শুক্রবার, ১০ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

দ্রোহ ও প্রেমের কবি নজরুল

নঈম নিজাম

দ্রোহ ও প্রেমের কবি নজরুল

পূর্ব প্রকাশের পর

ভবিষ্যৎ নিয়ে বিবাদে নজরুলের মন খারাপ হলো। ঝগড়া-বিবাদের নীরব অভিমানে মাঝরাতে কবি মুরাদনগর ছাড়লেন। হয়নি নবদম্পতির ফুলের বাসর।

কাঁটার ঘায়ে জর্জরিত কবিকে ঠাঁই দিলেন কুমিল্লা শহরের বিরজা দেবী। কবি পেলেন মায়ের স্নেহ। ৩০ মাইল হেঁটে আসা নজরুল ছিলেন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। তাঁর মন ভেঙে গেছে। শরীরের অবস্থা ভালো ছিল না। বিরজা দেবীর বাড়িতে ছিলেন অনেক দিন। তারপর বিয়ে করলেন বিরজা দেবীর ভাশুরের মেয়ে প্রমীলা সেনগুপ্তকে। বিয়ের পর নজরুল তাঁর নাম দিলেন আশালতা। হিন্দুু-মুসলিম বিয়ে এত সহজ ছিল না। এ নিয়েও কটাক্ষ শুনতে হয়েছিল।

অন্যদিকে বাসরঘর করতে না পারা সৈয়দা খাতুন অনেক বছর নজরুলের প্রতীক্ষায় ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁদের মিলন হয়নি। আরেকজন কবিকে বিয়ে করে সংসার গড়েছিলেন সৈয়দা খাতুন। তাঁর শেষ জীবনটা ইংল্যান্ডে কেটেছিল। সৈয়দা খাতুনের দুই সন্তান ব্রিটেনে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বড় অবস্থান গড়েছিলেন। মৃত্যুর পর সৈয়দা খাতুনের দাফন ব্রিটেনে হয়।

প্রেম ও বিরহের কবির জীবনে আরও অনেক অধ্যায় আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রী ফজিলাতুন্নেছার একতরফা প্রেমে পড়েছিলেন নজরুল। এ প্রেমের বিষয়টি উঠে আসে কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে কবির চিঠি বিনিময়ে। মোতাহার হোসেনের বর্ধমান হাউসের বাড়িতে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। কবি নজরুল হাত দেখতে পারতেন -এমন একটা খবর ছিল ফজিলাতুন্নেছার কাছে। তিনি বর্ধমান হাউসে কবিকে তাঁর হাত দেখতে দিয়েছিলেন। কবি হাত দেখলেন। বললেন অনেক কথা। দুজনের কথোপকথনের পর প্রেমে পড়েন নজরুল। একটা ভয়াবহ ঘোর তৈরি হয় কবির মনের ভিতর। ১৯২৮ সালের কোনো এক রাতে ফজিলাতুন্নেছার দেওয়ানবাজারের বাড়িতে হাজির হন কবি। সরাসরি প্রেম নিবেদন করেন। এত রাতে এভাবে কবিকে দেখে অবাক হলেন ফজিলাতুন্নেছা। কবিকে প্রত্যাখ্যান করলেন। এ নিয়ে কবির জীবনে বড় আক্ষেপ ছিল। প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা ছিল। মোতাহার হোসেনকে লেখা চিঠিতে কবি সেসব কষ্টের কথা লিখতেন। ফজিলাতুন্নেছাকেও চিঠি লিখেছিলেন নজরুল। উত্তর পাননি। কবি সন্দেহ করতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন হিন্দুু শিক্ষকের সঙ্গে ফজিলাতুন্নেছার প্রেম ছিল। সে সন্দেহের কথাও তিনি লিখেছেন অনেক বেদনা নিয়ে।

কবির জীবনের আরেক অংশে ছিলেন প্রতিভা বসু। ‘জীবনের জলছবি’ গ্রন্থে প্রতিভা বসু লিখেছেন নজরুল ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে স্মৃতির কথা। আছে কলকাতা ও ঢাকার অনেক হারানো সুর। পুরান ঢাকার ওয়ারীতে বাস করতেন প্রতিভা বসুরা।

তখন তাঁর নাম ছিল রানু সোম। বাসায় তিনি গান শিখতেন। ওস্তাদ ছিলেন দিলীপ রায়। দিলীপ রায় নজরুলগীতিও শেখাতেন। নজরুলগীতি মুগ্ধ করত রানু সোমকে। এ সময় ঢাকায় আসেন কবি নজরুল। একদিন দিলীপ রায় নজরুলকে নিয়ে আসেন রানু সোমদের ওয়ারীর বাড়িতে। খাওয়াদাওয়া, আড্ডা হলো। এরপর কবি মাঝে মাঝে আসতেন এ বাড়িতে। ওয়ারীতে তখন বনেদি হিন্দু পরিবারের বাস ছিল। মহল্লার ছেলেরা দেখল ঝাঁকড়া চুলের লোকটি নিয়মিত এ বাড়িতে আসে। তারা সন্দেহ করল, এ বাড়ির মেয়ে রানুর সঙ্গে লোকটার সম্পর্ক আছে। একটা মুসলমান ছেলের সঙ্গে হিন্দু মেয়ের সম্পর্ক? আর যায় কোথায়। রানু সোমের বাড়িতে আসতে গিয়ে নজরুল আক্রমণের শিকার হলেন। ওয়ারীর হিন্দু যুবকরা নজরুলের ওপর হামলা করে রক্তাক্ত করল। এর অনেক দিন পর রেলস্টেশনে কবিকে দেখেন রানু সোম। তখন তিনি বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসু। কবির দিকে এগিয়ে যান। কবি তাকিয়ে থাকেন, চিনতে পারেন না। কারণ তিনি তখন নির্বাক জীবনে।

কবির আরেকটি প্রেমের কথা কলকাতার একটি পত্রিকা রসালোভাবে প্রকাশ করে। কানন দেবী নামে এক গায়িকাকে গান শেখাতেন কবি। অনেক সময় গান শেখাতে গিয়ে সেই বাড়িতে বেশি সময় থাকতেন। কখনো রাতের খাবার খেতে দেরি হতো। কবির এ আসা-যাওয়া সহ্য হলো না পাড়ার লোকদের, আশপাশের বন্ধুদের। তারা গসিপ ছড়াল। এমন আরও অনেক গল্পে কবি বিস্মিত হতেন। হতাশ হতেন। থামতেন না। প্রেমের কবি চলতেন আপন গতিতে।

প্রেম নিয়ে অচেনা কষ্ট কবির বুকে বাসা বাঁধত। ‘ব্যথার দান’ গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছেন, ‘মানসী আমার, মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে ক্ষমা করোনি, তাই বুকের কাঁটা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলুম।’ দহনে সিক্ত কবি লিখেছেন ভালোবাসার মানুষকে, ‘তুমি দেবী চিরশুদ্ধা তাপস কুমারী, তুমি মম পুজারিণী’। আবার দুঃখের দহনে লিখেছেন, ‘এরা দেবী, এরা লোভী যত পূজা পায় এরা চায় তত আরো! ইহাদের অতিলোভী মন একজনে তৃপ্ত নয়, এক পেয়ে সুখী নয়, যাচে বহু জন।’

