শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা

সিভিল সার্ভিসের লেখকগণ

হোসেন আবদুল মান্নান

সিভিল সার্ভিসের লেখকগণ

লেখালেখির এই সুবিশাল ভুবনে হয়তো আরও অনেক কীর্তিমান নীরবে-নিভৃতে কাজ করে চলেছেন। যাঁরা প্রচারবিমুখ অন্তরালে আছেন। বাস্তবতা হলো, লেখাজোঁকার কাজটি অপরিমেয় ধৈর্য,  সহনশীলতা ও গভীর সংবেদনশীলতার বিষয়। অনেকে নিজের ক্যারিয়ারকে পর্যন্ত জলাঞ্জলি দিয়েছেন এ মায়াবী ঘোরে এবং নেশায় পড়ে।

সিভিল সার্ভেন্ট লেখক, কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার বা স্মৃতিগ্রন্থ রচয়িতাদের কিছু সংখ্যক ঝলমলে উজ্জ্বল নাম বাংলাভাষা ও সাহিত্যে স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছে। এঁরা আমাদের কথাসাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতির নানা শাখায় নিরলস কাজ করে বাংলাভাষার সুদীর্ঘ পথ চলাকে মসৃণ, গতিময় এবং ছন্দময় করে গেছেন। প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তাঁদের হাতের শাণিত কলম থেকে কখনো কখনো বের হয়ে এসেছে অগ্নিঝরা অক্ষরের মিছিল। সৃষ্টি হয়েছে কালজয়ী গদ্য, অবিস্মরণীয় পদাবলী বা সুখপাঠ্য জীবনস্মৃতির বিস্তৃত

তথ্য-ভান্ডার। যা মাতৃভাষা, মাতৃভূমি ও মানবতাকে অনেকাংশে গৌরবান্বিত ও মহিমান্বিত করেছে। শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে এঁদের কেউ কেউ অন্য নামে, উপনামে, ছদ্মনামে গল্প উপন্যাস কবিতা ছড়া রচনা করে গিয়েছেন। তাঁরা নিজের কালের ইতিহাসের স্রোতধারাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছেন কালো হরফের শক্তিশালী পরিবৃত্তে। এঁদের বেশির ভাগই দায়িত্ব নিয়ে, ঝুঁকি নিয়ে জন্মভূমির মাটি ও মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। বিবেকের দায় থেকে লিখে গেছেন আমৃত্যু। স্বদেশ স্বজাতির কাছে লেখাই যেন এঁদের নির্ভার করে দিয়েছে। কখনো বা অকুতোভয় সাহসী হয়ে দেশপ্রেমের আদর্শিক রেখাচিত্র তুলে ধরতে হাতে কলম নিয়েছেন। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাপ্তরিক পদ-পদবির চেয়ে এই লেখালেখিই এঁদের পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত করে রেখেছে। যুগোত্তীর্ণ গবেষকের মর্যাদা দিয়েছে, বিখ্যাত করেছে বা অমরত্ব দান করেছে। উল্লেখ্য, এই মহামহীমদের মধ্যে তাঁরা কেউ আইসিএস, বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের সদস্য আবার কেউ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, সিএসপি, ইপিসিএস, সহকারী ম্যাজিস্ট্রেট, অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ইত্যাদি নানা পদে চাকরি করেছেন। এঁদের মধ্যে কয়েকজন স্বনামধন্য কলমযোদ্ধাকে তুলে ধরা হলো।

২.

‘দুর্গেশনন্দিনী’ এবং বাংলা সাহিত্যের সার্থক ঔপন্যাসিক খ্যাত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪)। কথাসাহিত্যিক হিসেবে যিনি প্রাতঃস্মরণীয় এবং আজও খ্যাতির শিখরে আরোহণকারী।

ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যোগদানকারী প্রথম বাঙালি লেখক সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪২-১৯২৩)। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ তিনি। নারীমুক্তি ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে তাঁর অসংখ্য রচনা শতাব্দী কালব্যাপী পাঠক নন্দিত হয়েছে।

