পর্ব-২
কোনো ধরনের ভূমিকা ছাড়া জানতে চায় বিলকিস।
সাবিহা একদম ভুলে গেছে। বিলবিস বলার পরে অপ্রয়োজনীয় তথ্য ভেবে মাথার স্টোর জমা রাখেনি।
‘সরি। কাপড় তো জমিয়ে রাখিনি। আপনার ভাগ্নে কি এখন আসবে?’‘ও তো এই এলাকাতে থাকে। দক্ষিণবঙ্গে বন্যাদুর্গতদের সাহায্য করার জন্য ভাগ্নে আর ওর বন্ধুরা মিলে বাড়ি বাড়ি ঘুরে পুরনো কাপড় সংগ্রহ করছে। তুমি তো ভালো ভালো জামা হাবিবা আর আনোয়ারাকে দিয়ে দাও। ওদের না দিয়ে ভালো কোনো কাজে তো দিতে পারো।’
সাবিহার প্রচণ্ড বিরক্ত লাগে। ওর জিনিস কাকে দেবে সেটা কি বিলকিসের কথায় হবে! ও বুঝতে পারে আসলে একটা ঝামেলা বাধাতে সাত সকালে এসেছে বিলকিস।
‘কি বললেন বিলকিস ভাবি?’ হাবিবার কানে কথা চলে গেছে ইতোমধ্যে।
সাবিহা দ্রুত বেডরুমে ঢুকে যায় বিরক্তি ঢাকার জন্য। মহিলার এসব কথা না বললে হতো না। এ জন্য ওনার বাসায় কোনো গৃহকর্মী বেশি দিন কাজ করে না।
ওপরের তাকের ড্রেস নামাতে গিয়ে অনেক দিন আগে কেনা লাল একটা ড্রেস খুঁজে পায় সাবিহা। ড্রেসটা সুন্দর হলেও ডিজাইনটা পুরনো হয়ে গেছে।
‘লাল ড্রেস পরার পরে তুমি কানের পেছনে কাজলের পিট দেবে। নয়তো নজরে পড়ে যাবে কারও। লালে যে তোমাকে কী অসাধারণ লাগে তুমি তো জান না!’
বিদ্যুৎ চমকের মতো সাবিহার মনে পড়ল খালেদের কথা। ওকে লেখা প্রথম প্রেমপত্রের শুরুতে ছিল কথাগুলি। গতকাল রাতে ওই খালেদকে স্বপ্নে দেখেছে ও। সারা শরীর কেমন যে ঝিমঝিম করে উঠল সাবিহার। তাকিয়ে দেখল, শরীরের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে গেছে।
ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে সাবিহা দেখল, বিলকিস চলে গেছে। আনোয়ারা জানালো, হাবিবার সঙ্গে ঝগড়া করে রেগে মেগে চলে গেছে কিছু না বলেই। সাবিহা এই নিয়ে চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নিল। আনোয়ারাকে দিয়ে কাপড়গুলি পাঠালো।
ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো সাবিহা। চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে ভাবতে লাগলো খালেদের কথা। বুকের মধ্যে অচেনা এক কষ্ট এসে মোচড়াতে লাগলো। দুচোখ পানিতে ভরে গেল। সাবিহা বুঝতে পারছিল না, বলা নেই, কওয়া নেই, এ কোন আজব হাওয়া ভর করল ওর শরীরে।
তড়াক করে বিছানা থেকে উঠে বসে সাবিহা। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ইচ্ছা করছে, বৈরাগী হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। আর ফিরে আসে না সংসারী জীবনে। হঠাৎ করে এমন অস্থিরতা কেন ঘিরে ধরল বুঝতে পারে না ও। যে মানুষটাকে নিয়ে কোনো দিন মাথা ঘামায়নি, সব সময় অপমান-অবহেলা করেছে, সে কীভাবে এমন সুনামি হয়ে এলো এই ভর দুপুরে!
ড্রাইভার জাহিদকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলে দ্রুত তৈরি হয় সাবিহা। পুরান ঢাকার নারিন্দায় ছোট বোনের বাসায় যেতে হবে। গাড়িতে যাওয়ার চেয়ে হেঁটে গেলে দ্রুত যাওয়া যায়! তবু গাড়ি ছাড়া কোথাও যায় না ও।
হঠাৎ করে অবেলায় বড় বোনকে দেখে অবাক হয়ে যায় আফিয়া।
‘একটা কল দিয়া আইবানা আপা। তাইলে ভালা কিছু রান্না করতাম!’
আফিয়া অবশ্য মনে মনে বুঝতে পারে সাবিহা জরুরি কিছু বলতে এসেছে। কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে ওকে।
কোনো ভূমিকা ছাড়া সাবিহা বলা শুরু করে-
‘আমার তো তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে গেল। এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার আগেই। মানে তোর তো মনে আছে হাসমত আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গেলো!’
সাবিহা কেন হঠাৎ এই প্রসঙ্গ তুলছে বুঝতে পারছে না আফিয়া। ওর কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি!
‘তুমি হঠাৎ পুরনো দিনে ফিরা গেলা যে আপা?’ আফিয়া দ্রুত হাতে বোনের জন্য লেবুর শরবত বানাতে বানাতে জানতে চায়।
‘তোর কি মনে আছে খালেদ নামে আমার এক প্রাইভেট টিউটর ছিল। ইংরেজিতে কাঁচা ছিলাম বলে আব্বা তাকে পরীক্ষার আগে রেখেছিল আমার জন্য। খুব সহজ করে টেনস আর ন্যারেশন পড়াতো সে।’
কথা বলতে গিয়ে মনে মনে প্রার্থনা করে সাবিহা, আফিয়া যেন চিনতে পারে খালেদকে।
‘খালেদ ভাইকে চিনবো না কেন? উনি তো অনেক আগে থেকে খেলাঘরের লাইব্রেরিতে বসতেন। হুমায়ূন আহমেদ, তিন গোয়েন্দার নতুন বই এলে তোমার জন্য সরিয়ে রাখতেন।’
‘তাই করতেন নাকি তিনি?’
‘কেন তোমার মনে নেই?’
‘অত স্পষ্ট মনে নেই। শুধু একটা ঘটনাই পরিষ্কার মনে আছে। একটা দীর্ঘ প্রেমপত্র লিখেছিল সে। সেটা দেখে মেজাজ খারাপ হলো! এত বড় প্রেমপত্র এই যুগে কেউ লেখে!’
তড়াক করে বিছানা থেকে উঠে বসে সাবিহা। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ইচ্ছা করছে, বৈরাগী হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। আর ফিরে আসে না সংসারী জীবনে। হঠাৎ করে এমন অস্থিরতা কেন ঘিরে ধরল বুঝতে পারে না ও। যে মানুষটাকে নিয়ে কোনো দিন মাথা ঘামায়নি, সব সময় অপমান-অবহেলা করেছে, সে কীভাবে এমন সুনামি হয়ে এলো এই ভরদুপুরে!
ড্রাইভার জাহিদকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলে দ্রুত তৈরি হয় সাবিহা। পুরান ঢাকার নারিন্দায় ছোট বোনের বাসায় যেতে হবে। গাড়িতে যাওয়ার চেয়ে হেঁটে গেলে দ্রুত যাওয়া যায়! তবু গাড়ি ছাড়া কোথাও যায় না ও।
‘আর মেজাজ খারাপ করে মেজো ভাইকে বলে দিলে! একটা মনের সমস্ত আবেগ দিয়ে লম্বা একটা চিঠি লিখলো, জানালো তার ভালোবাসার কথা আর তুমি তারে এভাবে অপমান করলা!’
‘তখন তো রূপের গর্বে অন্ধ ছিলাম। বুঝি নাই, কে আসল আর কে নকল! তারপর তো হাসমত আমাকে কিডন্যাপ করল দিনে দুপুরে!’
‘তো আজকে এতো দিন পরে তোমার হঠাৎ খালেদ ভাইয়ের কথা মনে পড়ল কেন আপা!
‘খালেদ ভাই এখন কোথায় থাকে বলতে পারিস?’ মনে হচ্ছে এই উত্তর পাওয়ার ওপর সাবিহার জীবন-মরণ নির্ভর করছে।
‘আগে তো ফরিদাবাদে এক কলোনিতে থাকতেন। এখন কোথায় থাকেন জানি না।’
‘কে জানতে পারে?’
আফিয়াকে চিন্তিত দেখায়। সাবিহা ঢকঢক করে লেবুর শরবত গলায় ঢেলে চোখে রাজ্যের আকুলতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। সেই চোখের দিকে কিছুটা বিস্মিত, কিছুটা বিভ্রান্ত আফিয়া। কী হলো আজ বড় বোনের?
‘আমার এক বান্ধবী ছিল না লতা, ও খালেদ ভাইয়ের কাজিন হয়। ও হয়তো বলতে পারবে।’
‘ফোন দে না প্লিজ লতাকে।’
‘মোবাইল ছিনতাই হবার পরে সবার নম্বর হারিয়ে গেছে। লতার নম্বর নেই আমার কাছে এখন।’
‘তবে লতার বাসায় যাই চল। ওর বাসা চিনিস তো?’
‘চিনি। কিন্তু হঠাৎ করে ওর বাসায় গিয়ে খালেদ ভাইয়ের নম্বর চাইলে অবাক হতে পারে ও।’
‘কিছু একটা বানিয়ে বলব তখন।’
আফিয়ার ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে আসার সময় হয়ে গেছে। রান্না শেষ করতে পারেনি। গোসলও করা হয়নি। এ অবস্থায় জোর করে আফিয়াকে জোর করে গাড়িতে ওঠায় সাবিহা।
‘আচ্ছা, তুমি এত দিন পরে খালেদ ভাইকে খোঁজার জন্য এত মরিয়া হয়ে গেলে কেন? মাপ চাইবা তার কাছে?’ আফিয়া গাড়িতে বসেই জানতে চায়।
খুব আস্তে করে হুম বলে চুপ থাকে সাবিহা। ওর মনের মধ্যে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
বাসায় গিয়ে পায় না লতাকে। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে গেছে ও। লতার শাশুড়ি জানায়, যখন তখন অবস্থা বেয়াইয়ের। ওনার কাছ থেকে লতার নম্বর নিয়ে ফোন করে আফিয়া।
বাবাকে নিয়ে প্রচণ্ড উদ্বেগের মধ্যে লতার কণ্ঠের বিস্ময় ওদের কান এড়ায় না। খালেদের নম্বর দিতে পারে না লতা। তবে বাসার নম্বর দিতে পারে। রজনী চৌধুরী রোডে থাকে এখন খালেদ।
আফিয়াকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে রজনী চৌধুরী রোডে ছোটে সাবিহা। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে যেতে অনুরোধ করে আফিয়া। কিন্তু ওকে কোনো উত্তর না দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যায় সাবিহা।
রজনী চৌধুরী রোডে যে বাসার নম্বরটা দিয়েছে লতা, সেখানে আগে একটা পুরনো বাড়ি ছিল। এখন সেটা ডেভেলপার দিয়ে ভেঙে ছয়টা বিল্ডিং করা হয়েছে। প্রতিটি বিল্ডিং ছয়তলা, প্রতি তলায় চারটা করে ফ্ল্যাট, তার একটাতে থাকে খালেদ! সাবিহার চেহারায় দিশাহারা ভাব ফুটে ওঠে।
বাসার গেটে একজন দারোয়ানকে দেখতে পায় সাবিহা। উ™£ান্তের মতো তার কাছে ছোটে ও।
‘এখানো কোন বিল্ডিংয়ে খালেদ সাহেব থাকেন, বলতে পারবেন? উনি ব্র্যাকে চাকরি করেন। এক ছেলের বাবা।’
শেষের তথ্যগুলি লতার কাছ থেকে পাওয়া।
দারোয়ান খুব অবাক হয়ে যায় সাবিহার প্রশ্নের ধরন দেখে। দামি পোশাকে আর দেখতে শুনতে ভালো ভদ্রমহিলা এভাবে কেন কাউকে খুঁজছেন দারোয়ান বুঝতে পারে না।
‘এখানে খালেদ নামে কে থাকেন, জানা নেই আমার ম্যাডাম।’
দারোয়ানের কথায় সাবিহার মনে হয় ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে! হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে ও।
[চলবে]