পূর্ব প্রকাশের পর
তাহলে কি খালেদ ভাইকে খুঁজে পাবার কোনো আশা নেই। দারোয়ানের বিস্ময় যেন বাঁধ মানে না। কাঁদতে কাঁদতে দারোয়ানের হাত জড়িয়ে ধরে সাবিহা।
‘ভাই, আপনি আমার ধর্মের ভাই হন। যেভাবে হোক খুঁজে দেন তাকে। যত টাকা চান, আমি আপনাকে দেব।’ কথা বলতে বলতে হ্যান্ডব্যাগ থেকে দুই হাজার টাকা বের করে দারোয়ানের হাতে দেয় সাবিহা। লোকটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
দারোয়ানের নাম ফতেহ আলী। সত্যি বলতে কি এমন ঘটনা তার জীবনে আগে কখনো ঘটেনি। কথা বলতে ভুলে গেছে যেন সে। কোনোক্রমে জানায়, খালেদ নামে কাউকে পেলে সে জানাবে।সাবিহার বাসার থেকে মেয়ে আর মেয়ের বাপের বারবার ফোন আসছে। সাবিহাকে বাসায় ফিরতে হবে এখন।
সাবিহা বাসায় ফেরার পরে শুরু হয়ে যায় সবার প্রশ্নবাণ। ও আগেই বানিয়ে রেখেছিল, বলবে যে আফিয়ার ব্যাগ ছিনতাই হয়ে গেছে। তাতে মোবাইল, টাকা, ক্রেডিট কার্ড অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ছিল। এজন্য থানায় যাওয়া, জিডি করতে দিন পার হয়ে গেছে।
নিজের পাগলপারা অবস্থার কারণে হাসমতের চেহারায় অবিশ্বাসের ছাপ চোখে পড়ে না সাবিহার। রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে ফোন করে ফতেহ আলীকে।
‘পাওয়া গেছে খালেদ নামে কাউকে? ব্যাংকে চাকরি করে, এক ছেলের বাবা, ওনাকে পাওয়া গেলে আমি আপনাকে আরও টাকা বখশিশ দেব।’
‘ম্যাডাম কোনো বখশিশ লাগবে না। আপনি ওনারে খুঁইজা পাইলেই আমি খুশি। গেট দিয়া যে-ই ঢুকতাছে, তারেই জিগাইতিছি খালেদ নামে কাউরে চেনে কি না!’
দারোয়ানের কথায় আবার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে সাবিহার। তবে কি ওখানে খালেদ থাকে না। কোথায় থাকে সে? এত বড় শহরে কোথায় খুঁজবে এখন তাকে?’
হাসমত ঘরে ঢুকে স্ত্রীকে কাঁদতে দেখে থতমত খেয়ে যায়। কী যেন মেলাতে পারে না।
‘কিছু বলতে চাইছ মনে হচ্ছে?’ সাবিহা বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে আবার বসে পড়ে।
‘না আইজকা কি হাবিবার ছঙ্গে বড় বউয়ের কাইজ্যা লাগছে নাকি?’ যথাসম্ভব নরম কণ্ঠে বলার চেষ্টা করে হাসমত।
‘কেন তাতে কী হয়েছে?’ হাসমতের ঠিক উল্টো আচরণ করে সাবিহা। অত্যন্ত রূঢ় কণ্ঠে বলে ওঠে ও।
হাসমতের কণ্ঠ দ্বিধাগ্রস্ত, ‘না মানে, বিলকিস বলছে এই বাড়িতে হাবিবা কাজ করলে ও থাকত না।’
সাবিহা এবার দাঁড়িয়ে গিয়ে স্বামীর মুখোমুখি হয়, ‘তোমার বড় বউকে বলে দিও হাবিবা না থাকলে আমিও এই বাসায় থাকব না। গৃহকর্মীদের সঙ্গে যারা ঝগড়া করে তাদের পক্ষ থেকে কথা বলতে তোমার লজ্জা করে না।’
কথা শেষ করে সাবিহা বারান্দায় ঝোলানো দোলনায় এসে বসে। হাসমতের চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পায়। বিলকিসের কাছে গেছে মনে হয়।
বারান্দায় বসে সাবিহা আবার ফোন করে ফতেহ আলীকে। কোনো খবর নেই। সাবিহার এত অস্থির লাগে। সব ভেঙেচুরে ফেলতে ইচ্ছে করে ওর।
মিম আর আলিফ এসে উঁকি দিয়ে দেখে যায়। ওর ধারণা করে সৎমার কারণে মায়ের মন খারাপ।
বাথরুমে ঢুকে মাথায় পানি দেয় সাবিহা। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। সারা দিন কিছু খাওয়া হয়নি। কিন্তু কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। এমন সময়ে ফতেহ আলীর কল আসে ফোনে।
‘ম্যাডাম শিকদার খালেদ নামে একজনরে পাইছি। উনি ব্যাংকে চাকরি করেন। আপনি যারে খুঁজছেন, ওনার পুরো নাম কি?’ ফতেহ আলী জানতে চায়।
সাবিহার আসলে কোনো দিনই জানত না খালেদ ভাইয়ের পুরো নাম কী ছিল! কোনো দিন সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি তাকে। হঠাৎ স্বপ্নটা সব এলোমেলো করে দিলো।
বাসার গেটের সামনে পাড়ার লোকজনের সামনে মেজো ভাই খালেদকে থাপ্পড় দিয়েছিল। শার্টের কলার ধরে ঘাড় ধাক্কাও দেওয়া হয়। খালেদের অপরাধ ছিল সে সাবিহাকে ভালোবেসে একটা দীর্ঘ প্রেমপত্র লিখেছিল।
ভাবনার জাল ছিন্ন করে সাবিহা দ্রুত জানতে চায়, ‘পুরো নাম মনে নেই এখন। ওনাকে ফোনটা দেন না।’
ওই পাশ থেকে ফতেহ আলীর সঙ্গে কারও কথা হয়। ‘উনি আপনার নাম জানতে চাইছেন।’
‘বল সাবিহা। সাবিহা সুলতানা। দীননাথ সেন রোডে থাকত।’
ফতেহ আলী ওর নাম জানাচ্ছে কাউকে, ফোনের এ পাশ থেকে শুনতে পায় সাবিহা।
‘সাবিহা, তুমি? কী ব্যাপার? এত দিন পরে?’ ফোনে খালেদের কণ্ঠটা কেমন নিরাসক্ত শোনায়।
‘খালেদ ভাই আপনাকে আমার খুব দরকার। একটা কথা জানা দরকার।’
‘আমাকে দরকার, কেন বলতো?’ খালেদের কণ্ঠে আন্তরিকতার অভাব বেদনার্ত করে সাবিহাকে।
‘আপনি কি এখন ওয়ারিতে আসতে পারবেন? প্লিজ!’
‘মাত্র তো অফিস থেকে বাড়ি ফিরলাম। বাসায় গিয়ে বউয়ের মেজাজ মর্জি দেখে বলতে পারব।’
‘বেশিক্ষণ লাগবে না। প্লিজ আসেন না। আমি ওয়ারী আড়ঙের সামনে থাকব।’
ওই পাশের জনের কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দেয় সাবিহা। এত দিন পরে দেখা হলেও সাজগোজের কথা ওর মাথায় আসে না। সারা দিন যে সালোয়ার-কামিজ পরাছিল, সেটা পরেই বের হয়। ড্রাইভার চলে গেছে তারাবি নামাজ পড়তে। হাসমত মসজিদে গেছে সবার আগে, লোক দেখানো ধর্মকর্ম করতে। হাবিবাকে ‘আফিয়ার সঙ্গে থানায় যেতে হবে’ বলে রাত ৮টায় বাসা থেকে বের হয়ে যায় সাবিহা।
রিকশা নিয়ে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ঢোকে সাবিহা। অপেক্ষার উদ্বেগ কাটাতে কিছু খাবার অর্ডার দেয়। সারা দিন কিছু খাওয়া হয়নি। কিন্তু সেই খাবারও আসতে দেরি হবে।
বারবার ঘড়ির দিকে তাকায় সাবিহা। খালেদ ভাই কি আদৌ আসবে? একুশ বছর পরে ওনার চেহারা কি আগের মতো আছে! নাকি আরও সুন্দর হয়ে গেছে। ক্ষুধা ও ক্লান্তিতে কেমন ঝিমঝিম করতে থাকে ওর মাথা।
সাবিহা সামনে তাকিয়ে দেখে সুবেশধারী একজন সুদর্শন লোক দাঁড়িয়ে আছে। এত বছর পরে দেখা হলেও ও একঝলকে চিনে ফেলে। স্বপ্নে তো এই ভদ্রলোককেই দেখেছিল ও।
‘সাবিহা তুমি তো দেখি আগের মতো সুন্দর আছ?’ চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলে খালেদ।
অনেক কথা বলার থাকলেও সব গুলিয়ে যায় সাবিহার। কেমন যেন একটা অবশ করা অনুভূতি হয়।
‘আমি কি আসলেই আগের মতো আছি?’ কোনোক্রমে বলতে পারে সাবিহা।
‘তোমাকে দেখে বোঝাই যায় না মাঝখানে কেটে গেছে এতগুলো বছর।’ হাসিমুখে বলে খালেদ। কণ্ঠে কেমন যেন মাদকতা। ‘জরুরি কি বলবে বলেছিলে?’
‘আমি আপনার কাছে মাফ চাইতে এসেছি খালেদ ভাই। আজ ভোররাতে একটা স্বপ্ন দেখার পরে আমি আমার মধ্যে নেই। এত অস্থির লাগছে যে, ভাষায় বোঝাতে পারব না। প্লিজ বলবেন, আমার এমন পাগলের মতো অবস্থা কেন হলো?’
মুখে কিছু না বলে খালেদ টেবিলে রাখা থাইস্যুপের বড় বাটি টেনে নেয়। ছোট বাটিতে কয়েক চামচ স্যুপ নিয়ে মসলা মেশায়। তারপর সাবিহার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘আগে কিছু খাও সাবিহা। মনে হচ্ছে সারা দিন কিছু খাওয়া হয়নি।’
খালেদের এই কথা যেন হৃদয়ের কোনো তন্ত্রিতে স্পর্শ করে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে সাবিহা।
‘কেঁদো না সাবিহা। একদিন তোমাকে আমি পাগলের মতো ভালোবাসতাম। তোমার একটু দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কত কিছু না করতাম। তুমি দেখেও দেখতে না। কোনো দিন যদি আনমনে-অবহেলায় একটু তাকাতে, নচিকেতার নীলাঞ্জনার মতো, তবে সেই দিনটা অন্যরকম হয়ে যেত। রাস্তায় হাঁটতে গেলে মনে হতো আমি উড়ে উড়ে চলছি। আমার এই তীব্র ভালোবাসা এতদিন জমা ছিল প্রকৃতি নামের দুষ্টু মেয়ের সিন্দুকে। অনেক দিন পরে সেই সিন্দুক উন্মুক্ত হয়ে গেল তোমার সামনে। তুমি সেই ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে গেলে।’
সাবিহা বোধোদয় হলো অতঃপর, কেন ও পাগল হলো এই অবেলায়!
‘আমি এখন কী করব?’ সাবিহার কণ্ঠে সারা পৃথিবীর আকুলতা।
খালেদ কিছু বলার আগে সাবিহার মোবাইল বেজে ওঠে তারস্বরে। তন্দ্রা কেটে যাওয়ার পরে সাবিহা বুঝতে পারে সারা দিনের ক্লান্তিতে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল ও।
ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখে দারোয়ান ফতেহ আলীর নম্বর।
সাবিহা আবার ফোন করতে ফতেহ আলী শুষ্ক কণ্ঠে জানায়, ‘খালেদ সাহেব একটু আগে এসে বলে গেছেন, উনি আজ আর আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না।’
-সমাপ্ত