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর বছর না যেতেই কবি নজরুল ১৯৪২ সালে অসুস্থ হন। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত নীরবে এক ধরনের কষ্টের জীবন অতিবাহিত করেন। এই সময়ে তাঁর চিকিৎসার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অর্থের সংকট ছিল। অসুস্থতায় ধীরে ধীরে ফুলের জলসায় নীরব কবি। কী কারণে কবি নজরুল বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন? এ নিয়ে বিতর্ক ব্রিটিশ শাসনকাল ১৯৪২ সাল থেকে। ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই কবি হঠাৎ কথা বলা বন্ধ করে দেন। বিশ্রাম ও চিকিৎসার জন্য ২০ জুলাই কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় বিহারের মধুপুরে। সবাই ভাবলেন কবি ঠিক হয়ে যাবেন। না, কবি ঠিক হননি। ফিরে আসেন কলকাতায়। এ নিয়ে কবির প্রিয়ভাজন সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দীন তাঁর আত্মকথায় নিউরো সার্জন ড. অশোক কুমার বাগচীর কথা লিখেছেন। আর ড. বাগচীর মতামত ছিল খোলামেলা। ড. বাগচীর মতে, নজরুলের অসুস্থতার লক্ষণ প্রথম যখন প্রকাশ পায় তখন বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বিশেষ করে তাঁর স্ত্রী প্রমীলার অসুস্থতার পর কবি কিছুদিন কালীসাধনা করেছেন। গেরুয়া পোশাক পরতেন আর মাথায় ছিল একই রঙের টুপি। কবির এ চালচলন, বেশভূষাকে অনেকেই ধরে নেন মানসিক বৈকল্য হিসেবে। সে সময় থেকেই কবির সুর-তাল ক্ষয়ে যেতে থাকে। গ্রামোফোন কোম্পানিতে গান গাওয়ার সময় তা প্রকাশও পেতে থাকে। কবি একটু-আধটু বেসুরো হতে থাকেন। অবশ্য ধরিয়ে দিলে সংশোধন হতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু পুরোপুরি অসুস্থ হওয়ার পর তিনি সবকিছুর বাইরে চলে যান। এই সময় চশমাধারী কোনো মানুষকে দেখলে খেপে যেতেন। উত্তেজিত হতেন। এ কারণে ড. অশোক বাগচীর ধারণা ছিল, কোনো চশমাধারী ব্যক্তি কবির বড় ধরনের ক্ষতি করেছিল, যা তার মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে দাগ কেটে যায়। ড. বাগচী বিখ্যাত চিকিৎসক বিধান চন্দ্র রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেছেন, ‘স্নায়বিক বৈকল্য’ মতটাই যথার্থ। ১৯৫৩ সালে ভিয়েনার বিশ্বখ্যাত চিকিৎসকরা স্নায়বিক বৈকল্য মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন। তাঁরা বললেন, ১৯৩৯ সাল থেকে কবির সঠিক চিকিৎসা হলে তিনি বাকরুদ্ধ থাকতেন না। ঠিকভাবে তাঁর চিকিৎসা হয়নি। শেষ পর্যন্ত ড. বাগচীরও একই মত। ভিয়েনার চিকিৎসকরা আরও বললেন, ১৯৫৩ সালে এসে নজরুল চিকিৎসাবিজ্ঞানের বাইরে চলে যান। তখন আর কিছু করার নেই চিকিৎসকদের। হাল ছেড়ে দিলেন তাঁরা।

১৯৫৩ সালে কবি নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য ইংল্যান্ড পাঠানো হয়। চিকিৎসা শেষে ফিরে এলেন। আর সুস্থ হয়ে উঠলেন না। বললেন না নতুন করে কাউকে ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণ-তূর্য’। তিনি আর উচ্চারণ করতে পারলেন না ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’। বললেন না বিধাতাকে, ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে। প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু নিরজনে’। কী এমন মানসিক দুঃখ ছিল যার কারণে কবি নজরুল ভেঙে হয়েছিলেন খানখান। চিরতরে তাঁকে পেয়ে বসে নীরবতা, নিস্তব্ধতা। অজানা কষ্ট নিয়ে কবি চিরতরে স্তব্ধ হলেন ১৯৭৬ সালে। চলে গেলেন চিরতরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশেই কবির ঠাঁই হয়েছে। সেখানে শুয়ে তিনি হয়তো শুনছেন আজানের ধ্বনি। হয়তো খুঁজছেন বুক চিড়ে ব্যথা জড়ানো সেই প্রিয়াকে।

কবি নজরুলের জš§ ইংরেজি ১৮৯৯ সালের ২৪ মে। বাংলায় সেই দিনটি ছিল ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬। পশ্চিমবঙ্গের আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে। নজরুলের দাদার নাম কাজী আমিন উল্লাহ। বাবা কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুনের তিনি ছিলেন ষষ্ঠ সন্তান।

নজরুলের ছোটবেলার নাম দুখু মিয়া। অল্প বয়সে তিনি মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে আজান দিতেন। মুসলিম পরিবারে জš§ নিলেও ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ছিলেন কট্টর। অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে আপসহীন। তিনি নারীর অধিকার নিয়েও স্পষ্টবাদী ছিলেন। ১৯০৮ সালে বাবার মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র নয় বছর। বাবার মৃত্যুতে সংসারে অভাব-অনটন পেয়ে বসে। শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয় কবির। বিভিন্ন পেশায় জড়িত হতে হয় কবিকে। তার পরও চেষ্টা করেন বিভিন্ন শিক্ষামাধ্যমে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে। তিনি রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল, মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলেও পড়াশোনা করেন। এ সময় বাংলার পাশাপাশি আরবি, ফারসি, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় তাঁর বিশাল দখল ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। তিনি বিভিন্ন ভাষায় বলতে, পড়তে ও লিখতে পারতেন। নজরুল তরুণ বয়সে লোকশিল্পে নাট্যদলে যোগ দেন। তিনি লেটো ও কবিগানের আসরে অংশ নিতেন। অল্প বয়সে গান ও নাটকে কবির পারদর্শিতা সবাইকে মুগ্ধ করত।

পেশাগত জীবনে কবিকে অনেক ধরনের কাজই করতে হয়েছিল। আর্থিক সংকটের কারণে কাজ করেছেন রুটি বানানোর দোকানে। খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা ছিলেন। রুটির দোকানে কাজ করার সময় পরিচয় আসানসোলের দারোগা রফিক উল্লাহর সঙ্গে। পুলিশের এই কর্মকর্তা বুঝতে পারলেন নজরুলের মেধা-মননের উচ্চতা। ময়মনসিংহের ত্রিশালে কবিকে নিয়ে গেলেন তিনি। ভর্তি করালেন দরিরামপুর স্কুলে। ১৯১৭ সালের শেষ দিকে মাধ্যমিক প্রিটেস্ট পরীক্ষা না দিয়েই যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। সৈনিক, করপোরাল থেকে হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। ফারসি ভাষার চর্চা তখনই হয়েছিল। করাচি সেনানিবাসে থাকার সময় লেখালেখি শুরু করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯২০ সালে নজরুলের সেনা ইউনিট ভেঙে দেওয়া হয়। চাকরিজীবন শেষ করে তিনি ফিরে যান কলকাতায়। এ সময় তিনি নিজের লেখাগুলো নিয়ে সাক্ষাৎ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। নজরুলের লেখার প্রশংসা করেন তাঁরা। এসব লেখা প্রকাশের জন্য অনুপ্রাণিত করেন। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর প্রথম জীবনের লেখাগুলো প্রকাশিত হয়েছিল। সে সময় কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে নজরুলের গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়।

নজরুলের আরেকজন বন্ধু ছিলেন শিল্পী আব্বাসউদ্দীন। একবার আব্বাসউদ্দীন কবি নজরুলের বাসায় গেলেন। গিয়ে দেখলেন নজরুল কী যেন লিখছেন। অনেকক্ষণ বসে থাকলেন আব্বাসউদ্দীন। তারপর নজরুল বললেন, তাড়া আছে কি তোমার? জবাবে আব্বাসউদ্দীন বললেন, তোমাকে অনেক খোঁজাখুঁজি করে পাচ্ছি না। তাই ছুটে এলাম। এখন জোহরের নামাজ পড়তে হবে। তারপর কথা বলব। আমি এসেছিলাম একটি গজল নিতে। নামাজ আদায়ের জন্য চাদর দিলেন আব্বাসউদ্দীনকে। দেখিয়ে দিলেন নামাজ পড়ার স্থান। নামাজ শেষ করলেন আব্বাসউদ্দীন। মোনাজাত শেষ করে নজরুলের কাছে আসতেই বললেন, ‘এই নাও তোমার গজল। তুমি নামাজ শেষ করতে করতে লেখাটা শেষ করলাম।’ সেই গজলটি হচ্ছে, ‘হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ/দিলাম তোমার চরণ তলে হƒদয় জায়নামাজ।’

প্রেম ও দ্রোহে নজরুলের কোনো তুলনা ছিল না। তাঁর এক হাতে ছিল বাঁশের বাঁশি, আরেক হাতে রণতূর্য। অজানা পথিকের সন্ধানে কবির দিন কাটত, রাত কাটত। আগলে রাখতেন নিজের কষ্টগুলো। কাউকে বুঝতে দিতেন না। তবে সবকিছুর প্রকাশ ঘটাতেন গানে, কবিতায়। সুরের ঝংকার তুলতেন নিজের অথবা অন্যের কণ্ঠে। চেষ্টা করতেন কাঠিন্যকে জয় করতে। তাই তো কারাগারকে পরিণত করেছিলেন সৃষ্টিশীলতায়। বেদনাকে দ্রোহে রূপান্তর করেন। বঞ্চনাকে ঠাঁই দেন হƒদয়ের গহিনে। আহা রে! যদি জানা যেত মানুষের প্রতি কতটা অভিমানে কবি বলেছিলেন, ‘সত্য হোক প্রিয়া, দীপালি জ্বলিয়া ছিল-গিয়াছে-গিয়াছে নিভিয়া!’ কতটা যন্ত্রণায় ‘ফুলের বুকে দোলে কাঁটার অভিমানের মালা/আমার কাঁটার ঘায়ে বোঝ আমার বুকের জ্বালা।’

কবি নজরুলের জীবনটা ছিল অদ্ভুত কষ্টের আঁধারে ঢাকা। তিনি ছিলেন চিরদুঃখী। ছোটবেলা থেকে কষ্টের সমুদ্রে সাঁতার কেটে তাঁর বেড়ে ওঠা। কবি নজরুল ১৯৩০ সালের ৭ মে পুত্র বুলবুলকে হারিয়ে দিশাহারা হয়ে যান। বসন্ত রোগের তখন চিকিৎসা ছিল না। কবিও ছিলেন অর্থকষ্টে। রোগে ভারাক্রান্ত পুত্রের পাশে বসে কবি ফারসি ভাষা থেকে ‘রুবাইয়াৎ ই হাফিজ’ বাংলায় অনুবাদ করেন। এ সময় কবির যাপিত জীবনের মাঝে এক ধরনের আধ্যাত্মিকতা ভর করে। পুত্রের পাশে বসে থেকে লিখেছিলেন, ‘আমি দ্বার খুলে আর রাখব না, পালিয়ে যাব গো’।

কবি নজরুলের জীবনের আরেক বিপর্যয় প্রিয়তমা পত্নী প্রমীলা দেবীর চিরতরে চলে যাওয়া। মৃত্যুর আগে প্রমীলা দেবী পক্ষাঘাতগ্রস্ত ছিলেন। মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলতেন স্মরণশক্তিও। স্ত্রীর মৃত্যুর বেদনায় বিদ্রোহ ও প্রেমের এই কবি লিখেছিলেন, ‘যদি আর বাঁশি না বাজে, আমি কবি বলে বলছি নে, আমি আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছিলাম, সেই অধিকারে বলছি, আপনারা আমায় ক্ষমা করবেন। আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি। আমি নেতা হতে আসিনি। আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী হতে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’ আহা রে, কত আকুতি এই লাইনগুলোতে! হƒদয়কে নাড়া দেয় এখনো। কবি নজরুলের আরেকটি লাইন বুকের ভিতরে আমার সব সময় বাজে। কবি লিখেছেন,

‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে

অস্তপারের সন্ধ্যা তারায় খুঁজবে আমায় খুঁজবে।’

কবি নজরুল একদিকে জানতেন ফারসি, অন্যদিকে উর্দু-আরবিতেও তাঁর দক্ষতা ছিল। অনুবাদ করেছেন অনেক। দুই হাতে গান লিখতেন শুধু অর্থাভাবে। ঈদ, রমজানে লিখতেন ইসলামী সংগীত। আবার পূজায় থাকত শ্যামাসংগীত। এমন অসাম্প্রদায়িক চিন্তার মানুষ কয়জন আছে? সেনাজীবন শেষে মাত্র বাইশ বছর লেখালেখি করেছেন। জড়িয়েছিলেন রাজনীতিতেও। মানুষের জন্য লড়েছেন কবি নজরুল। আটকের পর আদালতে দেওয়া তাঁর জবানবন্দি ইতিহাস হয়ে আছে। বন্দি হিসেবে কবির জবানবন্দি ছিল, ‘আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজ বিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজ কারাগারে বন্দী এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।...আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে।’ এর পরও নজরুলকে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কারাগারেও তাঁর কলম থেমে থাকেনি। তিনি লিখলেন শিকল পরা গান এবং সৃষ্টি সুখের উল্লাসের মতো প্রাণ-মাতানো কবিতা। কারাগারে থাকার সময় কবি অনশন করেন। এ সময় কবিকে বই উৎসর্গ করে অনশন ভাঙার অনুরোধ করেন রবীন্দ্রনাথ। শেষ পর্যন্ত অনশন ভঙ্গ করেন বিরজা দেবীর অনুরোধে। মানবতাকে গুরুত্ব দিতেন কবি। সাম্যের গান গাওয়া এ কবি এ কারণেই এখনো বসে আছেন মানুষের হƒদয়মন্দিরে।

নজরুলের রাজনৈতিক দর্শন ছিল স্পষ্ট। তিনি কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তাঁদের একটা বন্ধুত্ব ছিল। তবে নজরুল কখনো কমরেড মুজফ্ফরের সমাজতান্ত্রিক দলের সদস্য ছিলেন না। তিনি গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনও সমর্থন করেন। ১৯২০ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিতে তিনি কংগ্রেসের সমর্থন চান। সমর্থন লাভে ব্যর্থ হলেও নজরুলের কাজ থামেনি। দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম একবার ভোটে দাঁড়ালেন। আসন ছিল ফরিদপুর। তখন ঢাকার সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিল ফরিদপুর। সময়টা ১৯২৬ সাল। কবি ঘুরে বেড়াতেন বাংলার আনাচে-কানাচে। ফরিদপুর ঘুরতে যাওয়ার পর স্থানীয়রা ভোটে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানান। সে অনুরোধ তিনি প্রত্যাখ্যান করলেন না। মানুষের ডাকে সাড়া দিলেন। ঢাকা বিভাগের মুসলমানদের কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য পদে ভোটে নামলেন। মনোনয়ন নিলেন স্বরাজ পার্টি থেকে। প্রতীক নেওয়ার পর দল থেকে তাঁকে খরচের ৩০০ টাকা দেওয়া হয়। কবির ধারণা ছিল, ভোটে টাকা লাগে না। বিস্মিত হাতে তিনি টাকা নিলেন। মাঠে নেমে বুঝলেন, এ টাকা কিছুই না। পোস্টার করলে কর্মী খরচ আসে না। কর্মীদের দিলে সমর্থকরা পান-তামাকের টাকা চান। বিপদে পড়লেন বিদ্রোহী কবি। বুঝলেন প্রচারণা হয় না টাকা ছাড়া। কবি কিছু প্রভাবশালী মানুষের কাছে গেলেন। কাজ হলো না। কবির পাশে দাঁড়ালেন না কেউ। পেলেন না কোনো ধরনের সহায়তা। বিপদ থেকে উদ্ধার করতে নজরুলের পাশে দাঁড়ালেন ফরিদপুরের আরেকজন কবি জসীমউদ্দীন। এতে সমর্থন বাড়লেও আর্থিক সংকটের সমাধান হলো না। কবি নজরুল হারলেন। জামানত বাজেয়াপ্ত হলো। পাঁচজন প্রার্থীর মধ্যে তিনি হলেন চতুর্থ। সব মিলিয়ে পেলেন ১০৬২ ভোট।

ভোট বিড়ম্বনার পরও মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকে সরেননি কবি। বরং সম্পৃক্ততা আরও বাড়ালেন। কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোধা কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের সান্নিধ্যে গেলেন। দাঁড়ালেন সাধারণ মানুষের পক্ষে। অংশ নিলেন বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে। কলকাতা থেকে কুমিল্লা। ভালোবাসা থেকে রাজপথ। বাদ থাকল না কোনো কিছু। কবি ছুটছেন সমাজের সব অসংগতির বিরুদ্ধে। সঙ্গে ছিল কবির ক্ষুরধার লেখনী। অন্ধকারে আলোর ঝলকানি দেখল নিপীড়িত মানুষ। নজরুল ছিলেন মানুষের কবি। মানবতার কবি। প্রেমের কবি। ভালোবাসা ও দ্রোহের আলো ঝলসানো কবি। নজরুল নেই। শুয়ে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে। বাঙালি জাগ্রত আছে নজরুলের সব কাজ ঘিরে।

-সমাপ্ত

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর