। তারপর উনি যখন অ্যাবনরমাল হয়ে গেলেন, তখন জোরাজুরি করেও কোথাও নেওয়া যেত না। এই জন্য আমি আর মা এখানে এসে থাকতে শুরু করলাম।

: আপনার মা এখন কোথায়?

: সম্ভবত ঘরেই আছে। চলেন আমার সাথে।

যুবক হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু আসমত হাঁটে না। কারণ, তার সন্দেহ এখন আরও বেশি ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। আর মনে প্রশ্ন আসছে ঝাঁক বেঁধে। সে যুবককে থামায়। মনে ঝাঁক বেঁধে আসা প্রশ্ন থেকে কয়েকটি প্রশ্ন করে। কিন্তু যুবক উত্তর দেয় না। এরপর প্রশ্নের সংখ্যা বাড়তে থাকলে সে বলে- আপনি কী বলতে চাচ্ছেন বা কী জানতে চাচ্ছেন, আমি বুঝতে পেরেছি। এই জন্য মার সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার। উনিই আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন। ইচ্ছে করলে আমিও দিতে পারি। তবু মা দিলে ভালো হয়।

যুবক আবার হাঁটে। হাঁটে আসমতও। কিন্তু কয়েক কদম এগোতে না এগোতেই সে বলে- আপনার মার সঙ্গে কথা বলার আগে পুরো ব্যাপারটা সম্পর্কে আমার একটা ধারণা পাওয়া দরকার। আর ধারণাটা আপনি দেবেন। প্লিজ, দেন। এটা আমার অনুরোধ। একসঙ্গে আপনার পাঁচ পাঁচজন মামা নিখোঁজ হয়ে গেলেন অথচ আপনারা পুলিশে খবর না দিয়ে মাইকিং করাচ্ছেন। হাজার হাজার টাকা খরচ করছেন। নাহ্, ব্যাপারটা আমার কাছে কোনো অ্যাঙ্গেল থেকেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।

: স্বাভাবিক কীভাবে মনে হবে? ব্যাপারটা তো স্বাভাবিক না।

: প্লিজ, আর রহস্য বাড়াবেন না। আমাকে একটু খুলে বলেন। আপনার মামারা সত্যিই নিখোঁজ হয়েছে তো? নাকি এখানে অন্য কোনো ঘটনা আছে?

যুবক চারপাশে তাকায়। দেখে কাছে-কিনারে কেউ আছে কি না। তারপর বলে- আমার যদিও বলার অনুমতি নেই। তবু বলি। কারণ, না বললে যে আপনি আমাকে ছাড়বেন না, সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। আমার মামারা নিখোঁজ হয়েছেন, এটা অবশ্যই সত্য। কিন্তু এর জন্য থানায় যাবো, পুলিশের কাছে অভিযোগ করবো, সেই সুযোগ নেই। কারণ, তারা নিখোঁজ হয়েছেন পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় আগে।

আসমত আঁৎকে ওঠে। সে নিশ্চিত হতে চায়, যা শুনেছে ঠিক শুনেছে কি না। যুবক বলে- আপনি হয়তো বিশ্বাস করতে পারছেন না। তবে এটাই সত্য, মামারা নিখোঁজ হয়েছেন পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় আগে। নানা তখন সুস্থ-স্বাভাবিক। তার চোখের সামনে দিয়েই তার পাঁচ ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেলো। এরপর কত মানুষ ফিরে এলো! মামারা আর ফিরে এলেন না।

: কিন্তু মাইকিং...

: নানা এখন স্বাভাবিক নেই। আরও পরিষ্কার করে বললে, গত প্রায় দুই বছর ধরে উনি পাগল হয়ে গেছেন। একদিকে বয়সের ভার, অন্যদিকে ছেলেদের শোক। এই অবস্থায় একটা মানুষ পাগল হয়ে যাবে, এটাই তো স্বাভাবিক।

: কিন্তু মাইকিংয়ের ব্যাপারটা?

: নানা একদিন মাকে বললেন তার ছেলেরা নাকি বাড়ি চিনছে না। এই জন্য ফিরে আসতে পারছে না। যদি ভালোভাবে হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা যায়, তাহলে চলে আসবে। মা কথাগুলো আমলে নেননি। কিন্তু যখন দেখলেন নানার শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা শুধু খারাপের দিকেই যাচ্ছে, আর উনি হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রচারের জন্য চাপ দিয়েই যাচ্ছেন, তখন মা রতন ভাইয়ের সঙ্গে একটা চুক্তিতে গেলেন। আমি মনে করি, মা কাজটা খুব ভালো করেছেন। আপনি বিশ্বাস করবেন না, আপনার প্রথম দিনের মাইকিং শুনে নানা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন।

আসমত কিছু বলতে চায়। কিন্তু বিস্ময় তাকে বলতে দেয় না। বলে চলে কেবল যুবক- নানা মাকে বলেছিলেন ভালো-মন্দ যেন রান্না করা হয়। কারণ, তার হারানো ছেলেরা ফিরে আসবে। মাইকিংটা কানে গেলেই ফিরে আসবে। উনি মাকে ঘরগুলো রেডি রাখতে বলেছিলেন। আবার নিজে গিয়েও বিছানার চাদর ঠিক করছিলেন। জানালায়, দরজার সাইডে যেসব মাকড়ের জাল লেগে ছিল, সেগুলো পরিষ্কার করছিলেন।

: কিন্তু একটা সময় যখন উনি বুঝে যাবেন উনার ছেলেরা ফিরবেই না, তখন?

আসমতের প্রশ্নের উত্তর দিতে চায় যুবক। এমন সময় তার মা এসে দাঁড়ান পেছনে। তাই সে মাথা নিচু করে ফেলে। তিনি আসমতকে ঘরে নিয়ে যান। আর তৈরি হয়ে বসেন সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য।

সর্বশেষ খবর