পর্ব-১
‘আবে ওই মাঙ্গের পোলা, আমি তোর বস নাকি তুই আমার বস? পুলিশকে কি কওন লাগবো আমি বুজিনা!’
হাসমত কমিশনারের সকাল শুরু হয় গালিগালাজ দিয়ে। সকাল ৭টায় উঠে ড্রইংরুমের ডিভানে বসে যে উচ্চৈঃস্বরে ফোনে কথা বলতে শুরু করে, সেটা চলে বাড়ি থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত।সাবিহা কত দিন মানা করেছে। মেয়েরা বড় হয়েছে এখন। ভালো স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করছে। এ ধরনের ভাষায় বাসায় কথা বলো না প্লিজ। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
হাসমতকে ফোনে কথা বলতে দেখে সাবিহা বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ভোরে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। বারান্দার মেঝে ভিজে আছে। ধুলার আস্তরণ চুপসে গেছে। কেমন একটা সোঁদা গন্ধ চারদিকে। সাবিহার অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়।
হাসমত ওদিকে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলে চলেছে।
‘এটা আসলে ডিপেন্ড করতাছে দুইজনের ইন্টিমেসির ওপর। কিল্লাইগা কথাটা কইছি, এখন বুঝতাছস?’
হঠাৎ করে হাসমতের কথার ‘ইন্টিমেসি’ শব্দটা কানে আটকে যায় সাবিহার। ইন্টিমেসি মানে হলো ঘনিষ্ঠতা। আজ ভোরে সাবিহা একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছে। যার সঙ্গে কোনোদিন ইন্টিমেসি ছিল না, ভালোভাবে চিনতেই পারেনি, সেই মানুষটাকে স্পষ্ট দেখেছে ও।
স্বপ্নে সাবিহা দেখে, ও ঘন লম্বা চুল মেলে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। ভিতরে বেডরুম থেকে বের হয়ে এলো এক অচেনা পুরুষ। বয়স পঁয়ত্রিশের ওপর হলেও চেহারায় একটা আলগা তারুণ্য আছে।
‘এই সাদা শার্টটা অনেক দিন ওয়্যারড্রোবে পড়ে ছিল। আজ পরলাম। কেমন লাগছে বল তো?’
অচেনা পুরুষ জানতে চাইছে সাবিহার কাছে। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলছে সে। মাঝারি উচ্চতার একজন মানুষ। চেহারায় তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। শুধু চোখ দুটি সারাক্ষণ হাসছে। স্বপ্নে যেমন হয়, তেমনি কেমন যেন স্থবির হয়ে বসে আছে সাবিহা। তবে ও বুঝতে পারছে লোকটা কেন এভাবে ওর সঙ্গে কথা বলছে। ও এই লোকটার স্ত্রী। কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? ও তো হাসমত কমিশনারের স্ত্রী। পুরান ঢাকায় যার নামে বাঘে মহিষে এক ঘাটে জল খায়।
স্বপ্নে লোকটা এরপর সাবিহাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। কপালে আলতো করে চুমু খায়।
‘অফিসে যাই সাবিহা। কিছু দরকার হলে ফোন কোরো। দরকার না হলেও কোরো।’
এভাবে বিদায় নেওয়া সাধারণত নতুন দম্পতিদের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু স্বপ্নের মধ্যেও সাবিহা বুঝতে পারে, ওদের বিয়ে হয়েছে অনেক আগে। তার মানে স্বপ্নে ওর স্বামী ভদ্রলোক খুব রোমান্টিক। সাবিহাকে খুব ভালোবাসে।
লোকটা চলে যাওয়ার পরে বুকের মধ্যে কেমন যেন খালি খালি লাগতে থাকে সাবিহার। ঘুম ভেঙে যাবার অনেকক্ষণ পরেও অচেনা পুরুষের গায়ের গন্ধ পায় যেন ও। খুব চেনা মনে হচ্ছে লোকটাকে। কিন্তু কোনোভাবেই মনে করতে পারছে না কে সে!
‘কই গেলা আলিফ-মীমের মা! বৃষ্টি দ্যাখতাছো নাকি!’
ভিতর থেকে হাসমত জানতে চায়। এই বাড়িতে বৃষ্টি দেখার মতো মানুষ যে একজনই আছে সেটা সবাই জানে।
বারান্দা থেকে ঘরের ভিতরে এসে হাসমতের দিকে তাকিয়ে একটা লাজুক হাসি হাসে সাবিহা। লজ্জার কারণ কি বুঝতে পারে না ও। বৃষ্টি দেখছে কি না বলায় কি লজ্জা পেয়েছে!
‘হাসতাছো কেন?’ হাসমত একটু অবাক হয়ে স্ত্রীর মুখে লাজুক হাসি দেখে।
‘ওই যে বললে না, আমি বৃষ্টি দেখছি কি না!’ আসলে শুধু হাসমতের কথা না, কী কারণে যেন মন উথাল পাথাল করছে আজ সাবিহার।
‘কেউ না জানুক, মাগার আমি তো জানি, আমার বিবি একজন শায়ের! খালি এই ছংসারের কাজের চাপে কিছু লিখবার পারল না।’
হাসমতের কথার সঙ্গে একমত হতে পারে না সাবিহা।
‘কোথায় কাজ দেখলে তুমি! তোমরা সবাই বের হয়ে গেলে আমার তো সারা দিন কোনো কাজই থাকে না।’
হাসমত ইশারা করে লিভিংরুমের ডিভানে এসে সাবিহাকে বসার জন্য।
‘আহারে আমার বিবি ছারাদিন একা থাকে! লও টাকা লও। বাসাতে না থাইক্যা পার্লারে, মার্কেটে ঘুরবা। ছুন্দর কইরা সাইজা থাকবা। সবার হিংছা হইব। কত ছুন্দর বউ আমার!’
সাবিহা জানে হাসমতের ভালোবাসার প্রকাশ যাই হোক, তাতে কোনো খাদ নেই!
আবার খাদ নেই ভাবেই বা কি করে! ওই পাশের ফ্ল্যাটে হাসমতের বড় বউ থাকে। তার আবার পাঁচ ছেলেমেয়ে। যার তিনজনই ছেলে। সাবিহার দুই সন্তানই মেয়ে। এজন্য সতীনের কতো টিপ্পনি।
‘রোজা তো শুরু হবে আগামীকাল থেকে। বাড়ির সবার জন্য ঈদের কেনাকাটা শুরু করতে হবে। টাকা তো লাগবেই।’ হেসে বলে সাবিহা।
হাসমত বউয়ের গালে হালকা টোকা দিয়ে বলে ওঠে, ‘কত টাকা লাগবে আমারে খালি কইবা। আমার বিবির তো ছবার জন্য খুব মহব্বত। বেবাকের জন্য কিনাকাটা না করলে তার মন ভরে না।’
পুরনো ঢাকার বিশাল দুর্গের মতো বাড়ি- হাসমত ভিলা। বংশাল এলাকার সবাই এক নামে চেনে বাড়িটাকে। ছয় তলা বাড়িতে হাসমতের বাবা আর মা, তিন ভাই তাদের পরিবার নিয়ে বিভিন্ন ফ্ল্যাটে থাকে। কোনো ভাড়াটিয়া নেই।
এই বিল্ডিংয়ে সাবিহার ফ্ল্যাটটিই সবচেয়ে সাজানো গোছানো। মার্বল পাথরের মেঝে। পুরো ফ্ল্যাটের ফিটিংসগুলি চোখ ধাঁধায়। প্রত্যেক রুমে দামি দামি ফার্নিচার। দুই মেয়ে মিম আর আলিফের বন্ধুরাও অবাক হয়ে যায় এই বাসার সাজসজ্জা দেখে।
মিম নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। আলিফ আগামী বছর ও-লেভেল পরীক্ষা দেবে। মেয়েরা খুব লক্ষ্মী হয়েছে। সাবিহার মনে হয়, এই তো ওর জীবন।
ছত্রিশ বছর বয়সে এত প্রাপ্তি কজনের হয়! না হয় হাসমত কমিশনার কিডন্যাপ করে এনে বিয়ে করেছিল ওকে। কিন্তু পড়াশোনা শেষ করে, বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে করলেই কি জীবন এর চেয়ে বেশি সাজানো গোছানো হতো!
সব চলছিল ঠিকঠাক মতো। শুধু গত রাতে দেখা স্বপ্নটাই এলোমেলো করে দিতে চাইছে সবকিছু। এমন একটা স্বপ্ন কেনই বা দেখলো আর স্বপ্নের মানুষটা বা কে মাথায় আসছে না ওর।
সাবিহা রান্নাঘরে ঢোকে চায়ের জন্য। চা ও নিজের হাতে বানায়। সকালে এক কাপ কড়া চা না হলে ওর দিন শুরু হতে চায় না।
রান্নাঘরের জানালা দিয়ে সতীনের রান্নাঘরও দেখা যায়। হাসমতের বড় বউ বিলকিস জানালার শিক দিয়ে তেরছা চোখে দেখছে ওকে। সব সময়ই তার নজর থাকে সাবিহা কি করে তার ওপর। কিন্তু তার দিকে তাকালে দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। কখনো স্বাভাবিকভাবে কথা বলে না সে।
‘সাবিহা ভাবি দেখেন, দেখেন স্পাই চলে এসেছে। কেমন আড়চোখে দেখতাছে আপনারে।’
জানালার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে এনে সাবিহার উদ্দেশে কথাগুলি বলে বাড়ির গৃহকর্মী হাবিবা। এই বাড়ির দীর্ঘদিনের বাঁধা লোক হাবিবা কাজেকর্মে পটু হলেও কথা বলে বেশি।
হাবিবা বিরক্ত হয়। এই ধরনের আলোচনা ওর কাছে অরুচিকর মনে হয় সব সময়। সাবিহার বিরক্তি ধরতে পারে না-
‘কালকে ছাদে আনোয়ারারে ধরছিল বিলকিস ভাবি। আমরা কি রানছি আইজকা, কোন তেল দিয়া রান্ধি, আপনে কোন কোম্পানির চা খান- জিগাইতেছিল... হাহাহা।’
‘হাবিবা কথা বন্ধ করে নাশতার টেবিল সাজাও। হাসমত আর মেয়েরা এখনই খেতে বসবে।’
রান্নাঘর থেকে বের হতে গিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ায় সাবিহা।
‘কাল থেকে রোজা শুরু হবে। ছোলা আর ডাল ভিজাতে হবে। আমি দুপুরে মীনাবাজারে যাব। তার আগে কী কী কিনতে হবে তার একটা তালিকা কর।’
‘আমি অখনই সব চেক করতাছি ম্যাডাম।’ হাবিবা হেসে বলে। কথা শেষ করে গান গাইতে থাকে। মেয়েটা একটু পাগলি ধরনের।
সাবিহা চায়ের কাপ নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে। হাতে পেপার নিয়ে আবার রেখে দেয়। কিছু ভালো লাগছে না। মাঝে মাঝে ওর এমন হয়। ঘর পালানোর ইচ্ছে জেগে ওঠে মনে। আসলে নিজেই জানে না ও, আসলেই কি ও সংসারী নাকি বৈরাগী!
স্বামী আর সন্তানরা ডাইনিং টেবিলে বসার আগে গৃহকর্মীরা নাশতার টেবিল সাজিয়ে ফেলে। একেকজনের জন্য একেক রকম নাশতা। হাবিবা পাগলি হলেও ভালোভাবে জানে, কে কি খেতে ভালোবাসে!
‘আম্মু, আজকে পেপারে মেইন খবর কী?’ বড় মেয়ে মিম জানতে চায়।
‘মেইন খবর? আমি আসলে ঈদসংখ্যার বিজ্ঞাপন পড়ছিলাম। ঈদ আসলে সব পত্রিকা ঈদসংখ্যা বের করে। আমি আসলে দেখছিলাম, কোন পত্রিকা কার উপন্যাস বের করছে!’ সাবিহা উত্তর দেয়।
‘ঈদে ছবাই শাড়ি-জামা-স্যান্ডেল নিয়ে ভাবে। আর তুমার আম্মু আছে ঈদ ছংখ্যার লেখা নিয়া। এই জন্যেই কই ছবার থিকা আমার বউ আলাদা।’
খিচুড়িতে মাংসের ঝোল মাখাতে মাখাতে হাসমত বলে।
আগামীকাল থেকে রোজা শুরু হবে বলে হাসমতের খায়েশ হয়েছে সকালের নাশতায় খিচুড়ি-মাংস খাবার।
সাবিহা সকালে ভারী কিছু খেতে পারে না। চায়ের সঙ্গে একটা টোস্ট বা বিস্কুট খায় সকালে। খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য দুই মেয়ের মা হওয়ার পরেও ও বেশ হালকা পাতালা আছে এখনো।
হাসমতের সপ্তাহের পাঁচ দিন কাটে সাবিহার ফ্ল্যাটে। বাকি দুই দিন বিলকিসের ওখানে থাকলেও বড় বউয়ের আচার আচরণ হাসমতের অভিযোগ অনেক।
সবাই চলে যাওয়ার পরে সময় নিয়ে গোসল করে কাপড় মেলতে ছাদে ওঠে সাবিহা। কারণে অকারণে ছাদে ওঠা ওর আসলে খুব পছন্দের কাজ।
সাবিহার বাসায় আসলে তেমন কোনো কাজ নেই। হাবিবাকে সকালে রান্নার নির্দেশ দিলে হয়। আনোয়ারা সারা দিন ঘুরে ঘুরে ধোয়া মোছার কাজ করে। হাসমত পুরনো ঢাকার মানুষ হলেও মেয়েরা সবাই ধানমন্ডিতে ইংরেজি স্কুলে পড়াশোনা করেছে। ওদের অবস্থা না ঘরকা, না ঘাটকা।
ছাদে একটা ছেলের ঘুড়ি ওড়ানোর দৃশ্য দেখে একটা কথা মনে হলো সাবিহার। ওর সময়ে ঘুড়িতে প্রেমপত্র পাঠানোর রেওয়াজ ছিল শুনে মেয়েদের সে কী হাসি!
আচ্ছা, কাল রাতে স্বপ্নে যাকে দেখল, সে এভাবে প্রেম নিবেদন করেনি তো!
২.
বাসায় ফিরে সাবিহা অষ্টম আশ্চর্যকে বসে থাকতে দেখতে পায়। বিলকিস বসে আছে মাথায় ঘোমটা দিয়ে। সাবিহাকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। চোরা স্বভাবের মানুষ কিছুটা ভীতু স্বভাবের হয়। ‘সাবিহা, তোমাকে না বলেছিলাম কিছু পুরনো কাপড় দিতে। আমার ভাইয়ের ছেলে নিতে আসবে। রাখছো?’
[চলবে]