শুক্রবার, ২২ মার্চ, ২০২৪ ০০:০০ টা

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

আন্দালিব রাশদী

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

পর্ব-১৬

পূর্ব প্রকাশের পর

 

মন্টু বলল, ওসি স্যার, আমার মনে হচ্ছে প্রেস ক্লাবের আয়োজন- পেছনের ব্যাকড্রপ, মাইক, খানাপিনা এসবের আয়োজন আপনি করেছেন। অনেক টাকা খরচ করেছেন। কত টাকা জানতে পারলে কিছুটাও যদি পরিশোধ করতে পারতাম ঋণের ভারটা কমত।

ওসি বলেন, কী যে বলেন। ওটা তো খুবই সামান্য। আপনি আমাকে আর স্যার বলবেন না, আমি আপনাকে স্যার বলার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আপনাদের অসিলায় নেতাকে শুইয়ে দিতে পেরেছি আমি এতেই সন্তুষ্ট। তিনি আমাকে খাগড়াছড়ি বদলি করার হুমকি দিয়েছিলেন, এখানে আনতে চেয়েছিলেন তার দূর সম্পর্কের এক শালাকে। শালাই প্রথম তাকে বিট্রে করে হেড অফিসকে বলে দেয় যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি নেতার পার্টির ভিতরের খবর জেনে গেছি, এটাই তার শেষ বছর, অবশ্যই যদি এলাকায় ফিরে আসতে পারে। পার্টি নতুন ক্যান্ডিডেটের খোঁজে আছে। এই এলাকার একজন প্রবাসী ব্যবসায়ীকে আশ্বাস দিয়ে নমিনেশনের নামে সমানে ছিলে যাচ্ছে। তার ক্যাশ ফুরাতে সময় লাগবে না। এটা তো আর ব্যাংক লুট করা টাকা নয়, তারটা ব্যবসায়ের, পরিশ্রমের। একসময় দেশ ছেড়ে কামাই করার দেশে চলে যাবে, কাজেই মাঠ খালি। আমি অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম পার্টিরও লাভ, সরকারেরও লাভ যদি ভালো ইমেজের একজন নির্বাচিত হয়। নির্বাচন কেমনে হয় সেটা আপনিও জানেন আমিও জানি। মন্টু ভাই যদি রাজি থাকেন সামনের নির্বাচনে আপনাকে সরকারি দলের এমপি বানিয়ে তবে এখান থেকে বদলি হই। ততদিনে আমার পোস্টিংয়ের একটা টার্মও পুরো হবে। এ পর্যন্ত কোথাও টার্ম পুরো করতে পারিনি।

ওসি স্যার, আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না। আপনি আমার সঙ্গে মশকরা করছেন? আমি ধরে রেখেছি কয়েক দিনের মধ্যে আমার হাতকড়া পরবে, আপনারা আমাকে রিমান্ডে নেবেন, কোথাও পিটিয়ে মেরে ফেলবেন। তারপর শহররক্ষা বাঁধের ওপারে কোথাও ফেলে রেখে আসার আগে হৃৎপি- বরাবর একটা গুলি করবেন। পরে বলবেন ক্রসফায়ারে চলে গেছে, পকেটে দু-একটা গুলিও তখন পাওয়া গেছে। আমি কাজী মশিউজ্জামান আকন্দের বিরুদ্ধে রঙ্গ থিয়েটারের ইলেকশন করলেও আমি তার ভক্ত ছিলাম। তিনি ভালো মানুষ ছিলেন।

তিনি যে ভালো মানুষ ছিলেন সেটা জানি বলেই ব্যাকড্রপে লেখা হয় শহীদ। ভালো মানুষের একটা আদর্শ থাকে। আপনি সেই আদর্শই বাস্তবায়ন করবেন।

টিয়া চা আর চিড়া ভাজা এনে দেয়।

ওসি দুই মুঠো চিড়া খান, চা-টা শেষ করতে করতে বলেন, নেতার গরম ডিম খাওয়ার সময় এসে গেছে, এবার নাটকটা নামান। কত লাগবে একটা ধারণা দেবেন। টাকার ব্যবস্থা দুই দিনের মধ্যেই করে দেব। নেতার চরিত্রটা যেন পাকা কোনো অভিনেতা পান এটা একটু খেয়াল রাখবেন।

 ***

সে রাতে ভালো ঘুম হয়নি। রাত দেড়টা কি দুটো হবে তার ঘ্রাণেন্দ্রিয় হঠাৎ সচকিত হয়ে ওঠে। অনেক দিন আগের একটা গন্ধ নাকে লাগে। খুব পরিচিত। আবুল বাশার মিরধা এটাকেই বলত দুম্বার মূত্রের গন্ধ।

মন্টু বিছানা ছেড়ে ওঠে, গন্ধের উৎস সন্ধান করে। বাড়ির গেটের বাইরে থেকে আসছে। গেট খুলে দেখে দেয়ালে ঠেস দেওয়া চাদর গায়ে একজন আপন মনে ফুঁকে চলেছে।

এগিয়ে গিয়ে দেখল এবং বলল, মঞ্জু তুই! এখানে কী করিস।

বাবা বলল, তোকে নাকি কেউ মেরে ফেলতে পারে, আমি পাহারা দিচ্ছি।

তোর পাহারা দিতে হবে না। ঘরে আয়, শুয়ে ঘুম দে। জায়গা আছে।

মঞ্জু বলে, আই অ্যাম অন ডিউটি। আমার কাজটা আমাকে করতে দে।

মন্টু বলল, দাঁড়া আসছি।

কিন্তু ফিরতে প্রায় পনেরো মিনিট লেগে গেল। অনেক খুঁজতে হয়েছে। বিয়ের পরদিন গভীর রাতে দরজায় টোকা দিয়ে মঞ্জু যখন ঢুকল টিয়াকে দিল শাড়ি, বাচ্চাদের টাকা আর তাকে দিয়েছিল এক পুরিয়া গাঁজা। মন্টু এটা স্যুটকেসের পকেটে রেখে দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত পেয়েছে এবং মঞ্জুর হাতে তুলে দিয়ে বলে, গঞ্জিকার এই পুরিয়াটাও সেবন করিস।

মঞ্জু বলল, মন্টু তুই এসব ধরেছিস! ঠিক করিসনি।

মন্টু মনে করিয়ে দিল, নারে এটা তুই-ই আমাকে দিয়েছিলি, মনে করে দেখ।

***

পরদিন স্থানীয় পত্রিকায় একটির শীর্ষ সংবাদ রাতের অন্ধকারে নেতার পলায়ন। অন্যটিতে লেখা হয় : ক্রসফায়ারে নয়, নেতার নির্দেশে কাজী মশিউজ্জামান আকন্দকে হত্যা করা হয়। নেতার বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, প্রতারণাসহ অন্তত এক ডজন ফৌজদারি মামলা হচ্ছে। একটি পত্রিকা পার্টির মহাসচিবের মন্তব্য পেয়েছে। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, ব্যক্তির দুষ্কর্মের দায় পার্টি কখনো গ্রহণ করবে না, আইন তার নিজ গতিতে চলবে।

দুটো পত্রিকা প্রথম পৃষ্ঠায় ডাবল কলামে মোস্তফা হোসেন মন্টুর ছবি ছেপেছে এবং এও লিখেছে, নেতার পলায়ন নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

যে খবরটি পত্রিকায় ছাপা হয়নি তা হচ্ছে, মশিউজ্জামানের বোন নাসিমা জামানও পক্ষাঘাত আক্রান্ত শয্যাশায়ী স্বামীকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়েছেন, তার বাড়িতে ডাবল তালা। পাশাপাশি বাড়ি সে বাড়ির কাজের বুয়া টিয়ার কাছে জানতে এসেছে তারা কোথায় গিয়েছেন? টিয়ার কোনো ধারণা নেই।

ঢাকার একটি কম সার্কুলেশনের পত্রিকা উল্লেখ করেছে নেতা একজন অজ্ঞাত নারীসহ পালানোর সময় শহরের শেষ প্রান্তে তার দলীয় লোকদের হাতেই ধরা পড়েন। তাদের অরক্ষিত রেখে পলায়নের জন্য তারা তাকে গালমন্দ করেন এবং তার একদা অনুগত বিশ্বস্ত এক কর্মী তার চোয়ালে ঘুসি মারেন এবং শার্ট ধরে হেঁচকা টান দিলে কয়েকটি বোতাম ছিঁড়ে যায়। তারা তাকে বহন করা গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং তার সঙ্গী নারীকে তারা যৌনকর্মী বিবেচনা করে আটকে রাখে। সবশেষে তারাই পলায়নপর নেতাকে কোরবানির গরু পরিবহনকারী একটি ট্রাকে তুলে দেয়। তিনি অনুরোধ করেন, তোমরা রেশমাকেও তুলে দাও। এক দফা সম্ভোগের পর ভোরের দিকে তারা একটি চাল পরিবহনকারী ট্রাকে রেশমাকে তুলে দেয়।

স্থানীয় একটি পত্রিকার সম্পাদকীয় শিরোনাম : জেলায় রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। অন্যটির সম্পাদকীয় : স্বৈরাচারের স্বাভাবিক পরিণতি পলায়ন। নেতার আশপাশে থাকা মামলার দন্ডিত অপরাধীরা দ্রুত নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। নেতার সেকেন্ড ইন কমান্ড পাসপোর্টে ইন্ডিয়া এবং থাইল্যান্ডের ভিসা করিয়ে রেখেছিলেন। তিনি রাতে পালাননি। পরদিন বলে কয়েই আজমির শরিফে ধর্মীয় সফরে রওনা হলেন। বিস্ময়কর একটা ব্যাপার ঘটল সরকারি দলের কোনো ফ্রন্টের সদস্যই সেদিন সামান্য চাঁদাবাজিও করেনি।

***

নেতার বাড়িতে আবারও লুটতরাজ চলছে জানার পর এবার ওসি দ্রুতই ব্যবস্থা নিলেন। এক গাড়ি পুলিশ পাঠালেন, একজন ইন্সপেক্টরকে অবশিষ্ট মালামালের ইনভেন্ট্রি করতে বললেন।

ঘণ্টা তিনেক ধরে ইনভেন্ট্রি চলল। ভাঙা আসবাবপত্রের একটি স্টোর রুমে চোখ পড়ল একটি মেরুন রঙের চালু ড্রিপ ফ্রিজের ওপর। এটা তো নষ্ট মালামালের স্টোর রুম। ফ্রিজ তাহলে চালু কেন। ভাঙা চেয়ার সরিয়ে ফ্রিজের কাছে গিয়ে ইন্সপেক্টর ডালা তুললেন এবং নিজেই চেঁচিয়ে উঠলেন ওহ মাই গড! এ কী দেখছি! এটা কার কাটামু-ু?

এগার.

পরবর্তী পাঁচ বছরে আমার বাবা শওকত হোসেনের চার তলা বাড়ি প্রান্তিক-এ যেসব ঘটনা ঘটেছে তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি তুলে ধরছি :

মঞ্জু ভাইয়ের রুমের দরজা আর খোলা থাকে না। কখনো তালাবন্ধ কিংবা কখনো ভিতর থেকে ছিটকিনি বন্ধ। ঘরের ভিতরটা খুব পরিপাটি এবং সাজানো গোছানো। ভিতরে একটা ওয়্যারড্রব ও একটা ড্রেসিং টেবিল ঢুকেছে। মঞ্জু ভাই তিন নম্বর রুমটারও দখল নিয়ে নিয়েছে, ভিতরে বইয়ের আলমারি, দুটো হারমোনিয়াম তবলা এক সেট ডেস্কটপ কম্পিউটার। বিছানা ঠেলে দেয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে সোফাসেটের একটি টু-সিটার এখানে ফিট করা হয়েছে। মধ্যরাতে দুম্বার মূত্রের গন্ধ হিসেবে পরিচিত হওয়া গন্ধটাও অনেক দিন আসছে না। এই অসম্ভব ঘটনটি ঘটিয়েছে চার তলার ইসমত আরা ফয়জুন্নেসা। এক রাতে ইসমত বাড়িতে ঝগড়া করে কিছু কাগজপত্র, নিজের গয়না আর টাকাপয়সা নিয়ে বেরিয়ে এসে মঞ্জু ভাইয়ের রুমে ঢুকে ভিতর থেকে ছিটকিনি লাগাল। গঞ্জিকার ঘোরে থাকা মঞ্জু ভাই বলল, আরে আরে, আপনি কী করছেন?

ইসমত আরা ফয়জুন্নেসা বলল, সারা জীবন মেয়েরা যে পুরুষের হাতে ধর্ষিত হয়েছে আমি তার প্রতিশোধ নেব। মঞ্জু আমি তোমাকে ধর্ষণ করব। মঞ্জু ভাই আসলেই ধর্ষিত হয়েছেন কি না, না এটা কেবল থ্রেট তা জানার চেষ্টা বিভিন্ন সময় চালানো হয়েছে। ফলাফল শূন্য। ইসমত আরা নিজেও মুখ খোলেনি। ইসমত সরকারি স্কুলে শিক্ষকতা পেয়েছে। হেডমাস্টার হয়ে যাবে দ্রুত।

বাবার চোখের সামনেই ইসমত আরাকে একদিন মঞ্জু ভাইয়ের রুমের তালা খুলতে দেখে বাবা চেঁচিয়ে ওঠে, এই মেয়ে তুমি কে? কী চাই? আমার ছেলের ঘরে ঢুকছো কেন? চাবি কোথায় পেলে?

ইসমত আরা বাবাকে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়াতেই সম্ভবত বলল, আপনার ছেলের ঘর কখনো তালা মারা থাকতে দেখেছেন? তালাও আমার চাবিও আমার। আমার তালা আমার চাবি দিয়ে খুলছি। আর কোনো সমস্যা আছে?

বাবা বললেন, ওহ আচ্ছা তোমার তালা তোমার চাবি। এর মানে কী?

বাবা তারপর সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। সম্ভবত আর অপদস্থ হতে চায়নি। বাবা ঘরে ঢুকে মাকে ডেকে কতক্ষণ ফিসফিস করল, বলল, একি অনাচার! এ তো কেয়ামতের আলামত! বিয়েশাদির খবর নেই এক ঘরে সোমত্ত নারী ও পুরুষ!

ওরা সত্যিই বিবাহিত কি না তা জানতে শেহেরজাদকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। শেহেরজাদ যথারীতি খটখট করে নিচে নেমে মঞ্জু ভাইয়ের ঘরের দরজায় নক করল। খুলল ইসমত আরা। মঞ্জু ভাই বিছানায়। শেহেরজাদ বলল, আজকে আমাকে ভালো কিছু খাওয়াতে হবে ওয়েডিং লাঞ্চ কিংবা ডিনার কিছু একটা। আমি একচুয়েলি বাবার এজেন্ট হিসেবে এসেছি। তোমরা যে বিয়ে করেছো তার একটা ডকুমেন্ট দেখাও।

মঞ্জু ভাই বলল, বেআদবি হয়ে যাচ্ছে মনে রাখিস।

ততক্ষণে ইসমত আরা ড্রয়ার থেকে একটা ফোল্ডার বের করে ফোল্ডারে নীল রঙের লিগ্যাল সাইজ কাগজের নিকাহনামা বের করে বলে, দেখো।

শেহেরজাদ বলল, আমি এটার ছবি তুলব, এ পাতা ও পাতা।

মঞ্জু ভাই বলল, তোল। আমাদের দুজনেরও একটা ছবি তোল। ইসমত আরা বিছানায় উঠে মঞ্জু ভাইকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেয়।

                [চলবে]

সর্বশেষ খবর