শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

নির্জনতার গল্প

নাসরীন জাহান

নির্জনতার গল্প

মনে হচ্ছিল ঝাপসা হয়ে আসছে। ছেলেটির চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল ক্রমশ। না, চোখের জলে নয় সেদিনের পরদিন অন্ধত্বের দিকে যাচ্ছিল, তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্দান্ত খারাপ... মেয়েটি তাকে ক্লাসের পড়াগুলো শোনাত আর জীবনে উদ্দামময়ভাবে চলার সাহস দিত।

একসময় প্রখর রোদ্দুরেও চোখের সামনে ঘুটঘুটে আঁধার... ছেলেটি চারপাশ প্রকম্পিত করে চিৎকার করল, এ পৃথিবীর আলো-বাতাস না দেখলে আমি বাঁচব না, আমাকে বিষ দাও।

মেয়েটি স্থবির বসে থাকে। যে ছেলেটি তাকে প্রবল চুম্বন আর ভালোবাসায় ভাসিয়ে রাখত তার চারপাশে কেবল মৃত্যুর আর্তনাদ।

নিজের হতশ্রী পরিবারের দিকে একটি বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েটি নড়ে উঠল। সে ছেলেটির এ আর্তচিৎকার সহ্য করতে পারছিল না। নিজেকে অসহায় বিপন্ন বোধ করা মেয়েটি ছেলেটিকে অবুঝ দুর্মর ভালোবাসার ফলে অতিদ্রুত সন্ধানীর কাগজে সই করে নিজে ঠোঁটে নিল বিষের গেলাস।

মেয়েটির আত্মহত্যার পর তার শব যখন গোরস্থানের দিকে যাচ্ছিল, ছেলেটি ছিল চক্ষুহীন...

ছেলেটি কীভাবে কী হলো জানত না... অপারেশনের পর নতুন চোখ পেয়ে কেবল চারপাশে আলো সবুজ প্রজাপতির বিলোড়ন দেখে ছোট্ট শিশুর মতো খপ করে ধরতে গিয়ে আনন্দ ধ্বনিতে ফেটে পড়তে থাকে...এই তো জীবন.. এই তো...।

গল্পটি এ পর্যন্ত লিখে, লেখক আর কোনোদিন কিছু লিখতে পারেনি। ক্লাসমেট এবং স্কুল-কলেজ একসঙ্গে পড়ুয়া তার প্রেমিকা অহনা তাকে এ গল্পের থিম দিয়েছিল। মাঝে মধ্যেই অহনা তাকে অদ্ভুত সব গল্পের থিম দেয়, বলে আমরা তো কত কিছুই দেখি, ভাবি কিন্তু তোমার মতো লেখার হাত তো সবার নেই। কর্ণফুলীর ঢেউ যখন থির থির কাঁপিয়ে ওপাশের পাহাড়ে গিয়ে মিহি ঘাই খাচ্ছিল, এ গল্পের থিম শুনে তখন জিজ্ঞেস করেছিল লেখক, তুমি এভাবে ভাবতে পারো? আমার চোখের যদি কিছু হয়, তুমি...।

আমিও তাই করতাম... অহনার কণ্ঠে দৃঢ়তা, গল্প লিখি না বলে যা সিরিয়াসলি ভাবি, তা করতে পারি। তোমরা কাগজে লিখে ওটাকে স্বপ্ন বানাও। আমি উল্টো তোমাকে এ প্রশ্ন করব না যে, আমার এমন হলে তুমি...।

লেখক নিজের মধ্যে কেমন ঝিম মেরে যায়। বাক্য বাক্য খেলাই তো, বলে দিলেই হয়, অহনা, তুমি হলেও...।

কিন্তু ভিতর থেকে টান আসছে না, আগে যেমন আসত, যখন একসঙ্গে স্কুলে পড়ত, কলেজে সামান্য স্পর্শেই তীব্র কম্পন... একসঙ্গে বাঁচব মরব বোধ ছিল, দুজন মরিয়া হয়ে একই সাবজেক্টে পড়ে শেষে একে অন্যকে সাহায্য করে একই ভার্সিটিতে এসে ভর্তি হয়েছে, দূর শহর ছেড়ে। সেই গ্রোথটাই আর এখন লেখককে সেভাবে ঠেলে না কোনো দুর্মর রোমাঞ্চ অথবা অহনাকে কেন্দ্র করে তীব্র অনুভূতির দিকে। সে স্কুলে থাকতেই বলত, বড় হয়ে বিখ্যাত লেখক হব।

কলেজে উঠতেই ওর দুর্মর অনুভূতির গল্পগুলো পড়তে পড়তে অহনাই তাকে বলেছিল, তুমি তো লেখকই। কেবল বিখ্যাত হতে আরও পথ এগোতে হবে। অহনার আখ্যায়িত এ সম্বোধন সে গভীরভাবে নিয়েছিল।

কিন্তু এখন ছায়াঘেরা ভার্সিটির চত্বর তাকে ক্রমশ অস্থির করে তুলছে। তার অধিকাংশ গল্পই, যেগুলোতে মৃত আত্মা, মুখোশের হাসিকান্না, জীবন্ত শবদের বিচরণ ঘিরে আবর্তিত, যা ঠিক হরর গল্পও না, যার মধ্য দিয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপটের মেসেজও থাকত রূপকের মধ্য দিয়ে, এখন সেইসব বিষয় থেকে নিজ অজান্তেই বিযুক্ত হতে হতে লেখক অনুভব করে তার লেখায় ক্রমশ আসন পেতেছে তীব্র প্রেমের প্রবহমানতার বিবর্তন, যা অহনাকে দেখাতে এই প্রথম দ্বিধা, বিস্মিত অহনা প্রশ্ন করতেই পারে, আমার পাশে এদ্দিন থেকেও তো এমন গল্প লিখ নি? এত কেন ভালোবাসে অহনা তাকে, নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। কেমন হাঁসফাঁস বমি বমি লাগে। অহনা দিন-রাত লেখকের সঙ্গে চিপসে থাকে, লেখক কি অহনার প্রপার্টি নাকি? ভার্সিটি থেকে একই ট্রেনে শহরে ফিরতে গিয়ে প্রায়ই চুলে বহুবর্ণ স্কার্ফ পরিহিত যে মেয়েটির চক্ষু গ্রীবা চুলের উড়াল তাকে তীব্র কম্পনে কাঁপায় সেও ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি ছড়িয়ে এক ফোঁটা সলজ্জ লেখকের দিকে তাকিয়ে একসময় মুখ ফিরিয়ে নেয়, পাশ ঘেঁষে বসা অহনাকে দেখে না?

অহনা লেখকের মুখ দিয়ে গলা বেয়ে পেটে ঢুকছে, তীব্র বিবমিষায় ওকে ওগড়াতে পারলে লেখক বাঁচে। কেবল অভ্যাসের মায়ায় আর এর প্রেক্ষিতে অহনার কী দশা হবে, এই আশঙ্কায় লেখক তড়পায়।

কতকাল আগে গ্রামে এসেছে লেখক স্মরণ করতে পারে না। দিন-তারিখের হিসাব অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে সে, ওষুধের ঘোরে সারা দিন বিছানায় পড়ে থাকে। কী বর্ষায় কী জ্যোৎস্নায়, সে রাতে হু হু গ্রামে চক্কর খায়। কেবল অমাবস্যায় দাদি মিনতি জানায় কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতে।

দাদার ছেলেরা সবাই বউ-বাচ্চাসহ বাইরে। উদাসী হোক বাউল হোক নাতি এ অবস্থায় কোথাও গিয়ে যেখানে শান্তি পায় না, এখানে এসে যেভাবেই পাচ্ছে তাতেই বুড়োবুড়ি খুশি; বরং যেমন শুনেছিল, দফায় দফায় নাতিকে মানসিক ডাক্তার দেখানো হচ্ছে, কারও সঙ্গে কথা বলে না, কাউকে সহ্য করতে পারে না এখানে তার উল্টো। সন্ধ্যার উঠোনে দাদা-দাদির সঙ্গে চা খেতে খেতে কত পৃথিবীর গল্প যে করে। যেখানে মানুষ সাপ খায়, কুকুর খায়, মাটির নিচেও যেখানে পৃথিবী আছে, সেখানে মার্কেট আছে, ট্রেন চলে, পৃথিবীর বাইরেও সৌরজগৎ আছে... এখন নাতির গল্পে আগের মতো মৃত আত্মা, কাটামুন্ডুর কথা বলে যাওয়া, এইসব নেই।

এইভাবে দিনগুলো রাতগুলো কাটে।

একরাতে আসমানে মস্ত করে চাঁদ উঠল। পুরো গ্রামে পূর্ণিমার খই ফুটতে থাকল। চকিতে লেখকের মনে হলো আজ অহনার জন্মদিন।

ওর মৃত্যুর পর ক’দিন পার হলো? ক’মাস? বছর? লেখক জানে না, সে যে দিন-তারিখের হিসাবের বাইরের এক জগতে এনে নিজেকে ফেলেছে।

পুরো দেহ প্রথমে তীব্র অবশতায় চলে যেতে থাকলে যেন কানের মধ্যে ফিসফিস শব্দ শুনল সে, লেখক, ফের গল্প লেখা শুরু করো। চকিতে চারপাশে তাকায়, নিরন্তর গল্প লিখে যাওয়া? এ তো অহনার সঙ্গে সঙ্গে আমারও স্বপ্ন ছিল। অহনা তাকে আবার লিখতে বলছে? সারা দেহে শিহরণ বয়ে যায়। ধীরে ওঠে কাগজ-কলম পেতেই অনেকটা সময় ঝক্কির মধ্যে গেল।

সর্বাঙ্গে অদ্ভুত রোমাঞ্চ, যেন সে আগের নিজেকে ফিরে পেয়েছে, কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থেকেই অহনার দেওয়া থিম ‘অন্ধ ছেলের গল্প’টিই সে অন্যভাবে লিখতে শুরু করে, এই গল্পে মেয়েটি আত্মহত্যা করলে ছেলেটি আর তার চোখ নেয় না। দূর কোনো অজান্ত পাহাড়িয়া জীবনে অন্ধত্ব নিয়েই নিজেকে হারিয়ে ফেলে।

এরপর পূর্ণিমার দুর্মর টানে সে ঘর থেকে বাইরে আসে। আহা! পুরো গ্রামটিকে যেন আলোর মস্ত চাকতি বানিয়ে গ্রামটিকে কোলে নিয়েছে পূর্ণিমা। শেয়ালের ডাক... কুকুরের ঘেউ বাঁশঝাড়ের বনের ঝাপট ছাড়িয়ে একসময় তীব্র কম্পনের মধ্য দিয়ে লেখক অদ্ভুত এক ঘ্রাণ পায়। আচ্ছন্নের মতো এগোতে এগোতে অনুভব করে-আরে? এ যে অহনার দেহের ঘ্রাণ।

কবরস্থান দিয়ে যাওয়ার পথেই অনুভব করে তার দেহ ঘেঁষে এগিয়ে গেল কেউ। এ যেন এক অন্য জীবন। যেখানে লেখক অহনাকে উগড়ে দিয়ে দুর্মরভাবে অন্য নারীর সঙ্গে জড়ায় নি। অহনাও আত্মহত্যা করে নি। সে-তো হাজার বার ডাক্তার আত্মীয়কে বলেছে, অহনা মরে নি। আমার সঙ্গে অভিমানে দূরে কোথাও চলে গেছে। একদিন ঠিক আমার মুখোমুখি দাঁড়াবে।

আজ কি সেই দিন?

উত্তেজনায় বিস্ময়ে কাঁপতে থাকে লেখক।

 

পায়ের তলায় কাঁটা ফুটেছে, রক্ত ঝরছে, কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই লেখকের। সে কখনো হেঁটে কখনো ওষ্ঠা খেয়ে পড়ে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে থাকে।

পুরো গ্রাম ঘুমে স্তব্ধ।

আচমকা চমক তরঙ্গের সঙ্গে চকিতে মাথা ঘুরে যায়। এ গ্রামের সবচেয়ে সুন্দর ফটফটা জলের দিঘির দিকে। শাড়ি পরে ঘাই খেয়ে ঢেউ খেয়ে কে ওখানে সাঁতার কাটছে?

শৈশবে সে আর অহনা কত সাঁতার কেটেছে একসঙ্গে। জলের রাজা ছিল অহনা। ওর সঙ্গে সাঁতারে কোনোদিন পারত না বলে শৈশবের মরদাঙ্গিতে কতই না আঘাত পেত সে।

তন্নতন্ন চোখে তাকিয়ে থাকে লেখক। এইবার কোনো এক নারী ভেজা চুলসহ গ্রীবা লম্বা করে মাথা তুলেছে। লেখকের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এ কে? হ্যাঁ, এ-তো অহনাই... তবে নাকে-মুখে গ্রীবায় সৌন্দর্যের যে ঘাটতিগুলো ছিল তা পূর্ণ হয়ে সে রীতিমতো অঞ্ঝরাই হয়ে উঠেছে।

পুরোটা জ্যোৎস্নার জল ওর মাথার ওপর। লেখকের দিকে তাকিয়ে সে শৈশবের মতো হাতছানি দেয়।

আর তাতেই বিমূঢ় লেখক আগাপাস্তালা সব ভুলে জলে ঝাঁপ দেয়।

অহনা অহনা... দু’হাত দিয়ে ঢেউ সরাতে সরাতে নিঃশ্বাসে জল উঠে মরণদশা হয় লেখকের। নাকের মধ্যে ব্যথার টাটানি... দক্ষ সাঁতারু অহনা জলে মাথা ডুবিয়ে ডুবিয়ে কাছে আসে, শৈশবেও তোমার এমন হতো... জোরে জোরে দম ছাড়ো। এরপর হাতড়ে হাতড়ে লেখকের হাত ধরে বলে, চল কিনারে যাই।

দীর্ঘ দিঘিতে কিনার এখন অনেক দূরে। আচমকা বাতাস উঠায় জলে প্রবল গ্রোতের তরঙ্গ বইছে। অহনাকে জাপটে ধরে চুমুয় চুমুয় ভরিয়ে দিতে দিতে যেন জল নয়, হাওয়ার মধ্যে ভাসতে থাকা লেখক বলতে থাকে, তুমি কি এই সৌন্দর্য আনতে নার্সিসাসের কাছে গিয়েছিলে? কেন? কেন বুঝলে না এরপর আমার বুক পুড়ে যাবে, কলম অবশ হয়ে যাবে, আমি আর এক কলমও লিখতে পারব না? আমি তোমাকে ফেলে অন্য মেয়ের সাথে যে ঘোরে দেহ মনে জড়িয়েছিলাম ও আমার প্রেম ছিল না, তুমি ছাড়া আর কে বুঝবে ও আমার মোহ ছিল? যা তাচ্ছিল্যে মাড়িয়ে আমি অদ্ভুত নির্বাসনে পালিয়ে এসেছি। অহনা অহনা, আমি চাই না তোমার এই সৌন্দর্য... জলের মধ্যে আধভোবা ঠোঁটে ভুরভুরানি ওঠে, আর আমি লেখকও না আমি সেই তোমার শৈশবের রঞ্জু...।

না...না... তুমি লেখক, লেখকের হাত ধরে জলে বুক পেতে দিয়ে এগোতে থাকে অহনা, এইতো, আজকেই তুমি লিখলে...।

সে তুমি আসার অবচেতন শব্দ পেয়ে... ঝিরিঝিরি বাতাসে থিরথির কাঁপে লেখকের শরীর, আগেও তুমিই লিখিয়েছ, আমার নিজের কিছু যে ছিল না সে অনেক পরে বুঝেছি। তোমার মৃত্যুর পর, কেন আমি অন্য একটা মেয়ের মোহে পড়ায় তুমি আমার গল্পের মেয়ের মতো আত্মহত্যা করলে? না না তুমি মরো নি, এইতো তুমি।

এবার চিৎসাঁতার দিতে গিয়ে দুজনই দু’ডানা করে পেছনে জল কেটে কেটে ধেয়ে এগোয়, চাঁদ বরাবর তাকিয়ে, আজ ওসব কথা থাক না, অহনার কথা জল বাতাসে একাকার হতে থাকে... রূপ তোমাকে টেনেছিল, স্বাভাবিক... জীবনের এই সহজাত চুম্বক আকর্ষণ থেকে বের না হতে পারাটাই অস্বাভাবিক। কোনটা মোহ কোনটা দীর্ঘ প্রেম এ বুঝতে বুঝতেই তো ভুলগুলো ঘটতে থাকে, আমি কেবল অতিমাত্রার মোহটাকে সহ্য করতে পারি নি, তারপরও সেই প্রেমেই তো তুমি ফিরেছ। দু’ পা ডলফিনের লেজের মতো জলের মধ্যে নাড়তে নাড়তে অহনা বলে, কি ফির নি?

হ্যাঁ গো হ্যাঁ ফিরেছি, সর্ব অস্তিত্ব দিয়ে।

তবে আমার চোখ দুটো ফেরত দাও।

জল থেকে উঠে ঘাটে বসে লেখকের ভূমণ্ডল কাঁপিয়ে দিয়ে অহনা বলে, তুমি প্রেমে চক্ষুহীন আমাকে কবরস্থানে পাঠিয়েছিলে, ওটা আমার ত্যাগ ছিল, আজ তুমি এতকাল পর সেই লেখা বদলেছ। এখানে আমি চক্ষুময় পূর্ণাঙ্গ মানুষ, এ তো সব হারানো তোমার এখনকার অনুভব, এই তোমাকে আমি চিনিও না, ভালোও বাসি না। তুমিই বলো যে আমার পাশে আজ তুমি নেই, কেউ নেই, সেই আমি এই পাথর চক্ষু নিয়ে আর কত জমিনে আসমানে হোঁচট খাব? স্তম্ভিত হয়ে লেখক দেখে, এতক্ষণ জ্যোৎস্নায় যে চোখ নানা রঙে স্ফটিকের মতো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল তা...।

বিমূঢ় তাজ্জব হতবিহ্বল অবস্থায় বসে থাকে লেখক, আচমকা অনুভব করে জ্যোৎস্না থেকে পেঁচিয়ে নামছে কালো রশ্মি, তার দু’ হাত কষে বেঁধে যেন বা তাল থেকে শাঁস তুলে নিচ্ছে এভাবে তার চক্ষু দুটো বের করতে থাকে... যেন চোখ না, হৃৎপিণ্ডে বিষাক্ত ছুরি বসিয়েছে কেউ... শরীর বেদনার চেয়েও তীব্র এক ভয়ে চিৎকার করতে থাকে লেখক... ওটা তো আমার গল্প ছিল, গল্পে মেয়েটি অন্ধ ছেলেটিকে নিজ চোখ দিয়ে আত্মহত্যা করে। তুমি অহনা, কেন তুমি গল্পকে জীবনের সাথে গুলিয়ে ফেলছ? আমিই আমার আত্মার অনুভব বিশ্বাসে সেই থিম তোমাকে দিয়েছিলাম, গল্পের মেয়ে আর আমার মধ্যে কোনো দূরত্ব নেই... লেখক চিৎকার করে-এই পৃথিবীর চাঁদ জ্যোৎস্না বৃষ্টি মুখরতা ছাড়া আমি বাঁচব না...এই অন্ধকারের চেয়ে আমাকে বিষ দাও। লেখক শোনে, একটা রহস্যময় হাসির উদ্ভাসন অহনার কণ্ঠে, কিছুক্ষণ আগেই না লাশটাকে চক্ষুময় করলে...

আবার বলছি, এটা একটা গল্প... তুমি কেন এটাকে এত সিরিয়াসলি নিলে?

কেন? তুমিই না বলতে গল্প জীবনের রূপ দিয়ে তৈরি? অহনা বলে, আমিই স্বপ্ন ভাবতাম, দেখো আগে তোমাকে কত কাহিনি বলেছি, কিন্তু তুমি আমাকে প্রেম বিচ্ছেদ ছুড়ে দিয়ে অন্য কারও সাথে জড়ালে সেই কাহিনির চরিত্র যে আমি হয়ে যাব, সে কি আমি জানতাম? আমার কথিত সেই গল্প-ই যে আমার জীবন এসপার-ওসপার করে দেবে বলো লেখক, কে জানত?

আর লেখক নই আমি-রঞ্জু বলো হায়! আমাকে কি ধরেছিল জীবনানন্দের ভূত? দেখো, কোথায় এসে পড়েছি।

হা হা! আফসোস করছ? কোথায় এসেছ? দাদির গল্পের ওমে ঢুকে নিজেকে নির্বাসিত ভাবার বিলাসিতা? তোমার অন্তরাত্মা জানত তোমার জীবনের এই অনুভবও তোমার ভেতর থেকে বের করবে দুর্দান্ত কোনো শিল্পের। স্বার্থপর। চক্ষুহীন লেখক দিকবিদিক ঘাই খেতে থাকে।

তুমি কেন আত্মহত্যা করলে আমার জন্য? আমি বলেছিলাম? তুমি যদি সে গল্পের নারী হও তবে আমি তাকেই বলছি, গল্পে বর্ণিত ত্যাগের মতো আমি কোনো ত্যাগ করতে পারব না। জীবন আর গল্পকে দোহাই মিশিয়ে ফেল না, তুমি আমার চক্ষু নিয়ো না দোহাই...। তার চেয়ে আমাকে হত্যা করো। জ্যোৎস্নার থইথই আলোয় যখন লেখকের চারপাশে ঘোর অমাবস্যা... কালিজিরা বাগানের হাজারো ফুলের মধু খেয়ে অহনার হি হি হাসিতে তখন চারপাশ প্রকম্পিত হচ্ছে। যেন ক্রমশ বিশাল এক ছায়ায় এগিয়ে আসতে থাকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর