আমি ছাড়া কে জানে
সোফায় এলানো তার শরীরের বাঁক দেখে ভাবি-
কী আশ্চর্য, নিজের ভেতরে
কেমন নিশ্চুপ কত জটিল কাহিনী, কল্পকথা শোকগাথা,স্বপ্নের নিবিড় ভাষা লুকিয়ে রেখেছে।
ক্ষণিক বিশ্রামে তার গূঢ় রহস্যের বর্ণচ্ছটা
শুয়ে আছে। কে বলবে যে এখন পিঠে এক রাশ কালো চুল
ছড়িয়ে রয়েছে বসে, সে এমন শক্তি ধরে যাতে
আমার বুকের মধ্যে কালবৈশাখী তুফান ওঠে
ভয়ংকর মনোহর
বিদ্যুল্লতা খেলা করে, বারবার নীড়সুদ্ধ গাছ অগোচরে
পুড়ে খাক হয়,
এই মধ্যবয়সীরও শিরায় শিরায় জ্বলে প্রখর দেয়ালি।
আমি ছাড়া কে জানে এখন
যে এমন ভীরু দৃষ্টি মেলে দ্যায় হরিণীর মতো, তার চোখে
চকিতে ঝলসে ওঠে স্বেচ্ছাচারী কাতিলের ধারালো খঞ্জর?
৩/১২/৮৬
চারু ভিক্ষা
জানালার প্রতি সম্ভ্রমে আমি
চারু ভিক্ষায় বাড়িয়ে দিলাম হাত।
কেউ কি সেখানে ছিলেন একাকী?
করতলে এলো কমলা অকস্মাৎ।
ভাগ করে খাই মরশুমছুট
কমলার কোয়া, জিভে লেগে থাকে স্বাদ।
কার মাধ্যমে এলো সওগাত,
লুটোপুটি খায় সে-কথা জানার সাধ।
বিস্ময় তার জাল ছুঁড়ে দেয়,
স্বরহীন ঘর বলে, ‘কেন ভয় পাস?’
কিসের সোহানা গন্ধ মেতেছে
কোন্ কাননের পুষ্পের নির্যাস?
তত্ত্বে তথ্যে ভরপুর মন,
মনো সীমান্তে যুক্তি পাহারাদার;
প্রহরীর চোখে ধুলো দিয়ে কী-যে
ঘটে গেলো দ্রুত, খুললো গুপ্ত দ্বার।
রাত্রি কি ঘোর কুহক ছড়ায়?
কাঁপে বার বার রহস্যময় চিক।
চৌদিকে কিছু ভস্ম উড়িয়ে
গেয়ে ওঠে গান পক্ষী অলৌকিক।
রুটির মতোই মুখে পুরে তাকে
চিবুই সহজে, সূক্ষ্ম শিল্প-কাজ।
হাতের চেটোয় বিস্মৃত পথ,
আঙুলে লগ্ন অভীষ্ট দুধরাজ!
আমার ভিক্ষা ফেলেছে ধন্দে;
সোফায়, শেল্ফে জাগে সমুদ্র-ঢেউ।
দীক্ষা ব্যতীত কী করে আমিও
ভাসি নীল জলে, সে-কথা জানে না কেউ।
১০/১১/৮৬
প্রতিদ্বন্দ্বীগণ
এই ভিড়ে কী করে আমার ঠাঁই হবে? চতুর্দিকে
জ্বলজ্বলে পুরুষেরা দামি
পোশাক আশাক প’রে ঘুরে বেড়াচ্ছেন
ইতস্তত। কেউ দুঁদে আমলা, অনেকে
তুখোড় তাজির, কেউ কেউ কৃতবিদ, গবেষক,
নীরেট পণ্ডিত কেউ, কেউ কেউ নামজাদা কবি
কেউ কেউ ফিল্মের নন্দিত
অভিনেতা, কারো কারো নামে যুক্ত উজ্জ্বল উপাধি,
চোখ-ধাঁধানিয়া। জমকালো এই ভিড়ে
তোমার নজরে
সহজে পড়বো আমি, আমার তেমন
কোনো চাকচিক্য নেই।
তুমি তো জানোই, এরা সকলেই করে
স্তব সারাক্ষণ
তোমার রূপের অন্তরালে কানে ঢালে সংকলিত
শিল্পিত বচন
বেলেহাজ তোষামুদে স্বরে, আর এরা
প্রত্যেকেই প্রত্যেককে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে। বিশেষত
তোমার অনুগ্রহের কণা কুড়াবার
প্রতিযোগিতার শিল্প চন্দনের ফোঁটা
হয়ে শোভা পায়
ওদের ললাটে বিলক্ষণ।
হে সুন্দরীতমা, এই ভিড়ে
কী করে আমার ঠাঁই হবে, কোনো গুণ নাই যার,
কপালে আগুন? উপরন্তু কাউকেই
প্রতিদ্বন্দ্বী ব’লে আমি স্বীকৃতি দিই না কোনোদিন
৬/৬/৮৭
ভূমিকা : শেখ মেহেদী হাসান
বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬)-এর জন্ম পুরান ঢাকার ৪৬ মাহুতটুলীতে। পিতা মোখলেসুর রহমান চৌধুরী এবং মাতা আমেনা খাতুন। ছেলেবেলায় তাঁর কবিতা লেখার শুরু। ১৯৪৩ সালে তাঁর প্রথম কবিতা ‘উনিশ শ’ উনপঞ্চাশ’ প্রকাশিত হয় নলিনীকিশোর গুহ সম্পাদিত ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের কৃতী ছাত্র। পেশাজীবনের শুরুতে রেডিওতে কাজ করলেও একপর্যায়ে সাংবাদিকতা হয়ে ওঠে প্রধান পেশা। ‘দৈনিক বাংলা’র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বেশ ক’বছর।
১৯৬০ সালে তাঁর প্রথম কাব্য ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয়। এ বইয়ের মাধ্যমে তাঁর কবি পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে বাংলাভাষী কবিতাপ্রেমী মানুষের মাঝে। কলকাতা থেকে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর ‘রূপালি স্নান’। এরপর একের পর এক তাঁর কবিতাকৃতি, স্বকীয়তা ও সৃষ্টিশীলতার চিহ্ন পাঠকহৃদয় আন্দোলিত করে। শামসুর রাহমানের প্রথম দিকের কবিতায় পঞ্চপাণ্ডবের (জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তী) প্রভাব ছিল। ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’, ‘রৌদ্র করোটি’, ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’সহ প্রথম দিকের কাব্যগুলোয় এ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। পরে তিনি কবিতায় নিজের বলয় তৈরি করেন। শব্দ প্রয়োগ, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্পের ব্যবহার তাঁকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে চিরকালীনতার অনুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন কবিতার বুননে। সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যেমন কবিতার ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন, তেমন মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত মানুষকে প্রেরণা দিয়েছেন কবিতার সৃষ্টিশীলতায়।
তাঁর জন্ম ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে। তিনি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা, বাঙালির মাতৃভাষা সংগ্রাম, স্বাধিকার আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরে ১৯৭৫-এর পট পরিবর্তন, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনসহ দেশ ও জাতির ইতিহাসের প্রধান রাজনৈতিক বাঁকবদলগুলো প্রত্যক্ষ করেছেন। দেশের ইতিহাস আত্মস্থ করেছেন। জনগণের আকাক্সক্ষা উপলব্ধি করেছেন। সেই ইতিহাস ও উপলব্ধি নান্দনিকরূপে পরিস্ফুটিত করে উপহার দিয়েছেন অজস্র কবিতায়। তাঁর ব্যাপ্তি আরও ছড়িয়েছে দিগ্বিদিক। কবিতায় জাতির আকাক্সক্ষা তুলে ধরেছেন তিনি। আধুনিক বাংলা কবিতার যে ধারা সৃষ্টি করেছেন, তা অব্যাহত আছে। সব সময় তিনি অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, জীবনবোধের দিকে মানুষকে আহ্বান করেছেন। জনগণের আকাক্সক্ষা উপলব্ধি করেছেন। এজন্য একটি নিজস্ব বাগ্ভঙ্গি সৃষ্টি করতে সফল হয়েছেন তিনি। বাংলা সাহিত্য কবি শামসুর রাহমান যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, আগামী প্রজন্ম তা আরও এগিয়ে নেবে।
শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার সম্পর্কের নিবিড়তা ছাত্রজীবন থেকে। প্রয়াণের পর তাঁর সব রচনা সংকলন প্রকাশের চেষ্টার অংশ হিসেবে কবির একাধিক রচনা আমার হাতে আসে। বর্তমান কবিতা তিনটি এরই অংশ। আমার জানা মতে, ১৯৮৬ এবং ১৯৮৭ সালে লেখা শামসুর রাহমানের এ কবিতা আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এ কবিতায় মেলে কবির সেই চিরচেনা স্বভাবসুলভ অনায়াস বলে যাওয়ার ভঙ্গি। এমনকি এখানে কবির নম্র ও পবিত্র মুখটিও ভেসে ওঠে।