শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

আন্দালিব রাশদী

মন্টু ও মঞ্জু বৃত্তান্ত

শেহেরজাদের মোবাইল ফোনের ক্যামেরা ছবি তুলে নেয়।

ইসমত আরা বিছানা থেকে নেমে এসে তাকে দুটো পাঁচ শ’ টাকার নোট দিয়ে বলে ঘুষ দিলাম, কোনো ঝামেলায় ফেলো না কিন্তু।

কাবিন সম্পাদনের তারিখ ঘেঁটে দেখা গেল মঞ্জু ভাই বিয়ের ব্যাপারে মন্টু ভাইয়েরও সিনিয়র। মন্টু ভাইয়ের তিন মাস আগে বিয়ে করেছে।

তাহলে নিউজটা ব্রেক করলে না কেন?

ইসমত বলল, তোমার ভাই গাঁজা খাওয়া ছাড়েনি বলে আসিনি। যখন বুঝতে পারলাম পয়সার অভাবেই হোক কি আমাকে পাওয়ার জন্যই হোক গাঁজা ছেড়েছে, আমি ভাবলাম যাই দেখে আসি।

বাবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছ কেন?

ইসমত বলল, একটা ডেমনস্ট্রেশন দিলাম যাতে আমার শ্বশুর বুঝতে পারেন যে মঞ্জু কড়া মেয়ের হাতে পড়েছে। শোনো তাহলে ভালো হয়েছে, সন্ধ্যা ৭টার দিকে নেমে এসো, আমরা তিনজন একটা হোটেলে তন্দুরি ডিনার করব।

শেহেরজাদ বলল, যাব যদি তিনজনের জন্য তিন প্যাকেট এক্সট্রা ডিনার কিনে দাও।

ইসমত বলল, নো প্রবলেম।

সে রাতে সাড়ে ৯টার দিকে শেহেরজাদ এক প্যাকেট আমাকে দিল, দুই প্যাকেট বাবা ও মাকে। মা বলল, মঞ্জু ঠিকই করেছে। যমজ হলেও মঞ্জুই তো আগে হয়েছে, সাতাশ মিনিট পর মন্টু। আগে বিয়ে করে বাড়িতে বড়র মর্যাদাটা রক্ষা করেছে।

ততদিনে ইসমতের মা-বাবা আমাদের চারতলা ছেড়ে নিজেদের বাড়িতে উঠেছেন। চারতলায় নতুন ভাড়াটে এসেছে।

তিনতলায় যে দুটি পরিবার থাকত, তাদের একটি দম্পতির ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে অনেক দিন। পুরুষটি নেই, মহিলাটি যেহেতু চাকরিজীবী ভাড়া দিয়ে যাচ্ছে। তিনতলায় আমাদের কেয়ারটেকার আবুল বাশার মিরধার আনাগোনা বাবাকে সন্দিহান করে তোলে। বাবা যখন তার তিনতলায় ওঠার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সুরাইয়া নামে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়া নারী একই ধরনের লিগ্যাল পেপারে ছাপা নিকাহনামা বের করে বাবাকে দেখায়। অন্তত সাত মাস আগে আবুল বাশার আর তার বিয়ে ইসলাম ধর্মমতে আরও বেশি পরিমাণ অর্থাৎ চার লাখ এক টাকার কাবিনে সুসম্পন্ন হয়েছে। এই বিবাহ দলিল বাবাকে আরও খেপিয়ে তোলে। আবুল বাশারকে চাকরিচ্যুত করেন এবং তিনতলার পরিবারকেই বাসা ছাড়ার নোটিস দেন। বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটে সমীকরণে বাড়িওয়ালার মর্যাদা আর বাড়িওয়ালা ও দারোয়ানের সমীকরণে বাড়িওয়ালার মর্যাদা বাবার কাছে কখনো এক হতে পারে না। তিনতলার নতুন ভাড়াটে উঠলেও বাবার মানসিক যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে দিতে আমাদের ঠিক উল্টো দিকের বিল্ডিংয়ের দোতলায় অর্থাৎ আমাদের ফ্লোরের সমান্তরাল ফ্ল্যাটে আবুল বাশার ও সুরাইয়া ওঠে। আবুল বাশার মিরধার এ উত্তরণ বাবাকে প্রায় গৃহবন্দি করে ফেলে। আগে জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকাত। পাছে বাশার দম্পতির চোখে পড়ে যায় এ আতঙ্কে জানালার ওপর পুরনো পর্দা লগিয়ে দেয়।

দেড় বছর আগে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মা মারা যায়।

মন্টু ভাইকে এড়াতে তোব গায়ে গলায় আরবি গামছা ঝুলিয়ে বাবা বাসা থেকে বেরিয়ে ছিল। মা মারা যাওয়ার পর বাবা সারা বছরই তবলিগ দলের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। দীনের দাওয়াত দেয়।

মঞ্জু ভাই যমজ ছেলের বাবা হন। নাম ক্যাস্টর আর পলিটিউক্স, গ্রিক পুরাণের দুই যমজ। একতলার পুরোটাই এখন তার দখলে। অধিকাংশ সময় আমি বাড়িতে একাই। শেহেরজাদ একটা মজার খবর দিল। বাড়ির গেটের একপাশে একটা নেমপ্লেট লেগেছে, তাতে লেখা ড. মেহরাব হোসেন মঞ্জু, সিনিয়র কনটেন্ট রাইটার। কিন্তু ডক্টর কোত্থেকে এলো? শেহেরজাদ বলল, ইসমত ভাবিই ডক্টরেট হতে বলেছে। মঞ্জু ভাই পুরনো ল্যাপটপে অনলাইনে দু-একটা পাস দিয়েছে, এটা আমরা জানতাম। এখন পিএইচ.ডি। ওটা অনারারি না তো?

মঞ্জু ভাই বলল, অনারারিটাতে লাখ তিনেক টাকা লেগে যায়। সেজন্যই তেইশ হাজার সাত শ’ পঞ্চাশ টাকা খরচ করে জেনুইনটাই জোগাড় করেছে। বাংলাদেশে অনেকেরই আছে। শিগগিরই একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করতে যাচ্ছি, ওখানে ডক্টরেটের গুরুত্ব কিছু আছে। আমি ভেবেছিলাম জীবনটা তো বেশ কাটিয়ে দিচ্ছি, ইসমত সব লন্ডভন্ড করে দিল। মঞ্জু ভাই আজকাল স্যুট পরে, টাই বাঁধে। বাচ্চাদের জন্য টুইন প্যারাম্বুলেটর কিনেছে।

মা মারা যাওয়ার একুশ দিন পর শম্পা বাচ্চা নিয়ে এসেছিল। দুই সপ্তাহ থেকে চলে গেছে। আমার জন্য এটাওটা তো এনেছে, একটা রিমোটচালিত ছোট হুইলচেয়ারও এনেছে। আমার সমস্যাটা অ্যাকোনড্রোপ্লাসিয়া, সুন্দর বাংলায় আমি একজন অসমানুপাতিক বামন। মাথাটা তুলনামূলকভাবে বড়, পা দুটো বাইরের দিকে ধনুকের মতো বাঁকা। আমি নিজের কাজগুলো যেমন দাঁত মজা, বাথরুমে যাওয়া, নিজেকে ওয়াশ করা এগুলো ভালোই পারি। শেহেরজাদ আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট। আমার রোগটা জেনেটিক কিন্তু বাবা বা মা কেউই মনে করতে পারলেন না তাদের এমন কোনো আত্মীয়ের কথা। আমি পৌনে চার ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়েছিলাম। পায়ের হাড় বাঁকা হতে থাকায় উচ্চতা আবার কমতে থাকে। কী সব পরীক্ষা করে হাড়ের ডাক্তার বলেছেন পায়ের হাড় ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে, যে কোনো সময় সামান্যতেই ভেঙে যেতে পারে। সেজন্য হুইল চেয়ারই আমার জন্য উত্তম। মাঝে মাঝে শ্বাসকষ্ট হয়। ঠান্ডা লাগতে দিই না। শেহেরজাদ যেখানেই থাকুক একটা ভালো কিছু হাতে পেলেও অর্ধেকটা আমাকে দেয়।

বাবা থাকলে মঞ্জু ভাই আর ভাবি দোতলায় আসে না। আমি তাদের বলতে শুনেছি কয়েক বছরের মধ্যে এদিকটায় ডেভেলপার আসবে, তখন চারতলা গুঁড়িয়ে দশতলা করবে, বাড়ির নাম প্রান্তিকই থাকবে, ততদিনে বাবার মৃত্যু হবে, মন্টু ভাইকে এ বাড়িতে ফিরিয়ে আনবে আর আমি তো আছিই।

সর্বশেষ খবর : শম্পা আমেরিকার কোনো একটা ইউনিভার্সিটিতে শেহেরজাদের অ্যাডমিশন করিয়েছে। ভিসা হয়ে যাবে, সেপ্টেম্বরে দেশ ছাড়বে। শেহেরজাদ শম্পার মতোই মেধাবী, শম্পা বলে তার চেয়েও বেশি।

মশিউজ্জামান লজের খবরও ভালো। এখনো ক্রসফায়ারে মন্টু ভাইয়ের মৃত্যু হয়নি। মন্টু ভাই নিজেই বলেছে, পুলিশ ভালো হয়ে গেছে। মন্টু ভাই ও টিয়া ভাবি পুত্রসন্তানের জন্য কোনো এক মাজারে বড় কিছু একটা মানত করেছে, কিন্তু তাদের মেয়ে হয়েছে। নাম রেখেছে কোকিলা। আমার তো আর যাওয়ার আর দেখার সুযোগ নেই কিন্তু শুনেছি শহরের দেয়ালে মন্টু ভাইকে নিয়ে পোস্টার পড়েছে তার বড় ছবির নিচে লেখা, মোস্তফা হোসেন মন্টুকে এমপি হিসেবে দেখতে চাই। আর একটাতে লেখা : মন্টু ভাই এগিয়ে চলো আমরা আছি তোমার সঙ্গে।

তারা কারা? যারা পোস্টার লাগিয়েছে তাদের দাবি তারা : জেলার সচেতন জনগণ।

মন্টু ভাই এখন মাসে এক দুবার প্রান্তিকে আসে, একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করল তুই কী মনে করিস?

কোনটা?

মন্টুকে এমপি হিসেবে দেখতে চাই।

আমি বলি, দেশে কি চোরের সংখ্যা কমে গেছে নাকি? নতুবা তোমাকে কেন। বাসায় ফোন আসে আজমির শরিফ থেকে একজন বললেন শওকত হোসেন সাহেব আমাদের সঙ্গেই ছিলেন, কিন্তু তিন দিন ধরে আমরা তাকে খুঁজে পাচ্ছি না।

ফোন ধরার জন্যই তো আমি আছি। আমি আর কী বলব, বললাম ভালো করে খুঁজে দেখুন। পেয়ে যাবেন।

কিন্তু আমার মন বলছে বাবার দিন শেষ হয়ে গেছে, তাকে আর পাওয়া যাবে না।   [সমাপ্ত]

সর্বশেষ খবর