‘আমরা এমনি এসে ভেসে যাই’ বা ‘ঐ মহা সিন্ধুর ওপার থেকে কি সংগীত ভেসে আসে’ গানের গীতিকবি ডি.এল. রায় (দিজেন্দ্রলাল রায় ১৮৬৩-১৯১৩)। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নানা জায়গায় তাঁর সরব বিচরণ ছিল। সংগীত, নাটক ও কাব্যে অতুলনীয় ছিলেন এ ক্ষণজন্মা প্রতিভা।

পাখিসব করে রব রাতি পোহাইল বা

সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, বা

লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে,

ইত্যাদির কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কা (১৮১৭-১৮৫৮)।

এই বিস্ময়কর প্রতিভার

জীবনকাল ছিল মাত্র ৪১ বছরের। কলেরায় মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

‘নব্বই পেরিয়ে’ বা ‘ভালোবাসার দেশ’ নামক গ্রন্থের লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় (১৯০৪-২০০২)। একজন মৌলিক বাঙালি চিন্তাবিদ ও প্রতিভাবান কবি ও লেখক। ভারতের উড়িষ্যায় জন্ম। ১৯২৭ সালের আইসিএস ছিলেন।

৩.

একই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সার্ভিস ও পূর্ব পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের মধ্যে কবিতা গল্প উপন্যাস বা ভ্রমণ কাহিনি ও আত্মকথা লিখনের মাধ্যমে বেশ ক’জন বাংলা ভাষার সাহিত্যাকাশে দীপ্তিমান তারকা হয়ে আছেন। এমনকি সাহিত্য কর্মে অবদানের জন্য কেউ কেউ একাধিক রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও পেয়েছেন। তাঁদের অন্যতম বাংলা কবিতার বৃহত্তম মাইলফলক সৃষ্টিকারী ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি’র আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, আবুল মাল আবদুল মুহিত, ফারুক চৌধুরী, কবি সানাউল হক, পারস্য প্রতিভার লেখক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, লালসালু’র সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, লেখক ও গল্পকার মিরজা আবদুল হাই, কাজী ফজলুর রহমান, স্মৃতি কথায় পি এ নাজির, ‘আপন ভুবন অচেনা আকাশ’র লেখক মোফাজ্জল করিম, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক কবি মনজুর ই মওলা, মনযুর-উল করিম (কবি ইমরান নূর), মোহাম্মদ শওকত আলী, কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক আকবর আলি খান, লেখক ও শিক্ষাবিদ মীজানুর রহমান শেলী, গোলাপ ও সংগীত বিশেষজ্ঞ আবদুশ শাকুর, কামাল সিদ্দিকী, দারিদ্র রেখা’র কবি তারাপদ রায়, মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক এস এ সামাদ, সিরাজউদ্দীন আহমেদ, আজিজুর রহমান আজিজ, শহীদ আকন্দ প্রমুখ। এ ছাড়াও সমসাময়িককালে চাকরিজীবী লেখকদের মধ্যে গাজী শামছুর রহমান, আবুল খায়ের মুসলেহ উদ্দিন, সূর্য দীঘল বাড়ির লেখক আবু ইসহাক, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব জামিল, কারার মাহমুদুল হাসান ‘অন্য এক ভুবন’র লেখক কবি আবুল হোসেনের নাম উল্লেখযোগ্য।

৪.

বাংলাদেশ প্রজন্মের সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাদের মধ্যে

কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, ছড়া ও আত্মজীবনী লিখে কেউ কেউ আলোচিত হয়েছেন। এমনকি নিয়মিত পত্রপত্রিকায় উপস্থিতি এবং যাঁদের প্রকাশিত একাধিক গ্রন্থ রয়েছে। যা বইপাড়ায় সহজলভ্য। এমন কতিপয় বরণ্যের মধ্যে লেখক ও অনুবাদক আমিনুল ইসলাম ভুইয়া, কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহির, কবি আবু করিম, আলী ইমাম মজুমদার, গোলাম মোস্তাকীম, সত্তর দশকের অন্যতম কবি কামাল চৌধুরী, বহুমাত্রিক লেখক ও অনুবাদক আন্দালিব রাশদী, কবি মোহাম্মদ সাদিক, মুহাম্মদ আবদুল মজিদ, ভুঁইয়া শফিকুল ইসলাম, কবি আসাদ মান্নান, কাবিদুল ইসলাম, কবি মঞ্জুরুর রহমান, আবদুল আউয়াল মজুমদার, শেখ আবদুর রশীদ, হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, কবি শফিক আলম মেহেদি, আফরোজা পারভীন, হোসেন আবদুল মান্নান, রাজীব সরকার, মইনুল ইসলাম, আলকামা সিদ্দিকী, ছড়াকার ফারুক হোসেন, গোলাম শফিক, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, নূরউদ্দিন জাহাঙ্গীর, আবু হেনা মোরশেদ জামান, শেখ ইউসুফ হারুন, হাসনাত লোকমান, জাকির জাফরান, সাহিদা সুলতানা, সালমা তানজিয়া,  মোহাম্মদ আলী খান প্রমুখ।

৫.

লেখালেখির এই সুবিশাল  ভুবনে হয়তো আরও অনেক কীর্তিমান নীরবে-নিভৃতে কাজ করে চলেছেন। যাঁরা প্রচারবিমুখ অন্তরালে আছেন। বাস্তবতা হলো, লেখাজোঁকার কাজটি অপরিমেয় ধৈর্য, সহনশীলতা ও গভীর সংবেদনশীলতার বিষয়। অনেকে নিজের ক্যারিয়ারকে পর্যন্ত জলাঞ্জলি দিয়েছেন এ মায়াবী ঘোরে এবং নেশায় পড়ে। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের বিবেচনায় বারবার তাচ্ছিল্যের তকমা পেয়েছেন। শুনেছি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান পাওয়া কর্মকর্তাকে আমাদের একজন মন্ত্রী বলেছিলেন, এসব কবি-টবি দিয়ে এ মিনিস্ট্রি চলবে না। তবুও লেখাই জীবন লেখাকেই বেঁচে থাকার অন্যতম এক অবলম্বন করেছেন অনেক সিভিল সার্ভেন্ট। চাকরির প্রারম্ভিককালে দু-একজন সচিবকে কাছে থেকে দেখেছিলাম। তাঁরা রাত অবধি অফিসে বসে লিখেছেন। আবার অফিস থেকে বের হয়ে ছাপাখানার অল্প আলোর অস্বাস্থ্যকর কক্ষে বসে গভীর অভিনিবেশে নিজের লেখার প্রুফ দেখেছেন। প্রকাশিতব্য বইয়ের প্রচ্ছদ, গেটআপ নিয়ে দুশ্চিন্তায় থেকেছেন। প্রায় মধ্যরাতে অবসন্ন চোখে বাড়ি ফিরেছেন। পরিবার পরিজন সময় পায়নি। একটা বিষয় না বললেই নয়, লেখক সিভিল সার্ভেন্টগণকে সচরাচর দুর্নীতিগ্রস্ততার অতল গহব্বরে হারিয়ে যেতে শুনিনি। তুলনামূলকভাবে তাঁদের দেশপ্রেমবোধ ও জীবনবোধ প্রবল হয়। আমার জানা এবং শোনার সীমাহীন সীমাবদ্ধতা আছে বলেই একটি মাত্র নিবন্ধে হয়তো সবাইকে আনা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে প্রশাসনিক সার্ভিসের মতোন স্পর্শকাতর দায়িত্ব পালন করে এবং সামান্য সময় ও সুযোগকে কাজে লাগিয়ে যাঁরা নিরন্তর রচনা করে গেছেন অসংখ্য গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনি, ডায়েরি বা কাব্যগাথা উত্তর প্রজন্মের একজন অকৃতি পাঠক হিসেবে তাঁদের প্রতি আমার অনিঃশেষ ভালোবাসা এবং প্রগাঢ় শ্রদ্ধাঞ্জলি।

 

লেখক : সাবেক সচিব, গল্পকার ও কলামিস্ট।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর