শুক্রবার, ৩১ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

মানবতার দেয়াল

ইকবাল খন্দকার

মানবতার দেয়াল

সকালে অফিসে যাওয়ার সময় রিকশা পাওয়া প্রত্যেক চাকরিজীবীর মৌলিক অধিকার। সাদিক অন্তত এমনটাই মনে করে। অথচ সে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় প্রায় প্রতিদিন। রিকশাওয়ালারা বসে বসে সিগারেট টানে, যাওয়ার কথা বললে আকাশ-পাতাল ভাড়া চায়। বোঝাই যায়- যেতে চাচ্ছে না। আজগুবি ভাড়া হাঁকিয়েছে যাত্রী তাড়ানোর জন্য। কিন্তু কেন? যাত্রী তোলার ব্যাপারে এত অনীহাই যদি থাকবে, তাহলে রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামলি কেন? ঘরে বসে বা বিছানায় শুয়ে সিগারেট টানতি!

রিকশা না পেয়ে অন্য দিনের মতো আজও হনহনিয়ে হাঁটছিল সাদিক। হঠাৎ পা থেমে যায় তার। ক্লান্তির জন্য না, রিকশা পেয়ে যাওয়ার কারণেও না। পা থামে রাস্তার পাশের মানবতার দেয়ালে চোখপড়ার কারণে। সে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে দেয়ালটার দিকে। সময় গড়ায় কিন্তু তার চোখ সরে না। এরপর যখন সে সম্বিৎ ফিরে পায় এবং ঘড়ির দিকে তাকায়, তখন প্রায় আঁৎকে ওঠে। কারণ, চাকরি হারানোর আতংক তাকে পেয়ে বসে। সে তার এলাকার ছোটভাই মাসুমকে ফোন করে একটা দায়িত্ব দিয়েই দৌড়াতে থাকে।

এবার ভাগ্য সহায় হয় সাদিকের। সে একটা রিকশা পেয়ে যায়। তাও রকেট-গতির রিকশা। যে কারণে অফিসে পৌঁছে যেতে পারে একদম সঠিক সময়ে। তবে কাজে মনোযোগ দিতে পারে না। সে নিজের সিটে কিছুক্ষণ অহেতুক বসে থাকার পর চলে যায় বারান্দায়। আর ফোন করে মাসুমকে। জানতে চায় দায়িত্বটা ঠিকমতো পালন করেছে কি না। মাসুম তাকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলে। বলে- জিনিসটা আমার কাছে আছে। আপনি যখন বলবেন, যেখানে বলবেন, আমি নিয়ে আসব।

অফিস ছুটির পর সাদিক লিফটের জন্য অপেক্ষা না করে দৌড়াতে দৌড়াতে নামে সিঁড়ি দিয়ে। আর উঠে বসে সিএনজিতে। সাধারণত অফিসে যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে সে রিকশা ছাড়া অন্যকোনো বাহনের কথা ভাবে না। আজ ভেবেছে অনেকটা অবচেতন মনে। ভাবনার কারণ- দ্রুত মাসুমের কাছে পৌঁছানো। তার কাছ থেকে আমানতটা বুঝে নেওয়া। চেংড়া ছেলেপুলের সঙ্গে বিশ্বাস আছে? যদি হারিয়ে ফেলে!

সাদিকের শঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হয়। কারণ, মাসুম তাকে জামাটা এমন যত্ন সহকারে বুঝিয়ে দেয়, যেন এটা কাপড় না; বরং স্বর্ণের তৈরি কোনো জিনিস। সাদিক কৃতজ্ঞতায় আবেগ প্রবণ হয়ে যায়। মাসুম বলে- এইটার প্রতিবাদ হওয়া উচিত ভাই। সারা জীবন তো শুধু সহ্যই করে গেলেন। আর কত? প্রতিবাদে হয়তো কোনো কাজ হবে না। সব প্রতিবাদে কাজ হয়ও না। তবু করতে হয়। এতে আর কিছু না হোক, মানসিক শান্তিটা অন্তত পাওয়া যায়।

মাসুমের কথা আমলে নিয়ে সন্ধ্যার পর মৃধা ভিলার গেটে গিয়ে হাজির হয় সাদিক। দারোয়ান লিফটের গোড়ায় কী যেন করছিল। তাকে দেখে এগিয়ে আসে। জানতে চায় কার কাছে এসেছে। সাদিক উত্তর দেয় না। সে সামনে তাকায়, উপরের তলাগুলোর দিকে তাকায়। তারপর এটা ওটা বলে আলাপ জমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু দারোয়ান আগ্রহী হয় না। সে রসকষহীন গলায় বলে- আমি জানতে চাইছি আপনে কার কাছে আসছেন।

: আপনি এমনভাবে কথা বলছেন, যেন আমাকে কোনো দিন দেখেনইনি। কিন্তু আপনি তো আমার পরিচিত। অনেকদিনের পরিচিত। আর অনেকদিনের পরিচিত মানুষকে আপন মানুষ ভাবাই যায়। সাদিক কথাগুলো বলে সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে।

: আপনেও আমার অনেকদিনের পরিচিত। এই রাস্তা দিয়া অফিসে যাইতে দেখি। ফিরতে দেখি। এমনিতেও ঘোরাঘারি করতে দেখি। কিন্তু কোনো দিন কথা হইছে বইলা মনে হয় না। আজকা যখন আগায়া আইসা কথা বলতেছেন, অবশ্যই কোনো না কোনো উদ্দেশ্য আছে। না না না, আমি খারাপ কোনো উদ্দেশ্যের কথা কিন্তু বলি নাই।

: কেন বলবেন? আপনার মন তো পরিষ্কার। আর পরিষ্কার মনের মানুষ কাউকে অকারণে সন্দেহ করে না। কারও মধ্যে খারাপ কোনো উদ্দেশ্য খোঁজে না। তারা সবসময় মানুষের ভালো দিকটাই দেখে। অবশ্য এক্ষেত্রে পারিবারিক শিক্ষারও দরকার হয়। আপনার সেই শিক্ষাটা আছে।

সাদিকের প্রশংসায় মন গলে না দারোয়ানের। সে বিরক্তির সঙ্গে রাগ মিশিয়ে বলে- আপনে শুধু শুধু কথা বাড়াইতাছেন ভাই। আপনের বোঝা উচিত, আমরা খুব ছোট চাকরি করি। আর ছোট চাকরি চইলাও যায় ছোট কারণেই। যদি কোনো ফ্ল্যাট মালিক দেখে আপনের সঙ্গে আমি খাজুইরা আলাপ করতেছি, চাকরি ‘নট’ কইরা দিতে পারে। এই বিল্ডিংয়ে এমন ঘটনা আগে অনেকবার ঘটছে।

সাদিক এবার স্পষ্ট জানিয়ে দেয় আশিকুর রহমানের বাসায় যাবে। আর বলে গেটটা খোলার জন্য। ডান হাতের তালু দিয়ে মৃদু ধাক্কাও দেয়। কিন্তু দারোয়ান খোলে না। সে জানতে চায় আশিকুর রহমানের সঙ্গে কথা হয়েছে কি না। সাদিক আমতা আমতা করে। তারপর যতটা সম্ভব দ্বিধাহীন উচ্চারণেই বলে- উনার সঙ্গে আমার বন্ধুর মতো সম্পর্ক তো! এই জন্য বলাবলির দরকার পড়ে না। আসলে উনি নিজেই সবসময় বলেন, যখন খুশি চলে আসবে। আগে থেকে জানাতে হবে না।

: কিন্তু এইটাও তো ঠিক, আপনে আজকা প্রথম আসছেন। আগে কোনো দিন আসেন নাই। ঠিক কি না? তদন্ত কর্মকর্তাদের মতো কথাগুলো বলে সাদিকের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে থাকে দারোয়ান।

: আগে না আসলে কোনো দিনই যে আসা যাবে না, এমন কিন্তু আইন নেই। নাকি আছে? সাদিক কৌতুক করতে চায়।

: দেখেন, আপনে আপনের বন্ধুর বাসায় ‘ডেলি’ যদি একবার কইরাও আসেন, আমার কোনো লস নাই। তবে নিয়ম মানতে হইব। গেট থেকে ইন্টারকমে ফোন দিতে হইব। যদি পার্মিশন পাই, ঢুকতে দিতে পারমু। আর না পাইলে মাফও চাই, দোয়াও চাই। এখন সমস্যা যেইটা হইছে, ইন্টারকম নষ্ট এক সপ্তাহ ধইরা। এজন্য ফোন দিতে হইব মোবাইলে।

সাদিক দারোয়ানকে বলে আশিকুর রহমানকে ফোন দিতে। কিন্তু সে রাজি হয় না। জানায় ফ্ল্যাট মালিকদের মোবাইলে সরাসরি ফোন দেওয়ার সাহস তাদের নেই। আর বলে ফোনটা যেন সাদিক দেয়। তারপর মোবাইলটা ধরিয়ে দেয় তাকে। এবার সাদিকের গলা শুকিয়ে আসতে শুরু করে। কারণ সে জানে আশিকুর রহমান কী উগ্র মেজাজের মানুষ। তিনি যখন তার পরিচয় জানবেন, তখন শুধু গালিগালাজ করে ক্ষান্ত হবেন না, পুলিশও ডাকতে পারেন।

 সাদিক এই এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়েছে প্রায় তিন বছর আগে। এই তিন বছরে সে আশিকুর রহমানের মুখোমুখি হয়েছে মাত্র একবার। অবশ্য আরও দু-একবার মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। সে অতি সতর্কতার সঙ্গে পাশ কাটিয়ে গেছে। কারণ, ওই একবারের দুঃসহ স্মৃতিই সে ভুলতে পারেনি। বাপরে বাপ, কী কলিজা-কাঁপানো ধমক! কী হুমকি! তার বাড়ির আশপাশে দেখলে নাকি গায়ের চামড়া ছিলে লবণ লাগিয়ে দেবে।

আজ যখন বাসা থেকে মৃধা ভিলার উদ্দেশে রওনা হয়েছিল, তখনও সেই হুমকির কথা মনে পড়ছিল সাদিকের। তবু সে ঘাবড়ায়নি। বুকে সাহস রেখেছিল। কিন্তু দারোয়ানের কথা শুনে সেই সাহস আর অবশিষ্ট থাকতে চায় না। অনেকটা ‘ভিক্ষা চাই না কুত্তা সামলাও’ অবস্থা। এবার কী মনে করে যেন গেট খোলে দারোয়ান। বলে- আপনের মতিগতি দেইখা সন্দেহ হইতাছে, আপনে কোনো ঝামেলার মধ্যে আছেন। কী ঝামেলা বলেন তো!

সাদিক জোর করে হাসে। হেসে উড়িয়ে দিতে চায় দারোয়ানের মনের সব সন্দেহ। কিন্তু যে সন্দেহ পাথরের মতো ওজনদার, গাছের মতো শেকড় বিস্তারকারী, তাকে উড়িয়ে দেওয়া কি এত সহজ? সাদিক যখন বুঝতে পারে তার হাসি বিফলে যাচ্ছে, তখন সে কেটে পড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু দারোয়ানও কম চালাক না। সে তার পথ আগলে দাঁড়িয়ে যায়। বলে- আমরা আপনেরার মতো অত লেখাপড়া করি নাই। তবে একটা যোইগ্যতা কিন্তু আছে। এই যোইগ্যতা না থাকলে দারোয়ানের চাকরি করা যায় না।

 সাদিক বুঝতে চেষ্টা করে দারোয়ান কোন যোগ্যতার কথা বলছে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। তাই সে তাকিয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে। আর দারোয়ার তার দিকে এক কদম এগিয়ে এসে বলে- আমরা মানুষের চোখ দেখলেই বইলা দিতে পারি কী বলতে চায়, কী করতে চায়। খোঁজ নিয়া দেখেন, এই যোইগ্যতা ঢাকা শহরের প্রত্যেকটা দারোয়ানের আছে। কারও কম, কারও বেশি। আপনে কী বলতে আসছেন, কী করতে আসছেন, সব আমার বোঝা হইয়া গেছে। এই জন্য আমি আপনেরে একটা পরামিশ দেই। আপনে চইলা যান।

: দেখেন, আপনি মনে হয় আমাকে ভুল বুঝছেন। সাদিক ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে বলে।

: ভুল বোঝার কী আছে? আশিক স্যারের বউয়ের সাথে আপনের প্রেম ছিল না?

সাদিক এবার লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলে। দারোয়ান তবু কথা থামায় না- আপনে হয়তো চিন্তা করতেছেন আমি বিষয়টা ক্যামনে জানলাম। আসলে এইসব বিষয় গোপন থাকে না। কোনো না কোনোভাবে জানাজানি হইয়া যায়। আশিক স্যারের বাসায় মরিয়ম নামে একটা মাইয়া কাজ করে। তার সাথে আবার আমার ভালো খাতির। সে কইলো, স্যার যখন বউয়ের সাথে ঝগড়া লাগে, তখনই নাকি বারবার একটা নাম বলতে থাকে। সাদিক। কেন বলতে থাকে? কারণ, বিয়ার আগে স্যারের বউয়ের সাথে মানুষটার প্রেম ছিল।

সাদিক গাঁইগুই করে বোঝাতে চায়, দেশে সে একাই সাদিক না। আরও অনেক সাদিক আছে। দারোয়ান বলে- নিজেরে এত চালাক ভাইবেন না। আর আমারে বেক্কল ভাইবেন না। আমি কিন্তু সব বুঝি। আবার গোয়েন্দাগিরিটাও ভালোই করতে পারি। আমি প্রায় এক মাস গোয়েন্দাগিরি কইরা যেইটা জানতে পারছি, আশিক স্যারের বউ মিতু ম্যাডামের সাথে আপনে আট-দশ বছর প্রেম করছেন। কিন্তু আপনের চাকরি ছিল না, ফ্যামিলিও গরিব, এই জন্য বিয়া করতে পারেন নাই।

সাদিকের বন্ধ চোখ এরই মধ্যে খুলে গেলেও তার লজ্জা কাটে না। আর দারোয়ান তা বুঝতে পেরে তাকে টেনে নিয়ে যায় গেট-সংলগ্ন ছোট্ট রুমে। একটা চেয়ারে বসিয়ে বলে- আপনে এত লজ্জা কী জন্য পাইতেছেন, বুঝলাম না। আরে এইগুলা তো কমন ঘটনা। তবে আপনের কিন্তু ধৈর্য আছে ভাই। নিজে তো আজকা পর্যন্ত বিয়া করলেনই না, আবার বাসা ভাড়া নিলেন প্রেমিকার জামাইর এলাকায়। যাতে আসা-যাওয়ার পথে তারে দেখতে পারেন। কিন্তু কোনো লাভ কি হইছে?

সাদিক জানায়, তেমন কোনো লাভ হয়নি। যেহেতু গত প্রায় তিন বছরে মিতুকে সে দেখতে পেয়েছে মাত্র চারবার। সামনাসামনি একবার, বাকি তিনবার দূর থেকে। আর কথা বলার সুযোগ পেয়েছে মাত্র দুবার। একবার সামনাসামনি, একবার মোবাইলে। এর পর তার নাম্বার সেই যে বন্ধ হয়েছে, এখনও বন্ধই আছে। দারোয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে- কষ্ট পাইয়েন না ভাই। আপনে উনার লাইগা যত কিছুই করেন না কেন, উনি কিন্তু আপনেরে ভুইলা বইসা আছে। একটা পরামিশ দেই? আপনে এই এলাকা ছাইড়া চইলা যান। আর দেইখা-শুইনা একটা বিয়া করেন।

তাকে বিশ্বাস করাতে চায়, মেয়েরা ছলনাময়ী, নির্দয়। ধনী স্বামীর সংসারে প্রবেশের পর দরিদ্র প্রেমিককে ভুলতে তাদের এক সেকেন্ড সময়ও লাগে না। এবার সরব হয় সাদিক। বলে- সব ঠিক আছে। কিন্তু সে আমার একটা অনুরোধ তো রাখতে পারত! জাস্ট একটা অনুরোধ। আমি তাকে বলেছিলাম আমার উপহার দেওয়া জামাটা যেন যত্নে রাখে। সে কথা দিয়েছিল, রাখবে। ওয়াদাও করেছিল। তাহলে কীভাবে সে জামাটা মানবতার দেয়ালে ঝুলিয়ে দিতে পারল?

সাদিকের হাহাকার-ভরা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না দারোয়ান। সে পারে কেবল সান্ত্বনা দিতে। যদিও এই সান্ত্বনায় হাহাকার কমে না সাদিকের। সে বন্ধু-স্বজনদের কাছেও খুঁজে বেড়ায় তার সেই প্রশ্নের উত্তর। কীভাবে মিতু উপহারের জামাটা ঝুলিয়ে দিতে পারল মানবতার দেয়ালে? প্রেমিককে দেওয়া ওয়াদা ভঙ্গ করতে তার বুক একটুও কাঁপল না? মানুষ পাষাণ আর নির্দয় হলে এতটাই হয়?

দুদিন পর সাদিকের প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আসেন স্বয়ং আশিকুর রহমান। ফোনে তিনি জানান বিদেশের এক হাসপাতালে বছর খানেক আগে আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে মিতুর। দাফন-কাফনও হয়েছে বিদেশের মাটিতেই। যে কারণে ঘনিষ্ঠজনরা ছাড়া তেমন কেউ এই মৃত্যুর খবর জানে না। আর যে মানুষটা নেই, তার জামা-কাপড় রেখে কী হবে? তাই মানবতার দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া।

 

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর