শুক্রবার, ৩১ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

কেন, ওই তো যিশু

হাসনাত আবদুল হাই

কেন, ওই তো যিশু

এক।।

পুরনো ভাড়াটিয়া চলে যাবার পর খানে আলম ঠিক করেছিলেন যে, কম বয়সের কাউকে ভাড়া দেবেন না, কেননা তারা বন্ধুবান্ধব নিয়ে এত হইচই করে যে, তার রাতে ঘুম হয় না। হইচই বিকেলে শেষ হয়ে গেলেও মনে মনে তার রেশ থেকে যায় অনেকক্ষণ যে জন্য তার রাতে ঘুম আসে না। যুবক বয়সের ছেলেটি যখন গাড়ি থেকে নেমে খুব সপ্রতিভ হয়ে তার বসবার ঘরে এসে চোখ থেকে সিনেমার হিরোর মতো সানগ্লাস নামিয়ে বললো, টু-লেট ঝুলছে দেখলাম। এখনো খালি আছে?

খানে আলম খবরের কাগজ পড়ছিলেন, নিচে নামিয়ে চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে বললেন, আছে। কিন্তু আপনাকে দেওয়া যাবে না।

যুবক অবাক হয়ে বলল, আপনি আমাকে চেনেন? চেনেন না। অথচ দুম করে বলে দিলেন, দেওয়া যাবে না। আমাকে কেন দেওয়া যাবে না বলবেন প্লিজ।

এই জন্য যে আপনার বয়স কম। কম বয়সী কাউকে ভাড়া দেব না বলে ঠিক করেছি।

কেন? কম বয়সীদের কী অপরাধ? কেন ভাড়া দেবেন না তাদের? আপনিও একদিন কম বয়সী ছিলেন না?

এই জন্য দেব না যে, তারা খুব হইচই করে। আমি হইচই পছন্দ করি না তাতে আমার রাতের বেলা ঘুমের ব্যাঘাত হয়। আর হ্যাঁ আমিও একদিন কম বয়সী ছিলাম কিন্তু এখনকার ছেলেদের মতো লাউড ছিলাম না।

ও। তাই বলুন। এতক্ষণে একটা কারণ জানা গেল। খুবই সংগত কারণ এবং যুক্তিপূর্ণ কথা। কিন্তু আপনি জানলেন কীভাবে, ভাবলেন কেন আমি হইচই করি? আপনি আমাকে আগে কোনো দিন দেখেননি।

বয়স। আপনার বয়স বলছে আপনি হইচই করার শ্রেণির। খানে আলম বিরক্ত হয়ে বললেন।

সে অনুমান আপনি করতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হলো আপনার অনুমান সঠিক না। আমি কম বয়সের হওয়া সত্ত্বেও হইচই করতে পারি না। আমার বন্ধুবান্ধব এলে তারাও করতে পারে না। কারণ আমার সঙ্গে মা থাকেন। তাঁর বয়স বিরাশি। আপনি কি আশির সীমা পার করেছেন?

খানে আলম এবার নড়েচড়ে বসলেন। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা যুবককে এই প্রথম গুরুত্বের সঙ্গে দেখলেন। যে যুবক বিরাশি বছরের মাকে সঙ্গে নিয়ে থাকে, সে দায়িত্বশীল মানুষ। তাকে পত্রপাঠ বিদায় করা যায় না। ভাবলেন খানে আলম।

তিনি এবার মুখের অভিব্যক্তি বদলে, সৌজন্য দেখিয়ে বললেন, বসুন।

যুবক বসার পর তিনি বললেন, বাসায় আর কে কে থাকবে? আপনি আর আপনার মা ছাড়া?

যুবক বললেন, আর কেউ না। শুধু আমি আর মা।

ব্যস, মাত্র দুজন? তা দুজনের জন্য অত বড় ফ্ল্যাটের কী দরকার?

যুবক বলল, মা বই পড়েন। তার এক ঘরভর্তি বই। আমি কম্পিউটার সফটওয়্যার তৈরি করি। আমার বড় স্পেস দরকার।

আপনার তাহলে অ্যাসিসট্যান্ট আসে কাজে সাহায্য করার জন্য? খানে আলম বলেন। তাঁর চোখ জিজ্ঞাসু।

আসে। দরকার মতো আসে। আমিই তাদের ফোনে আসতে বলি। দরকার না হলে ডাকি না।

তার মানে লোকের যাওয়া-আসা হয়? কোনো দিন কম, কোনো দিন বেশি? খানে আলম চোখ সরাসরি করে তাকান। জহুরিদের মতো।

জি। ঠিক ধরেছেন। এব অ্যান্ড ফ্লো। জোয়ারভাটার মতো। তারা আসে যায়। যুবক হেসে বলে।

যখন জোয়ারের মতো তারা আসে, হইচই হয়? খানে আলম অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠেন।

ওহ নো। যুবক প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে। তারপর স্বর নামিয়ে বলে, তা কি করে হবে? মা আছেন না? মা সহ্য করবেন না। চেঁচিয়ে উঠবেন। আমি নিষেধ করব।

বেশ। আপনাকে ভাড়া দেব। বিরাশি বছরে যে মহিলা বই পড়েন তার ছেলেকে আমি ফ্ল্যাট ভাড়া দেব। তা নামটা কি? আপনার নামই জানা হলো না। খানে আলমের স্বরে আক্ষেপ প্রায় ক্ষমা চাওয়ার মতো শোনায়।

যিশু। যিশু চৌধুরী?

যিশু? খানে আলম অবাক হয়ে যুবকের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ঠাট্টা করছে কি না বোঝার চেষ্টা করেন। তারপর বলেন, শুধু যিশু? সঙ্গে আর কিছু নেই?

জি না। আমার মরহুম বাবা খুব সিম্পল মানুষ ছিলেন। জটিল কিছু পছন্দ করতেন না। নামকরণেও না। আমার নাম যিশু। আমার ভাইয়ের নাম শিশু। বড় বোনের নাম মিশু। ছোট বোনের নাম নিশু।

খানে আলম বললেন, আপনার বাবা ছন্দ পছন্দ করতেন মনে হচ্ছে। তা আপনার অন্য ভাই বোন, তারা সব কোথায় থাকেন?

যিশু বলল (এরপর তাকে আর আপনি বলা হবে না), আমার শিশু ভাই আমেরিকা থাকে। সেখানকার সিটিজেন। বোনরা সব ঢাকায়। এক বোনের স্বামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। অন্যজনের স্বামী অবসরপ্রাপ্ত বিচারক।

খানে আলম রেফারেন্স চাইবেন ভেবেছিলেন। যিশুর ভাই-বোনদের পরিচয় পেয়ে চুপ করে গেলেন। বললেন, কবে উঠতে চান মাকে নিয়ে?

যিশু বলল, যত তাড়াতাড়ি হয়। তারপর বলল, অ্যাডভান্স নেবেন না?

অ্যাডভান্স? আমতা আমতা করে বললেন খানে আলম। তারপর বললেন, বেশ ... দিন।

যিশু তার পকেট থেকে হাজার টাকার নোটের একতাড়া বের করে বলল, এখানে এক লাখ আছে। রেখে দিন। আমি লিজ ডিড টাইপ করিয়ে নিয়ে আসবো আগামীকাল, ঠিক আছে?

খানে আলম হাতের কড়কড়ে টাকার দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ। ঠিক আছে। আপনার মাকে নিয়ে আসুন। তাঁকে দেখার বড় ইচ্ছা হচ্ছে। বিরাশি বছরে বই পড়েন চাট্টিখানি কথা!

দুই।।

যিশু তার মাকে নিয়ে এলো দুদিন পর, সঙ্গে কয়েক কার্টন ভর্তি বই। সেই সঙ্গে এলো কয়েকটা বড় বুক শেলফ। তার নিজের জন্য এলো বেশ কয়েকটা ডেস্কটপ কম্পিউটার। ল্যাপটপও দেখা গেল তার হাতে গোটা তিনেক। সে যে কম্পিউটার কিঙ্গোতে একজন গিক বা ভদ্রভাষায় টেকি তা বুঝতে দেরি হলো না খানে আলমের। হুইজকিড বলতে যা বোঝায়। এই প্রথম একজন পড়াশোনা জানা আর প্রযুক্তি নিয়ে চর্চা করে- এমন ভাড়াটিয়া পেয়ে খানে আলম খুব খুশি হলেন। তিনি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করলেন কবে যিশু তার মায়ের সঙ্গে তাকে দেখা করতে নিয়ে যাবে।

কয়েক দিন পর দেখা গেল নিচতলায় যে ফ্ল্যাট যিশু ভাড়া নিয়েছে সেখানে মোটরসাইকেল দিয়ে যুবক বয়সের অনেকে আসছে। তারা বেশিক্ষণ থাকে না। কিছুক্ষণ পর চলে যায়। আর মোটেও হইচই করে না তারা। যখন অনেকে একসঙ্গে থাকে তখনো না। দেখে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। না, যিশুকে ভাড়া দিয়ে ভুল করেননি তিনি। ভালো ছেলে, তার কাছে যারা আসে তারাও ভালো হবে নিঃসন্দেহে।

একদিন যিশু খানে আলমকে তার বাসায় নিয়ে যায়। বসবার ঘরে বসেছিলেন তার অশীতিপর মা। সাদা ধবধবে কাপড় পরে, পুরু কাচের চশমা চোখে তিনি বসেছিলেন হাসিমুখে। দেখে খানে আলমের মনে এমন শ্রদ্ধাভাব এলো যে, তিনি সত্তর বছর বয়সী হওয়া সত্ত্বেও কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে তার পায়ের ধুলো নিলেন। একটুও বিব্রত না হয়ে যিশুর মা তাঁর মাথায় হাত দিয়ে স্পর্শ করে দোয়া করলেন। যেন এভাবে বয়স্কদের দোয়া করা তাঁর অনেক দিনের অভ্যাস।

খানে আলম বসার পর কাজের ছেলে কয়েক প্লেট ভর্তি টক-ঝাল নানা রকমের খাবার নিয়ে এলো। যিশুর মা নিজ হাতে প্লেটে খাবার তুলে খানে আলমের হাতে দিয়ে খেতে বললেন। খানে আলম বিব্রত হয়ে বললেন, আমি এত খাই না খালাম্মা।

যিশুর মা বললেন, খাও। যতটুকু পার। যা ভালো লাগে খাও। তার স্নেহের স্বরে খানে আলম যেন নিজের মায়ের কথা শুনতে পেলেন। খেতে খেতে তিনি বললেন, যিশুর কাছ থেকে শুনলাম আপনি খুব বই পড়েন। কী বই পড়েন?

চেষ্টা করি পড়ার। এখন চোখ তো আগের মতো নেই। একটু পড়লেই ব্যথা করে।

খানে আলম খেতে খেতে যিশুর বড় বোন এলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক স্বামীকে নিয়ে। কথায় কথায় বললেন, মা যিশুকে ছেড়ে কোথাও থাকতে চান না। আমরা দুই বোন মাকে কিছুতেই আমাদের বাড়ি নিয়ে রাখতে পারিনি। যিশু বলতে তিনি অজ্ঞান। তাকে না দেখলে তাঁর ঘুম হয় না।

কথা শুনতে পান তাঁদের মা। ফোকলা দাঁতে হেসে বলেন, ছোট ছেলে। তার কাছেই তো থাকার কথা।

বড় বোন বলেন, যিশু এখনো বিয়ে করল না। এ নিয়ে মায়ের মনে খুব দুঃখ। আমাদের বকেন কেন আমরা তার বিয়ের ব্যবস্থা করছি না। আচ্ছা, বলেন, যিশু কি ছোট যে, তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া যায়?

খানে আলম বলেন, যিশু নিজে পছন্দ করে বিয়ে করলেই হয়। তাকে বলতে হবে কেন?

বড় বোন বলেন, যিশু মনে করে সে এখনো সেটেল্ড হতে পারেনি। তাই বিয়ে করতে চায় না।

খানে আলম বলেন, তার সফটওয়্যারের বিজনেস তো ভালোই চলছে মনে হয়। বিয়ে করলেই পারে। তা হলে খালাম্মার দেখাশোনাটাও ভালো হবে।

বড় বোন বলেন, আমরা দুই বোন তাকে তো সেই কথাই বলি। সে শোনে না।

খানে আলম বললেন, বিদেশে আছেন যে ভাই। তিনি বিয়ে করেছেন তো?

সে দুঃখের কথা বলবেন না। সে-ও বিয়ে করেনি। যমজ ভাইদের এই হয়। একসঙ্গে অসুখ, একসঙ্গে উল্লাস। একসঙ্গে ভয় পাওয়া। তাদের মৃত্যুও কাছাকাছি সময়ে হয় বলে শুনেছি। খুব রহস্যময় যমজদের জীবন। আমি বইতে পড়েছি। বড় বোন খানে আলমের দিকে তাকান। তাঁর মা যেন কী ভাবছেন।

খানে আলম বলেন, দেখি সম্পর্কটা আর একটু ঘনিষ্ঠ হলে আমি বলব তাকে বিয়ের কথা।

শুনে বড় বোন খুশি হন, তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, তা হলে খুবই ভালো হয়। আমাদের কথায় সে এখনো কান দেয় না। আর হ্যাঁ, আপনাকে বলে রাখি। একটা মেয়ের সঙ্গে যিশুর বেশ অনেক দিনের বন্ধুত্ব। ডাক নাম বাণী। দুজনে খুব ভাব, যিশু তাকেই বিয়ে করতে পারে। দেখুন তো রাজি করাতে পারেন কি না।

খানে আলম বোঝেন বাড়িওয়ালা হিসেবে তার দায়িত্ব বেড়ে গেল। এতে তার যে খুব খারাপ লাগছে, তা না।

তিন।।

কিছুদিন যাবার পর খানে আলম দেখলেন যিশুর বাসায় পুলিশ, র‌্যাব এরা আসছেন। অনেকক্ষণ থাকছেন তারা। চা সিগারেট খেয়ে বেশ রিলাক্সড হয়ে চলে যাচ্ছেন। বিষয়টা তাকে ভাবায়। যেহেতু তারা হাসিমুখে আসা-যাওয়া করেন সেই জন্য চিন্তার কিছু আছে বলে তার মনে হয় না। তবু একদিন কৌতূহল চাপাতে না পেরে তিনি যিশুকে একা পেয়ে বলেন, যিশু তোমার কাছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সদস্যরা এত আসেন কেন? কী করেন তারা এখানে?

শুনে একগাল হেসে যিশু বলে, তারা নিজেদের কাজেই আসেন। আমার কাছ থেকে সফটওয়্যার তৈরি করে নিয়ে যান। আমার রেফারেন্স খুব ভালো তো, সেই জন্য আমার ওপর তাদের কনফিডেন্স আছে। জানেন ভালো কাজ করে দেব, টেকসই। গলাকাটা দামও নেব না। কেন নেব বলুন? আমার তো ইনকামের অন্য সোর্সও আছে।

আর কী সোর্স?

সে আপনি বুঝবেন না। খুব কম্পিটিটিভ। হাই ভ্যালু। আমার কানেকশন এতে সাহায্য করে। তারপর সে হেসে বলে, আপনি বাড়ি ভাড়া দিয়ে মাসে নির্দিষ্ট টাকা পেয়েই খুশি। টাকা আয়ের আরও যে কত পথ আছে কিছুই জানলেন না। থাক না জানাই ভালো। যা নিয়ে সন্তুষ্ট আছেন তাই নিয়ে থাকুন। সব কাজ তো সবার জন্য না। ঝুঁকি কজন নিতে পারে বা চায়? আর সবার কি সে বয়স আছে?

খানে আলম দেখেন মোটরসাইকেলে যেসব অল্প বয়সী ছেলেরা আসে তাদের সংখ্যা যেন বাড়ছে। তিনি একদিন এর উল্লেখ করায় যিশু বলল, ব্যবসা বাড়ছে। তাই ফিল্ড ওয়ার্কারদের সংখ্যা বাড়াতে হয়েছে। ওদের নিয়ে আপনি মোটেও ভাববেন না। অল সাইলেন্ট ওয়ার্কার। কেউ হইচই করবে না। তারপর বলে, বাড়ি ভাড়া কি বাড়াতে চান আমার সুদিন দেখে? বাড়াতে পারেন। আমার আপত্তি নেই। আপনার এখানে আসার পর আমার যেন কপাল খুলে গেছে। বেশ আয় করছি। মনে হচ্ছে বাণীকে এ বাড়িতে এখন নিয়ে আসতে পারব।

বাণী? খানে আলমের কাছে নামটা পরিচিত মনে হলো না।

যিশু বলে, আমার অনেক দিনের বান্ধবী। অবস্থা ভালো হলে বিয়ে করব বলেছি। এখন অবস্থা ভালো বলা যায়। সুতরাং আর দেরি করা কেন? খানে আলমের তখন যিশুর বড় বোনের কথা মনে পড়ে। তিনি বাণী নামের মেয়েটার কথা বলেছিলেন তাঁকে। মনে পড়ায় তিনি বললেন, হ্যাঁ। আর দেরি করা কেন?

এই আলাপের এক সপ্তাহ পর রাতের বেলা পুলিশ-র‌্যাব এসে হাতকড়া পরিয়ে যিশুকে যখন নিয়ে গেল খানে আলমের মনে হলো যেন দুঃস্বপ্ন দেখছেন। পরদিন কাগজে যিশুর ছবি ছাপা হলো। খবরে জানা গেল, যিশু মাদকদ্রব্যের ব্যবসায় একজন কিংপিন বলতে যা বোঝায় তাই ছিল। তার এক এজেন্ট ধরা পড়ে জেরার মুখে সব বলে দিয়েছে। মাদক ব্যবসা ছাড়াও যিশু হ্যাকিং করে অনেক অ্যাকাউন্টের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানানো হয়েছে তদন্তকারীদের সূত্রে।

পড়তে পড়তে ঘামে শরীর ভিজে এলো খানে আলমের। তিনি যে যিশুকে বাড়ি ভাড়া দিয়েছেন, এ নিয়ে নিশ্চয় জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসবেন তদন্তকারী সংস্থার সদস্যরা। তিনি আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটালেন। তিনি যিশুর ফ্ল্যাটে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে চুপ করে থাকলেন। এর মধ্যে একদিন যিশুর বড় বোন এসে বললেন, মা, আপনাকে খুঁজছেন। জানতে চাইছেন আপনি অসুস্থ কি না।

আমি সুস্থ আছি। কিন্তু আপনার ভাই এ কি কান্ড করেছে? আমি ভাবতেও পারিনি। এমন সব আত্মীয়স্বজন, শিক্ষিত পরিবার। তার কাছ থেকে এটা আশা করা যায়নি। ছি ছি। এখন আমিই বিপদে পড়তে পারি।

যিশুর বড় বোন বলেন, কেন, আপনি বিপদে পড়বেন কেন?

পড়ব না? আমার ভাড়া দেওয়া ফ্ল্যাটেই তো এই বেআইনি কারবার চলেছে। আমি কি এক্সেসারি হয়ে গেলাম না?

খানে আলমকে বেশ বিপন্ন দেখায়।

যিশুর বড় বোন বলেন, আপনি ভাববেন না। ভালো ল’ইয়ার নিযুক্ত করা হয়েছে। যিশু বেকসুর খালাস পাবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

কয়েক দিন পর কাগজে আবার যিশুর ছবি দেখা যায়। বিচারাধীন আসামি পালাবার সময় গুলিতে মৃত্যুবরণ করেছে। খানে আলম জানতেন এমন একটা কিছু হবে। এ ধরনের কেস অনেক ক্ষেত্রে এভাবেই শেষ হয়। তিনি কাগজ পড়ে জেনেছেন। তিনি ভাবেন এরপর আর কী হবে, হতে পারে?

বাড়ি ছাড়ার নোটিস দেবেন এমন সময় একদিন খানে আলম দেখেন যিশু তার মায়ের সঙ্গে বারান্দায় এসে মানিপ্ল্যান্ট দেখছে। ভূত দেখার মতো চমকে ওঠেন তিনি। ততক্ষণে যিশুর মা তাঁকে দেখে ফেলেছেন। হাত তুলে ডেকে বললেন, আসেন না কেন? নতুন বই এসেছে। শরদিন্দুর লেখা। ব্যোমকেশের সাংঘাতিক গোয়েন্দাগিরি। শোনাব আপনাকে। আসুন।

খানে আলমের চোখ যিশুর দিকে। সে স্বাভাবিকভাবে মায়ের সঙ্গে কথা বলছে, হাসছে। অবশ্য হাসিটা আগের মতো মনে হচ্ছে না। তার গায়ের রংটাও যেন একটু বেশি ফর্সা। সে খানে আলমের দিকে তাকিয়ে বলে, আসুন না। আমরা এখন চা খাব।

খানে আলম যাব না, যাব না করেও গেলেন। বসবার ঘরে সাদা ধবধবে শাড়ি পরে সোফায় বসে আছেন যিশুর মা। তাঁর মুখে প্রসন্ন হাসি। তাঁকে দেখে হাসি বড় হলো। তিনি বললেন, থাক থাক সালাম করতে হবে না। ওটা প্রথম দিনই করা যায়। এরপর আর কেন? বসুন। অনেক দিন আপনার সঙ্গে গল্প করা হয়নি। কী হয়েছিল? অসুখ-বিসুখ? তা এ বয়সে মাঝে মাঝে বিছানায় যেতে হয়। কী করবেন? যাই হোক, এখন তো সুস্থ। আগের মতো খাবেন-দাবেন। গল্প করবেন।

যিশুর মা একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছেন। খানে আলম তার কথা কিছু শুনছেন, কিছু শুনছেন না। তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন যিশুর দিকে।

বেশ কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে থেকে তিনি যিশুর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, যিশু কোথায়?

যিশুর বিরাশি বছরের মা সামনে বসে থাকা যুবকের দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, কেন, ওই তো যিশু।

একটু পর যিশু ঘর থেকে মায়ের পড়ার জন্য বই আনতে বেরিয়ে গেল। যিশুর মা তার দিকে গলা বাড়িয়ে স্বর নামিয়ে বললেন, একসঙ্গেই তো এসেছে দুজন। এক মিনিট আগে পরে। কিন্তু আমি তফাতটা ঠিকই ধরতে পারি। সবাই মনে করে আমি কিছু টের পাই না।

একটু পর যিশু তার মায়ের জন্য শরদিন্দুর ডিটেকটিভ বই নিয়ে ঘরে ঢোকে। তার মা বইটা হাতে নিয়ে পাতা উল্টান। দেয়ালে একটা টিকটিকি ডেকে ওঠে। ঠিক। ঠিক। ঠিক।

যিশু খানে আলমের দিকে ঝুঁকি নিয়ে নিচু স্বরে বললো, আপনার সঙ্গে কথা আছে।

খানে আলম বলতে চাচ্ছিলেন, তার সঙ্গেও তার কথা কথা আছে। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না।

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর