শিরোনাম
শুক্রবার, ৭ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা

একটু কথার জন্য

হোসেন আবদুল মান্নান

একটু কথার জন্য

অনেকবার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সে পারলই না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুধু একটা কথা বলার সাহস সঞ্চয় করতে পারেনি জলিল। তবুও সে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকার পাত্র নয়। রোজ সকালে বাইসাইকেলে চড়ে অন্তত দশ মাইল যাওয়া-আসা করে। একজন সরকারি কর্মচারী যেমন চাকরির মায়ায় রুটিন করে অফিসে যাতায়াত করে, জলিলও তেমনি সাজগোজ পরিপাটি বেশে হররোজ বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। তার গতিবিধির ওপর পরিবারের কেউ নাক গলাতে যেত না। পরিবার বলতে তার অশীতিপর মা আর এক ভাইয়ের সংসার। বাবা আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। অবস্থাসম্পন্ন ঘরের শিক্ষিত যুবক জলিল। তার স্বাধীনতা আছে, সামর্থ্যও আছে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ানোর, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার, শহরে গিয়ে সিনেমা দেখার আরও অনেক কিছু করার।

ইদানীং একটা নেশায় পড়ে নিত্যদিন সে বাড়ি থেকে বের হয়। ইতোমধ্যে স্থানীয় নিকটাত্মীয়-স্বজন বা পরিচিতজনের মধ্যে দিব্যি ধারণা জন্মেছে যে, জলিল হয়তো গ্রামের কোনো হাইস্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিয়েছে। তাছাড়া তার যাওয়া-আসার সঙ্গে স্কুলের সময়সূচিরও একটা যোগসাজশ ও মিল রয়েছে।

দুই.

জলিল বি.এ. পাস যুবক। দেখতে সুদর্শন এবং ব্যাচেলর। অতীব ভদ্র অমায়িক এবং লাজুক স্বভাবের মানুষ। গ্রামের উচ্চবিত্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিক্ষিত সন্তান বলতে যা হয়। তার বাবা দাদারা কলকাতার মুসাফির ছিলেন। ব্রিটিশ ভারতের কলকাতা শহরে তাদের বেশ ভালো ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। তার বাবা আলীম দাদ খান দেশভাগের সময় দাঙ্গার কবলে পড়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের ভেতর দিয়ে প্রায় শূন্য হাতে কলকাতা ত্যাগ করে এসেছিলেন। সেই লোমহর্ষক গল্প স্থানীয় সমবয়সি লোকজন জানতো। খান সাহেব ছিলেন একজন অসাধারণ ধার্মিক, অমায়িক, বন্ধুবাৎসল, সৎ ও পরিশ্রমী মানুষ। তবে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পরই তিনি কলকাতায় ফিরে গিয়ে পুনরায় ব্যবসা শুরু করেছিলেন এবং ১৯৬৫ সাল অবধি সেখানে থেকে প্রচুর অর্থকড়ি নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন। সেই থেকে জলিলদের অবস্থা গাঁয়ের সকলের চেয়ে ভালো। দালানকোঠার বাড়িঘর রয়েছে তাদের। এদের পারিবারিক সচ্ছলতার কথা গোটা উপজেলাজুড়েই মানুষ জানে।

বি এ পাস করার পর থেকে গ্রামের বাড়িতেই বসবাস করছে জলিল। উড়ুউড়ু মন তার, পারিবারিক কাজে মন বসছে না। বয়সের স্বাভাবিকতায় যা হয়। বছরখানিক ধরে সে এখানে সেখানে ঘোরাঘুরি করেই কাটাচ্ছে। তবে চাকরিবাকরি করার খুব বেশি আগ্রহ কখনো দেখায় না জলিল। পৈতৃক সূত্রে বিশাল ধন-সম্পদের মালিক হওয়ায় চাকরি তাকে মোটেও টানে না। এসব নিয়ে সে কখনো ভাবে না। একদিন এক বন্ধুর সঙ্গে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে বেড়াতে গিয়ে ফতেপুর বাজারের বড়ো রাস্তায় সে মুখোমুখি হয়েছিল এক সুন্দরী তন্বী স্কুলছাত্রীর। ছুটির পরে একদল ছাত্রী গল্প করতে করতে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল। তারা পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে যাচ্ছিল, আর পশ্চিম থেকে পূবে আসছিল জলিলরা। তখন সন্ধ্যার পূর্বের এক কোলাহলমুখর পরিবেশ বিরাজমান ছিল। জলিলের চোখে গোধূলির আলোতে ঝলমল করছিল সবার থেকে আলাদা ও অপেক্ষাকৃত লম্বা মেয়েটার চেহারাটা। মুহূর্তে যেনো তার হৃদয়ে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। হঠাৎ করে তার চোখে-মুখে অজানা এক ঘোর লাগা আমেজ চলে আসে। তার দেখা সবচেয়ে আকর্ষণীয় মেয়েটির নামধাম জানতেই হবে। প্রথমে নানা কায়দায় সে মেয়েটির নাম জানার চেষ্টা চালায়। শেষে স্কুলের দফতরি লাল মিয়াকে মোটা অংকের বকশিস দিয়ে মেয়ের নাম ও ঠিকানা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিল জলিল। সে দশম শ্রেণির ছাত্রী, নাম শশী। বাবা সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী ও গ্রামের ধনাঢ্য শ্রেণির মানুষ। লেখাপড়ায় প্রথম শ্রেণির না হলেও শশী সত্যিই অপরূপা ও অনুপমা সুন্দরী। এ কথা সত্যি যে, মেয়েটির সৌন্দর্যের গল্প কেবল তার স্কুলকেন্দ্রিক নয় এর মধ্যে গোটা এলাকায় রাষ্ট্র হয়ে আছে।

তিন.

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সেই পথের এক নজর দেখা এবং তাৎক্ষণিক ভালো লাগা থেকে জলিলের দৈনন্দিন ডিউটি শুরু হয়ে গেল। তখন থেকেই মেয়েটার স্কুলের পথে পথে তার অপেক্ষার পালা চলছে। সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে বাইসাইকেল থেকে একবার দেখে আবার বাড়ি ফেরার সময় আরও একবার। কয়েক মাস ধরে কেবল সাইকেলে চড়ে বিপরীত দিক থেকে আসা যাওয়ার পথে একপলক তাকিয়ে যেতো জলিল। পথচারীদের মতন করে সে নিত্যদিন অন্তত দুবার তাকে দর্শন করে চলেছে। যদিও অল্প কিছু দিনের মধ্যেই মেয়েগুলো ঠাহর করতে পারে যে, তিনি একজন কর্মহীন বেকার রোমিও ছাড়া আর কিছু নন। মেয়েরা নাকি প্রকৃতিগতভাবেই অতিরিক্ত সিকসেন্স নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। পুরুষ মানুষকে চেনার ক্ষমতা এদের জন্মগত। তখন থেকে তারা জলিলের বাইসাইকেল দেখে পূর্ব থেকেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়তো। সে যতই কাছাকাছি আসতে থাকে মেয়েগুলোর হাসির বন্যা যেনো বাঁধ ভাঙতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে জলিল আরও ঘাবড়ে যায়, লজ্জায় মুখ লাল হয় এবং ক্রমেই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। সাহস আর আত্মবিশ্বাসের অভাবে সে একবারও কিছু বলতে পারছে না। তাছাড়া শশীকে সে এক মুহূর্তের জন্যেও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পায় না যে একটা কিছু বলবে। এভাবে মাসের পর মাস চলে গেলেও তার এমন সুযোগ হয়ে আর ওঠে না। সমস্ত ঘটনা বুঝতে পেরে শশীও প্রথম প্রথম এটাকে টিনএজ আনন্দ আর ফান হিসেবে নিয়েছিল, কিন্তু বছরের পর বছর একটা মানুষ এমন করতে পারে, এটা তার কাছে অসহ্য হয়ে ঠেকতে শুরু করলো এবং সে বলতে শুরু করলো, এমন ভীতু কাপুরুষের ভবিষ্যৎ কী হবে? তবে সে বিষয়টি পরিবারের কাউকে জানাতে চায়নি, এমনকি স্কুল কর্তৃপক্ষকেও নয়। এমন পরিস্থিতিতে মেয়েরা সচরাচর তা-ই করে থাকে।

তখন বৈশাখ মাস। চারদিকে উত্তপ্ত গরম হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। কৃষকের ঘরে ঘরে ধান কাটার ধূম পড়ে গেছে। আকাশে সাদা মেঘের বিরতিহীন দৌড়াদৌড়ি। কখনো রোদ কখনো বৃষ্টি। জলিলদের বাড়িতেও কাটা বোরো ধান থেকে সোঁদাগন্ধ বের হচ্ছে। কাজের লোকগুলো ধান তোলায় গলদঘর্ম হচ্ছে। এমন সময় বাড়ি থেকে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে সে। কিছুদূর যেতেই গাঢ় অন্ধকার হয়ে আসছে চারপাশ, মুহূর্তে মধ্যে ভরদুপুরে যেনো সন্ধ্যা নেমে আসলো। আকাশ থেকে বিকট গর্জন হতে বজ্রপাতসহ কালবৈশাখীর ঝড়ের সঙ্গে শিলাবৃষ্টি শুরু হলো। উপায়ান্তর না পেয়ে জলিল রাস্তার পাশের এক বাড়িতে গিয়ে বাইসাইকেলসহ আশ্রয় নিল। সেখানে তার সঙ্গে আরও কয়েকজন পথচারী আশ্রয় নেয়। তারা জলিলকে তার বাবার পরিচয়সহ চেনে ও জানে। তখন হঠাৎ করে একজন বয়স্ক মানুষ রাখঢাক না মেনেই বলে ওঠে,

এই যে বাবা,

তুমি তো খান সাহেবের ছেলে?

প্রত্যেক দিন তুমি যে ফতেপুর বাজারের দিকে যাও, কাজটা এখনো হয় নাই? প্রায় বছরখানেক ধরে তোমারে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখতেছি। ব্যাপারটা বুঝলাম না।

জলিল অপ্রস্তুত হয়, লজ্জা পায়,

তার মুখ লাল হয়ে ওঠে।

না না, তেমন কোনো কাজ না,

আশা করি হয়ে যাবে।

দোয়া করবেন চাচা।

এ কথা বলেই জলিল হালকা বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় বের হয়ে আসে।

সে মনে মনে বলছে, লোকজন যা বলার বলুক, কিচ্ছু আসে যায় না,

আমাকে শশীর স্কুল পর্যন্ত যেতেই হবে।

চার.

প্রায় দু’বছরের সাধনা জলিলের।

অপেক্ষা আর কালক্ষেপণ সহ্য হচ্ছিল না তার। এদিকে মাত্র ক’দিন হলো শশীর এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে।

এখন তার পক্ষে প্রতিদিন স্কুলে আসার সুযোগ হবে না। স্কুল বন্ধ থাকলে কী অজুহাতে সে বাড়ি থেকে বের হবে? এসব চিন্তা জলিলকে উদ্বিগ্ন ও চিন্তাক্লিষ্ট করে তুলতে থাকে। তার ব্যক্তিগত সমস্যার কথা সে দু’একজন বন্ধুর কাছে শেয়ার করলেও পরিবারের বড়ো ভাই বা বৃদ্ধা মাকে তখন পর্যন্ত কিছুই বলছে না। একদিকে মেয়ের সঙ্গে একবারও কথা বলতে না পারার দুঃখবোধ, অন্যদিকে এখন তাকে পূর্বের ন্যায় দেখতে না পাবার পরিস্থিতি তাকে যেনো ভীষণ অস্থির ও অসহিষ্ণু করে তুলেছে। সে স্থির করতে পারছে না কোন পথে অগ্রসর হলে সফলতা আসবে। পারিবারিকভাবে শশীর বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠালে ভালো হবে, নাকি প্রথমে তার স্কুল শিক্ষকের মাধ্যমে সরাসরি মেয়েটিকে বিয়ের কথা জানাবে, সে মারাত্মক দোদুল্যমানতায় ভুগছে। গত সপ্তাহে মেয়েটির পরীক্ষা শেষ হয়েছে। রেজাল্ট বের হতে অন্তত চার-পাঁচ মাস সময় লাগবে। যা কিছু করার আছে এরই ভেতরে করতে হবে। তার হাতে সময় কম।

মাত্র কয়েকদিন আগে কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বসে থাকা এক কৃশকায় জবুথবু বৃদ্ধ হস্তরেখা বিশারদকে তার হাত দেখানোর পর থেকে জলিলকে যেনো কেমন একটা অন্যমনস্কতা পেয়ে বসেছে। সেই অখ্যাত অপরিচিত জ্যোতিষী তার হাতের তালুর ওপরে একটা আধ ময়লা গোলাকার কাঁচ বসিয়ে মুহূর্তের মধ্যে বলে দিল তোমার বিয়েশাদি দুরস্ত। সেদিন থেকেই জলিল কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ করছে, অবিন্যস্ত, এলোমেলোভাবে সময় কাটাচ্ছে; তার ঘুম, খাওয়াদাওয়া, চলাফেরায় হঠাৎ ছন্দ পতন ঘটেছে। কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে, কী করলে শশীকে রাজি করানো সম্ভব হবে তার এখন একটাই ভাবনা।

শশীদের স্কুলটা রেলস্টেশন থেকে একেবারে নিকটে অবস্থিত। বলা যায় পাঁচ মিনিটের হাঁটার পথ। আষাঢ় মাসের দুপুর বেলা। জলিল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সোহরাবকে নিয়ে ট্রেনে করে সাগরপুর স্টেশনে এসে নিভৃতে অবতরণ করে। জলিলের বাড়ি এবং শশীদের স্কুলের মধ্যে মাত্র একটা স্টেশনের ব্যবধান। ট্রেনে পনেরো মিনিটের বেশি লাগে না। তারা পায়ে হেঁটে শশীর স্কুল ফুলতলা গার্লস একাডেমির গেট বরাবর পৌঁছে যায়। স্কুলের দারোয়ান বিমল ও বয়স্ক পিয়নটার সঙ্গে ইতোপূর্বেই জলিলের সখ্য সৃষ্টি হয়েছিল। দারোয়ানের নিকট থেকেই সে শশীর ইংরেজির শিক্ষক রফিক মিয়ার খোঁজ খবর নিত। রফিক মাস্টার ইংরেজি পড়ান। তিনি স্কুলের একজন নামকরা শিক্ষক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজির এম এ। বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মাঝামাঝি হবে।

বিবাহিত ও দুই কন্যা সন্তানের জনক। বিকাল থেকে রাত অবধি তার প্রাইভেট টিউশনি লেগেই থাকে। এ কথা সত্যি যে, মফস্বলের ছাত্র ছাত্রীদের কাছে অঙ্ক আর ইংরেজিই প্রাইভেট পড়ার জন্য প্রধান সাবজেক্ট। শশীও তার কাছে এক বছরের বেশি সময় ধরে প্রাইভেট পড়ে আসছে। তবে তার শিফট হলো সন্ধ্যার পরে। জলিল ওইদিনই রফিক মাস্টারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে সক্ষম হলো এবং তার দীর্ঘদিনের সাধনা ও মনোবাসনার কথা তাকে জানায়। মাস্টার সাহেবও তার বিষয়টা মনোযোগ ভরে শুনলেন এবং তাকে আশ্বস্ত করলেন। সেদিন সেই প্রাইভেট শিক্ষককের হাতে তার এমন জীবন সংহারক দায়িত্বটি তুলে দিয়ে একটা লম্বা হাফ ছেড়ে সে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে এসেছিল।

পাঁচ.

ইংরেজির শিক্ষক রফিক বিষয়টি জেনে কিছুটা ঈর্ষান্বিত ও বিব্রতবোধ করেন। মনে মনে ভাবছেন, যে কারণে মেয়েটাকে সে ইচ্ছে করে রাতের শিফটে পড়াচ্ছেন তাহলে কি তার শিকারটা দ্রুতই হাতছাড়া হয়ে যেতে বসেছে? পড়ানোর ছলে দীর্ঘদিন সে শশীর সঙ্গে একটু আধটু করে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলতে নানা কৌশলের জাল বিস্তার করে চলেছিল। যা অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীর নজরেও অল্প-বিস্তর ছিল। শশী ক্লাসের খারাপ ছাত্রীদের মধ্যে অন্যতম একজন এতে কোনো সন্দেহ নেই। তার রূপের সঙ্গে লেখাপড়ার মান কখনও মিলানো যাবে না। স্কুল কলেজে সুন্দরীদের ক্ষেত্রে সচরাচর তা-ই হয়ে থাকে। অবশ্য রফিক মাস্টারের টার্গেট তাকে একটু এক্সপ্লয়েট করা এর বেশি কিছু নয়। তাকে একটু বেশি নম্বর দেওয়া, আলাদাভাবে ইশারা-ইঙ্গিতে বলে দেওয়া, এমনিতেই বেশি বেশি প্রশংসা করা ইত্যাদি। শশীও বুঝতে পারে, স্যার তার প্রতি অনেক দুর্বল এবং এ কারণে সে না চাইলেও তাকে অধিকতর ফেভার করেন। এদিকে জলিলের প্রস্তাবের বিষয়টি মাস্টারের মাথায় সারাক্ষণ ঘুরপাক খেলেও তা সে কখনো মুখ খুলে বলে না। তার মনে অন্য চিন্তা কাজ করছে। মাথায় ভূত চাপলে যা হয়। শুধু ছাত্রীটিকে তার একান্তে কাছে পেতে চায়। এর মধ্যেই শশীর সঙ্গে তার একটা অসম অনৈতিক আচার-আচরণ শুরু হয়ে গেছে। পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র পাইয়ে দেওয়া, ভালো রেজাল্ট করিয়ে দেওয়া এসব প্রলোভনে তাকে প্রলুব্ধ করতে থাকে। শশীও অবুঝের মতন তার অশোভন আচরণকে মেনে নিতে শুরু করে। মোমবাতির আলোর মতন অলক্ষ্যে ভেতর থেকে গলে যেতে থাকে এবং দিনে দিনে চরম আকার ধারণ করতে থাকে। সম্পর্কটা মোটামুটি ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে আশপাশের লোকজনের কানাকানির পর্যায়ে উপনীত হয়ে উঠেছে। রাস্তাঘাটে কে কার মুখকে বেঁধে রাখতে পারে? যা হওয়ার তা-ই হতে হবে। এটাই যেনো প্রকৃতির শাসন ও বিধান।

শনিবার দিন। এলাকার বিখ্যাত ফতেপুরের হাটবারের দিন। রাস্তাঘাট লোকারণ্য। অন্যান্য দিনের মতন সন্ধ্যার লগ্নে রফিক মাস্টারের টিউশন ঘরে অনেক ছাত্র-ছাত্রী গিয়ে হাজির হয়েছে। তারা সবাই স্যারের কাছে ইংরেজি পড়তে এসেছে। কিন্তু আজ রফিক স্যার টিউশন কক্ষে নেই। অনেকক্ষণ অপেক্ষায় থেকে কোথায় আছেন তার খোঁজ নেওয়া দরকার মনে করে দুজন ইঁচড়েপাকা ছাত্র বিনা অনুমতিতে বাড়ির অন্দরে প্রবেশ করে বসে। তারা স্যার স্যার বলে চিৎকার করতে করতেই তার বেডরুমে অনধিকার ঢুকে গিয়ে শশী এবং তাদের প্রিয় রফিক স্যারকে অতি আপত্তিকর তথা বিব্রতকর অবস্থায় দেখতে পেয়ে চোখ বন্ধ করে দ্রুত পালিয়ে যায়। গ্রামীণ জনপদে এমন ঘটনা জানাজানি হতে খুব বেশি সময় ব্যয় করার প্রয়োজন হয় না, এরা বাতাসের আগে চলে এবং ফুলেফেঁপে স্ফীত হতে হতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দু-এক দিনের মধ্যেই স্থানীয় হাটে-বাজারে, রেলস্টেশনে, চা স্টলে, শিক্ষক সমাজে নিন্দা ও ঘৃণার ঝড়ে পরিণত হয়ে ওঠে। এতে আশপাশের যুবকদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হলো। তাদের কথা, শশীর মত বড়ো লোকের আর ভদ্রঘরের মেয়েটা শেষ পর্যন্ত একজন বিবাহিত শিক্ষকের প্রতারণার শিকার হলো? এটা কোনো ক্রমেই মেনে নেওয়া যায় না। এর একটা বিহিত করতেই হবে। ইতোমধ্যে রফিক মাস্টার এলাকা ছেড়ে উধাও। এদিকে তার স্ত্রী দুই সন্তানসহ পিত্রালয় থেকে ফিরে এসে স্বামীর এমন কলংকের কথা শুনে এবং জেনে প্রথমে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। পরে তিনি বিষয়টি চেপে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেন, ভুলবোঝাবুঝি বা অন্য কিছু হয়েছিল বলে নিকটাত্মীয় স্বজনের কাছে চালাতে চাচ্ছেন।

তিনি ভাবছেন, এটা কদিনের মধ্যে চাপা পড়ে যাবে, মানুষ তো বিস্মৃতিপ্রবণ, ভুলে যাওয়ারই জীব। সবকিছু ঠিক যাবে।

ছয়.

আসল ঘটনা ঘটে গেল মাত্র তিন দিন পরে। শশীকে সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে তার ঘরে নেই, কোথায় গেল কার কাছে গেল, সাতসকালে বাড়িতে হইচই পড়ে গেছে। এদিকে স্কুলও বন্ধ আছে। আবার রফিক মাস্টারের কর্মকাণ্ড সব মিলিয়ে শশীর ধার্মিক বাবা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। তাকে খোঁজার জন্য দশদিকে লোকজন বেরিয়ে গেছে। প্রথমে বড়ো বোনের স্বামীর বাড়ি, বান্ধবীদের বাড়ি, নানি খালা সকলের বাড়িতেই খোঁজ নেওয়া হল। না তার কোনো হদিস মিলছে না। বাড়ি থেকে চেয়ারম্যান, থানা পুলিশ জিডিসহ সবই চলছে সমানতালে। কোথাও কোনো অগ্রগতি না পেয়ে শশীর বাবা স্কুলের হেড টিচারকে ডেকে পাঠান তার নিজের বাড়িতে। হেড বাবুর নাম শ্রী শচীন দত্ত, এম এ, বিটি। কলকাতায় থেকে পড়াশোনা করেছেন। এলাকার তিন পুরুষের নমস্য শিক্ষক।

তিনি সবিনয়ে বললেন, সমস্ত ঘটনার জন্য আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী মহাজন। লজ্জায় আমাদের মাথা কাটা গেছে। স্কুল থেকে আমিও একটা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছি। আমাকে দয়া করে ভুল বুঝবেন না সাহেব। আপনার মেয়ে তো আমারই মেয়ে। এটা খুবই অশোভন এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনা ইত্যাদি ইত্যাদি। সপ্তাহ ঘুরে আবার সেই ফতেপুরের হাটের দিন ফিরে এসেছে। গ্রামীণ দূরদূরান্তরের খেটে খাওয়া মানুষের সপ্তাহান্তের ঠিকানা এই ফতেপুর বাজার। দুপুর বেলা থেকেই বাতাসে ভেসে আসে এক মুখরোচক ও আজগুবি সংবাদ, জলিল স্যার আর তার ছাত্রী শশী পালিয়ে গিয়েছেন। গত পরশু তারা কোর্ট ম্যারেজ করেছেন। বর্তমানে নাকি নরসিংদী শহরের একটা মাঝারি মানের হোটেলে অবস্থান করছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর