শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

মুখটা মনে করিয়ে দিলাম

হোসেন আবদুল মান্নান

মুখটা মনে করিয়ে দিলাম

এই পৃথিবীকে ছেড়ে যাবার মাত্র বিশদিন আগে ফেসবুকে অদ্ভুত একটা পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি। বিমানবন্দরে চেয়ারে বসে আছেন, হাতে পাসপোর্ট ও টিকিট। যদ্দুর জানা যায়, সেদিন তিনি ভারত থেকে ফিরেছিলেন। জানি না বার্তাটা তিনি আগেই পেয়ে গিয়েছিলেন কিনা। কেউ কেউ নাকি বুঝতে পারেন এবং দিব্যচোখে দেখতেও পারেন। নিজের ছবির নিচে লিখেছিলেন, “আমাকে যেন ভুলে না যাও, তাই একটা ছবি পোস্ট করে মুখটা মনে করিয়ে দিলাম”।

আধুনিক বাংলা গানের এক অনন্য সাধারণ সুরস্রষ্টা ও গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের কথা বলছি। তিনি ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। যিনি ছিলেন ‘৭১-এর রণাঙ্গনের একজন তারুণ্যদীপ্ত টগবগে অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধকালীন সময়ে একাধিকবার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েও অলৌকিক শক্তির অদৃশ্য ইংগিতে বেঁচে যান। বন্ধু, সহযোগী ও সহযোদ্ধাদের অনেকেই পাক আর্মির হাতে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। মনে হয় তিনি বেঁচে ছিলেন আমাদের সংগীতের ভুবনের রাজাধিরাজ হওয়ার জন্য।

২.

২০২৩ সালের ২২ জানুয়ারি তাঁর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রকাশিত হয় একটা বড় কলেবরের স্মারকগ্রন্থ। বাংলা সংগীতের কিংবদন্তি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল স্মারকগ্রন্থ। গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেছেন গাজী তানভীর আহমদ। লক্ষ করে দেখেছি, এতে বরেণ্য সংগীতজ্ঞসহ সমসাময়িক শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনের অন্তত ৭৭ জন বুদ্ধা ব্যক্তিত্ব তাঁকে নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং হাজারো প্রশংসাসূচক বাক্য রচনা করেছেন। বেশির ভাগই সুর ও সংগীতে তাঁর অভিনবত্ব ও মৌলিক প্রতিভার অন্বেষণ করেছেন। বছরখানিক আগে গ্রন্থটি আমার হাতে তুলে দিয়ে তানভীর বলেছিলেন, বুলবুলকে নিয়ে আমি যেন একটা লেখা দিই। বলেছিলাম, আমি তাঁকে চিনতাম না, কোনো দিন কথা হয়নি, তাছাড়া সংগীতের কিছু জানি না এটা কীভাবে সম্ভব?

সে নাছোরবান্দা, বললেন, আপনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডিসি ছিলেন, পারবেন।

ইতোমধ্যে স্মারকটির বেশ কিছু লেখা

পড়ে ফেলে ভাবছিলাম, তাই তো আমিও কিছু লিখতে পারি। কাকতালীয়ভাবে আমাকে আকৃষ্ট করে তিনটি বিষয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আজিমপুর কলোনি এবং ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুল। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক ছিলাম। সেখানকার পুরাতন কারাগারও পরিদর্শন করেছি। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল মুক্তিযুদ্ধের সময় ধরা পড়ে সেই কারাগারে বন্দিজীবন কাটান এবং অমানবিক নির্যাতনের শিকার হন। চাকরির সুবাদে অন্তত ২২ বছর

আমি সপরিবারে আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টারে বাস করেছি। বাবার চাকরির সুবাদে বুলবুল সাহেবেরও শৈশব-কৈশোর কাটে একই কলোনির অঙ্গনে। তিনি ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলের ছাত্রকালীন ১৫ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আমি কয়েক বছর একই স্কুলের গভর্নিং বডির সভাপতি ছিলাম। আশ্চর্য! আমি যেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের পদচিহ্ন অন্বেষণ করে চলেছি।

৩.

সংগীত আমার এক অপার এবং অপরিমেয় ভালো লাগার বিষয়। বিশেষ করে কাব্যময় বাণীসমৃদ্ধ হারানো দিনের বাংলা গান আমাকে প্রতিদিন যেমন সুখানুভূতি এনে দেয়, আনন্দ দেয়, চঞ্চল করে তুলে, তেমনি একই সঙ্গে ভাষার শৈল্পিক ব্যবহারের কৌশল শেখায়। প্রমিত উচ্চারণের বিশেষত্বের কথা তো বলাই বাহুল্য। একটা ভালো গান শুনতে চায়না এমন মানুষ পাওয়া দুস্কর। কণ্ঠের মাধুকরীতে বা সুর-তাল-লয় তথা যন্ত্রের সংযোজন যখন কোথাও ইন্দ্রধনুর লগন এনে দেয় তখন সকলেই হয়ে ওঠেন গানের ও সংগীতের মানুষ। তাকে শিল্পীর কণ্ঠ-ধ্বনিতে সতর্ক কান পেতে থাকতে হয়। এর জন্য সংগীতজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন হয় না।

 

গত কয়েক দশক ধরে বলতে পারি,

সে-ই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে একটানা বাংলা গান শুনে আসছি এক অদ্ভুত ঘোরলাগা নেশায় ও মায়ায় পড়ে। স্রষ্টাদের মধ্যে ওপার বাংলার কিংবদন্তি হেমন্ত মুখার্জি, মান্না দে, কিশোর কুমার, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল চৌধুরী আর সুরকারদের মধ্যে নচিকেতা ঘোষ, প্রভাস দে, সলিল চৌধুরী প্রমুখদের নাম বলতেই হয়। এর বাইরেও অসংখ্য নাম সুরের আকাশে ঝলমল করে জ্বলে আছে।

বাংলাদেশে ৫০ ও ৬০ দশকের পরে

স্বাধীনতা উত্তরকালে যে ক’জন সুরকার মৌলিকত্ব নিয়ে বিকশিত হয়ে উঠেন তারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের ফসল বলে বিবেচিত। বলা যায়, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মাসুদ করিম, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সত্য সাহা, আলাউদ্দিন আলীদের পরে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল এবং লাকী আখন্দ তাঁরা সম্পূর্ণ আলাদা প্রতিভাদ্বয়। কাকতালীয় বিষয় যে, লাকী এবং বুলবুল উভয়ই ১৯৫৬ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রয়াতও হন কাছাকাছি সময়ে। যথাক্রমে ২০১৭ এবং ২০১৯ সালে।

৪.

আলোচ্য স্মারকগ্রন্থটিতে প্রায় সবাই আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের

লেখা এবং সুর করা গানগুলো নিয়ে বিশদ আলোকপাত করেছেন। কারণ তাঁরা প্রত্যেকই নিজে শিল্পী, গীতিকার, সুরকার বা চলচ্চিত্র পরিচালনায় অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব।

আমি এতটা নিবিড় অভিনিবেশ নিয়ে মামুলি কথার ওপর অভাবনীয় সুর লাগানোর কঠিন সূত্রে যেতে চাই না। সেদিকে যাবার কোনো সামর্থও আমার নেই। তবুও একটু বলতে চাই, অকাল প্রয়াত গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবুর কথায়, বুলবুলের অসাধারণ সুর ও কোকিলকণ্ঠী খ্যাত সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘সব ক’টা জানালা খুলে দাও না, আমি গাইবো গাইবো বিজয়েরই গান, ওঁরা আসবে, চুপি চুপি...’

বাঙালির দেশাত্মবোধক সংগীত বিবেচনায় এটা তাঁকে অমরত্ব দান করেছে। গানটিতে গীতিকার প্রিয়জন হারানোর বেদনার নির্জনতা, নিঃস্বতা ও হাহাকারকে যে বিমূর্ত চিত্রকল্পে উপস্থাপন করেছেন, সুরকার যেন তারও একধাপ এগিয়ে গিয়ে সেই শহীদকে জীবিতদের চোখে মূর্তিমান করে তুলেছেন। তা ছাড়াও তাঁর ‘একাত্তরের মা জননী কোথায় তোমার মুক্তিসেনার দল,’ সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’ বা নজরুল ইসলাম বাবুর আরও একটি গান’ ও আমার আট কোটি ফুল’ বা মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের কথায় ‘সেই রেল লাইনের ধারে’ গানগুলো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ব্যতীত কেউ এমনভাবে তুলে ধরতে পারত কিনা এ বিষয়ে আমার অনেক সংশয় আছে।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল দেশের চলচ্চিত্রের জন্য কাজ করেছেন।

বলা হয়, চলচ্চিত্রের দুঃসময়ে, খরার কালে তিনি যেন এক কলকলে স্রোতস্বিনী হয়ে আবির্ভূত হয়ে ছিলেন। সংগীত পরিচালনা করে অসম্ভব সুনামও কুড়িয়েছেন। মনে পড়ে, তিনি বিখ্যাত হয়েছেন আমাদের ছাত্রাবস্থায় অর্থাৎ ৮০ দশকের গোড়াতেই। সে সময়ের বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘নয়নের আলো’র সব-কটি গানই তাঁর নিজের রচনা ও সুরারোপিত হলে তারুণ্যের ক্যাম্পাস

জনপ্রিয়তায় তুঙ্গস্পর্শী হয়ে ওঠেন। বলাবাহুল্য, মুভিটার একজন প্রধান অভিনেত্রী এবং গানগুলোর একজন শিল্পী তখন ক্যাম্পাসেরই মুখ ছিলেন। ফলে নান্দনিক সুরের নিপুণ কারিগর

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলও রাতারাতি পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন। তিনি তার সবটুকু উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন বুকের মাঝে চেপে ধরা গিটারের তারে।

৫.

মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আরও একটা অসাধারণ কাজ

করেছিলেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিঃশঙ্ক চিত্তে সাক্ষ্য দেন তিনি। ২০১২ সালে ৫৭ বছর বয়সে তিনি যে বলিষ্ঠতায় ও সাহসিকতায় তাঁর দীর্ঘ লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন মানুষের এক জীবনে তা-ও এক বিরলতম ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় অহংকারের জায়গা।

৬.

বুলবুল তাঁর গতিময় ও গীতিময় জীবনের পথে কয়েকবার হোঁটচ খান। প্রথমে ছোট্ট শিশুসন্তান রেখে স্ত্রীকে হারিয়ে নিঃসঙ্গতায় পড়ে যান। বলা যায়, তখন থেকেই তাঁর ছন্দ পতন হতে থাকে। তাঁর ধারাবাহিক সৃষ্টিশীলতায় চলে আসে এক অচেনা স্থবিরতা। শেষ দিকে এসে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে নানা হুমকির মুখে পতিত হয়েছিলেন। একই সঙ্গে ঘটনার যোগসূত্রে ছোটভাই মিরাজ আহমেদকে হারিয়ে তিনি অনেকটা গৃহবন্দি হয়ে পড়েছিলেন। যা সংগীতের মতো বোহেমিয়ান চরিত্রাধিকারী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে তাঁর নিত্য সৃজনশীলতায় মারাত্মকভাবে বাধা দেয়। একাকীত্বের মাঝেই ভেতর থেকে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকেন তিনি। বোধকরি, তাঁর এ ভাঙন রোধ করা গেল না কোনো ক্রমেই।

 

তবে একটা বিষয় আমাকে প্রায়শই পীড়িত করে, ব্যথিত করে তা হলো- আমাদের শিল্পী সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী বা নিবেদিতপ্রাণ মানুষগুলো কেন এঁদের জীবদ্দশায় যথাযথভাবে মূল্যায়িত হন না! এঁরা কী কখনো সামাজিকভাবে বা আর্থিকভাবে মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে ছিলেন? অকালে চলে যাওয়া নজরুল ইসলাম বাবু, লাকী আখন্দ, আইয়ুব বাচ্চু, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আজম খান, আলাউদ্দিন আলী, এন্ড্রু কিশোর বেঁচে থাকতে এঁরা কেমন ছিলেন? মৃত্যুর পরে শতাধিক মানুষ লেখার তুলিতে স্মৃতির অদৃশ্য সৌধ গড়ে তোলেন। আবার বেঁচে থাকতে বিচ্ছেদের দুর্গম পাহাড়ে সম্পর্কটা ঢাকা পড়ে থাকে। এমনটা কেন হয়? এর শেষ কোথায়?

 

                লেখক : গল্পকার ও কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর