শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা
কাহলিল জিবরান ও ফ্রান্সিস বেকন

অনুষঙ্গ ‘প্রেম’

ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া

অনুষঙ্গ ‘প্রেম’

এক.

কাহলিল জিবরানের পূর্বনাম জুবরান খলিল জুবরান, লেবানিজ-আমেরিকান কবি, চিত্রশিল্পী, লেখক, দার্শনিক, ধর্মতত্ত্ববিদ। জন্মেছেন ১৮৮৩ সালে। ইংরেজিভাষী বিশ্বে তিনি মূলত তার ১৯২৩ সালে প্রকাশিত ২৬টি অতিন্দ্রীয়বাদী গদ্য-কবিতার সংকলন বই ‘দ্য প্রফেট’-এর জন্য সুপরিচিত। উইলিয়াম শেকসপিয়র ও চীনা কবি লাওজির পর জিবরান তৃতীয় বহুল বিক্রীত বইয়ের কবি। ‘দ্য প্রফেট’ এ যাবৎ মোট ১০০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত জিবরানের এ বই এখনো এক বিস্ময়ের নাম। সবার কাছেই এক চমক। এত বছর পরেও এ বইয়ের আবেদন একটুও কমেনি। জিবরানের মৃত্যু হয় ১৯৩১ সালে।

‘দ্য প্রফেট’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র আল-মুস্তাফা, যিনি ১২টি বছর কাটিয়েছেন তার জন্মভূমি থেকে যোজন যোজন দূরে- ওরফেলিসে আর অপেক্ষা করছেন তার জাহাজের যাতে করে তিনি তার স্বদেশে ফিরে যেতে পারেন। আল-মুস্তাফার একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা আর মর্মবেদনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে ওই জনপদের মানুষ ও মাটি। একদিন পাহাড়ের ওপর উঠে তিনি তাকে নিতে আসা জাহাজটিকে দেখতে পান। জাহাজে তার স্বদেশি স্বজনরা তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। তার মন একদিকে ভরে উঠে মহানন্দে। আবার অন্যদিকে আচ্ছন্ন করে বিষণ্নতায়। কারণ এই ১২ বছরে তিনি ওরফেলিসের বাসিন্দাদের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন আত্মার আত্মীয়ের মতো। তাই বিদায়বেলায় বিচ্ছেদ-বেদনা তাকে জর্জরিত করে ফেলে : “আমার আত্মার কত না ক্ষুদ্র অংশ আমি এই নগরীর পথে পথে ছড়িয়ে দিয়েছি, আমি ব্যথিত এবং ভারাক্রান্ত না হয়ে কীভাবে তাদের ছেড়ে ফিরে যাব?”

আল-মুস্তাফার জাহাজের খবর পেয়ে ওরফেলিসের জনগণ একে একে তার কাছে চলে আসে। সবাইকে দেখে আল-মুস্তাফা নিজেকে বলে, “বিরহের দিন কি তবে মিলনেরও দিন?” মানুষজন সবাই একে একে মুস্তাফার কাছে আসে। তাদেরকে ছেড়ে যেতে বারণ করতে থাকে। অশ্রুসিক্ত মিনতি করে থেকে যেতে। বিদায়বেলায় যেন আপনজনের মাহাত্ম্য আরও স্পষ্ট করে ফুটে ওঠে, “চিরকাল এমনই হয়েছে, বিচ্ছেদের মুহূর্ত না আসা পর্যন্ত ভালোবাসা তার গভীরতা বুঝতে পারে না।”

সবশেষে আলমিত্রা এগিয়ে আসেন। ওরফেলিসে মুস্তাফা যেদিন প্রথম এসেছিলেন তখন আলমিত্রাই তাকে প্রথম দেখেছিলেন এবং বিশ্বাস করেছিলেন। তিনি আল-মুস্তাফাকে তার স্বদেশে ফিরে যেতে বলেন। কারণ মুস্তাফার সব আশা- আকাক্সক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার স্বদেশ। কিন্তু যাওয়ার আগে মুস্তাফাকে তার সত্য উপলব্ধি সম্পর্কে কিছু বলে যেতে বলেন, যাতে ওরফেলিসের জনগণ সেই সত্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দিয়ে যেতে পারে। তখনই মুস্তাফা একে একে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার আত্মোপলব্ধি ও অন্তরজ্ঞান বর্ণনা করতে থাকেন।

‘দ্য প্রফেট’ ভালোবাসা, বিয়ে, সন্তান, দান, আহার্য, কাজ, আনন্দ ও দুঃখ, আবাস, পরিধেয়, ক্রয়-বিক্রয়, অপরাধ ও শাস্তি, আইন, স্বাধীনতা, কারণ এবং আবেগ, ব্যথা, আত্মদর্শন, শিক্ষাদান, বন্ধুত্ব, কথা, সময়, ভালো-মন্দ, প্রার্থনা, আনন্দ, সৌন্দর্য, ধর্ম, এবং মৃত্যু অনুচ্ছেদে বিভক্ত। প্রত্যেক অনুচ্ছেদে আছে কাব্যিক ঢঙে জীবনের নানা দিকের দার্শনিক উপস্থাপন। আলমিত্রা নামক জনৈক নারীর ভালোবাসাবিষয়ক প্রশ্নের মাধ্যমেই মূলত কাব্যের সূচনা। একে একে মা, কবি, কৃষক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, পান্থশালার মালিকসহ নগরের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করে। প্রতিক্ষেত্রেই আল-মুস্তাফার সস্নেহ উত্তর গভীর হৃদয়গ্রাহী যা জিবরানের নিজস্ব জীবন দর্শন। বইতে রয়েছে জিবরানের নিজের আঁকা ১২টি চিত্রকর্ম। অনূদিত কবিতাটি তার ‘The Prophet’ কাব্যের LOVE  শিরোনামের কবিতা :

তখন আলমিত্রা (প্রফেটকে) বললেন, আমাদেরকে পরম-প্রেম সম্পর্কে কিছু বলুন।

তিনি (দ্য প্রফেট) মাথা তুলে উপস্থিত লোকদের দিকে তাকালেন। তাদের ওপর নেমে আসে নিস্তব্ধতা। দরাজ কণ্ঠে তিনি বলতে শুরু করেন :

প্রেম তোমাকে ইশারা করা মাত্র সে পথ দুরূহ কিংবা বন্ধুর হলেও তুমি তার সহযাত্রী হবে। এবং তার ডানায় তোমাকে জড়াতে চাইলে পালকের আড়ালে লুকানো খড়গের ঘায়ে ঘায়েল হলেও তুমি তার আলিঙ্গনে সমর্পিত হবে। সে যেই কথা বলবে, সেই ভাষ্যে যদি তোমার স্বপ্ন উত্তরের হিমেল ঝঞ্ঝার তাণ্ডবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া উদ্যানের মতোও হয়ে যায়, তবুও তা বিশ্বাস করবে। কারণ প্রেম যেমন তোমাকে রাজমুকুটে ভূষিত করে তেমনি ক্রুশবিদ্ধও করে। সে একদিকে তোমার বিকাশ, অন্যদিকে তোমার বিনাশ।

সে যেমন করে তোমার শীর্ষ-শিখরে উঠে সূর্যতাপে কুঁচকে যাওয়া নাজুক শাখা-প্রশাখার গায়ে মমতার পরশ বুলিয়ে দেয়, তেমন করে শিকড়ে নেমে এর মূলকে মাটির বাঁধন থেকে এক ঝটকায় আলগা করে ফেলে। শস্যের আঁটির মতো জড়ো করে সে তোমাকে তার কাছে টেনে আনে। মাড়াই করে সে খসিয়ে ফেলে তোমার সব আবরণ। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তোমাকে করে খোসামুক্ত। পেষণে-মর্দনে তোমার মাঝে আনে শুভ্রতা। পিষতে থাকে যতক্ষণ-না তুমি বিনম্র হও। আর তারপর সে তোমাকে সমর্পণ করে তার পবিত্র আগুনে যেখানে তুমি পরিণত হও বিধাতার পবিত্র ভোজসভার পবিত্র আস্বাদনে।

প্রেম-ভালোবাসা তোমাকে নিয়ে এতসব কাণ্ড করে যাতে তুমি তোমার হৃদয়ের রহস্যের খোঁজ পেয়ে যাও এবং সেই জ্ঞানে তুমি মহাকালের হৃৎ-জগতের একটা খুদে অংশ বনে যাও। তবে তুমি ভীত হয়ে যদি তোমার ভালোবাসায় কেবল শান্তি এবং সন্তুষ্টি খুঁজে ফেরো, তাহলে তোমার উন্মুক্ততাকে আবৃত করে ভালোবাসার মাড়াই অঙ্গন ছেড়ে এমন এক ঋতু-বৈচিত্র্যহীন ভুবনে তোমার পলিয়ে যাওয়াই শ্রেয় যেখানে হয়তো তুমি হাসবে, তবে প্রাণ খুলে হাসবে না; হয়তো তুমি কাঁদবে, তবে প্রাণ ভরে কাঁদবে না।

প্রেম নিজেকে ছাড়া আর কিছুই বিলিয়ে দেয় না এবং নিজের কাছ থেকে ছাড়া আর কোনোখান থেকে কিচ্ছুটি নেয় না। প্রেমের যেমন নিজের বলে কিছু নেই তেমনি সেও কারও না; কারণ, ভালোবাসার জন্য কেবল ভালোবাসাই যথেষ্ট।

তুমি যখন ভালোবাস তখন এমনটা বল না ‘ঈশ্বর আমার হৃদয়ে আসীন’, বরং বল, ‘আমি আছি ঈশ্বরের হৃদয়জুড়ে’। এমনটা ভেবো না-যে তুমি ভালোবাসার গতিপথ নির্দেশ করতে পার, কারণ তোমাকে তার যোগ্য ভাবলে ভালোবাসা নিজেই হয় তোমার পথ প্রদর্শক। তোমাকে পূর্ণ করা ছাড়া ভালোবাসার আর কোনো আকাক্সক্ষা নেই। কিন্তু তুমি যদি ভালোবাস আর ভালোবাসায় যদি কামনা হয়ে ওঠে অবধারিত, তবে তাই হোক: সেই কামনার রস গলে নির্ঝরিণীর ফল্গুধারায় রাতের কলতানে মূর্ছনা ছড়িয়ে কূলো কূলো বয়ে যেতে, ভালোবাসার অতি কোমলতার কারণে বেদনা-বিধুর হতে, ভালোবাসা সম্বন্ধে তোমার আপন উপলব্ধির কারণে আঘাত পেতে; এবং স্বেচ্ছায় ও সানন্দে রক্তাক্ত হতে, প্রত্যুষে ডানামেলা হৃদয়ে জেগে ওঠা আর প্রেমময় আরেকটা দিনের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে; মধ্যাহ্ন-বিরামে বিশ্রাম এবং প্রেমোচ্ছ্বাসে নিমগ্নতায় আচ্ছন্ন হতে; সন্ধ্যায় কৃতজ্ঞচিত্তে ঘরে ফিরতে; এবং তারপর প্রিতমের জন্য অন্তরে আরজ আর উচ্চারণে বন্দনা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে।

 

দুই.

ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ও গদ্য লেখক ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) ব্রিটিশ রেনেসাঁ বিকাশের এক প্রধান ব্যক্তিত্ব। বেকন অতি সহজেই রাজদরবারে পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং ১৬০৩ সালে প্রথম জেমসের উত্তরাধিকারের পর নাইট উপাধি লাভ করেন। পরবর্তীতে ১৬১৮ সালে তিনি লর্ড চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন। কিন্তু ১৬২১ সালে অতিমাত্রায় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অভিযুক্ত হন দুর্নীতির অভিযোগে। ফলে ক্ষমতা থেকে সরে যান। ১৬২০ সালে নোভাম অর্গানাম সায়েন্টিয়ারম (বিজ্ঞানের নতুন যন্ত্র) প্রকাশের জন্য বেকনকে কখনো কখনো ‘বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির জনক’ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এ কাজে, তিনি সব অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে মধ্যযুগের শিক্ষাবিদদের ‘পুরনো পদ্ধতি’ (deduction)-এর বিপরীতে তিনি অভিজ্ঞতামূলক পদ্ধতি (induction) ব্যবহার করার পক্ষে মত দেন।

বেকন ১৫৯৭ সালে তার প্রবন্ধের প্রথম সংস্করণ প্রকাশ করেন। তিনি ফরাসি লেখক মিশেল ডি মন্টেইগনের কাছ থেকে ‘প্রবন্ধ’ শব্দটি ধার করেন। এর অর্থ ‘প্রচেষ্টা বা বিচার-বিশ্লেষণ’। তিনি ১৬১২ সালে একটি দ্বিতীয় সংস্করণ লেখেন এবং ১৬১৫ সালে একটি বর্ধিত সংস্করণ প্রকাশ করেন। তাকে Father of English Prose (ইংরেজি গদ্যের জনক) বলা হয়। তার গদ্যগুলো খুবই সংক্ষিপ্ত এবং তথ্যবহুল। তিনি বিস্তারিত কোনো কিছু লিখেননি, কিন্তু যা লিখেছেন তা নিতান্তই কম শব্দে অনেক বেশিকিছুর প্রকাশ। যাকে বলে, বিন্দুতে সিন্ধুর বিশালত্ব। লেখাগুলো তার অনন্য সাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে।

বেকনের অন্যতম কালজয়ী প্রবন্ধ ‘Of Love’। প্রথম প্রকাশ ১৬১২ সাল। বাস্তবে প্রেম এবং কল্পনায় বা নাটকে/থিয়েটারে যে ভালোবাসা প্রদর্শিত হয়- এর তফাৎ নিয়ে এ রচনায় আলোচনা করা হয়েছে। তাছাড়া প্রকৃত প্রেমের প্রকৃতি কী রকম হবে, তাও আলোচনা করেছেন লেখক। প্রন্ধটির ভাবানুবাদ নিচে দেওয়া হলো :

মঞ্চ মানুষের জীবনের চেয়ে প্রেম-ভালোবাসাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে মঞ্চস্থ করে থাকে। মঞ্চের নাটকে ‘মিলনাত্বক ও বিয়োগাত্বক’ উভয় ক্ষেত্রেই প্রেম একটি নিত্যকালীন ব্যাপার। কিন্তু বাস্তব জীবনে প্রেম যথেষ্ট অনিষ্টের কারণ হয়ে থাকে। সেখানে সে কখনো কুহকিনী বা মনমোহিনী নারী, কখনো ক্রোধোন্মত্তবেশে অবির্ভূত হয়। খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, প্রাচীন ও সাম্প্রতিককালের কোনো প্রাতঃস্মরণীয় মহান ও গুণী ব্যক্তিদের কেউ-ই প্রেমের নামে উন্মাদ হননি। যার অর্থ, বিশাল ও মহৎ কর্মে ব্যাপৃত মানুষেরা এই দুর্বলতা থেকে যথাসম্ভব নিজেদেরকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তবে মার্ক এন্টোনি’কে ব্যতিক্রম মানতে হবে- যিনি রোমক সাম্রাজ্যের অর্ধেকের অধিপতি ছিলেন। এ ছাড়া, অ্যাপিয়াস ক্লডিয়াস, যিনি রোমক সাম্রাজ্যের দশ সদস্যবিশিষ্ট শাসন পর্ষদের সদস্য ও আইনপ্রণেতা ছিলেন। দু’জনের মধ্যে প্রথমজন অত্যধিক ইন্দ্রিয়পরায়ণ ও অসংযত স্বভাবের ছিলেন; কিন্তু দ্বিতীয়জন কঠিন নিয়মনিষ্ঠ ও জ্ঞানী হিসেবে খ্যাত ছিলেন। আর তাই (যদিও কদাচিৎ) ভালোবাসা শুধু উন্মুক্ত হৃদয়ে জায়গা করে নেয় তা নয়, অসতর্ক হলে অনেক সুরক্ষিত হৃদয়েও তার অনুপ্রবেশ ঘটে থাকে। ‘আমরা দুজনই বিশাল এক রঙ্গমঞ্চের জন্য যথেষ্ট’-এটা গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরিয়াস (Epicurus)-এর একটি অর্থহীন মন্তব্য। ভাবখানা এমন যে, সমস্ত মহৎ বস্তুর প্রতি মনোযোগ প্রদানের জন্য ঈশ্বর-সৃষ্ট যে মানুষ, তার কাজ হল শুধু নতজানু হয়ে আপন প্রেমমূর্তির আরতি করা, আর মুখটা না হলেও (যেমন পশুর মতো) মহৎ উদ্দেশ্যে প্রদানকৃত চোখ দুটোকে ভৃত্যে পরিণত করা। প্রেমিকার প্রতি প্রেমিক যে অতিরঞ্জিত প্রশংসাবাণ নিক্ষেপ করে এবং আমাদের প্রকৃতি ও প্রকৃত মূল্যবোধকে বিকৃত করে তোলে, তা বিস্ময়কর। এ ধরনের ধারাবাহিক অতিশয়োক্তি প্রেম ছাড়া আর কোনো কিছুতেই মানানসই নয়। আর তা শুধু কথার মধ্যেই সীমিত থাকে না, চিন্তার মাঝেও থাকে। এ সম্পর্কে চমৎকার মন্তব্য পাওয়া যায় যে, মানুষ নিজেই নিজের চরম তোষামোদকারী, আর তা সমস্ত তোষামোদকারীর মাঝে শ্রেষ্ঠ, কিন্তু তার মধ্যেও প্রেমিক এগিয়ে। কারণ আত্ম-অহংকারী মানুষও কখনো নিজের সম্পর্কে এতটা অতিরঞ্জিত কল্পনা করে না, যতটা প্রেমিকা সম্পর্কে প্রেমিক করে থাকে। আর তাই একটি চমৎকার কথা প্রচলিত আছে, একই সাথে প্রেমিক এবং জ্ঞানী হওয়া অসম্ভব। আর এই দুর্বলতা শুধু অন্যের কাছে নয়, প্রেমিকার কাছেও ধরা পড়ে, এবং প্রেমিকার কাছে সবচেয়ে বেশি করে ধরা পড়ে যদি না প্রতিদানে তার কাছ থেকে প্রেম আসে। প্রেমের সত্যিকার রীতি হল, প্রেমের প্রতিদান প্রেম অথবা প্রেমিকার নিভৃত ও গোপন ঘৃণা। সেই জন্য মানুষকে বেশি করে সতর্ক হতে হয়, যাতে করে প্রেমিকার অনুরাগ হারিয়ে না যায়। এই সম্পর্কে জনৈক কবি চমৎকার মন্তব্য করেছেন, প্যারিস (ট্রয়ের রাজকুমার, প্রিয়াম ও হেকুবার পুত্র) হেলেনকে (গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী জিউস ও লিডার কন্যা) পেতে গিয়ে জুনো (গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী শক্তির দেবী) ও পালাস (গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী জ্ঞানের দেবী)-এর অনুগ্রহ হারাল। আর যে ব্যক্তি বেশিমাত্রায় প্রেমকে গুরুত্ব দেয় সে একই সাথে জ্ঞান ও সম্পদ হারায়। দুর্বল মুহূর্তে প্রেমের বেগ বেড়ে যায়; যেমন পরম সৌভাগ্য ও চরম দুর্ভাগ্যের সময়, যদিও দুর্ভাগ্যের সময় প্রেমকাতরতা কম দেখা যায়, তবে উভয় ক্ষেত্রেই প্রেমের আগুন প্রচণ্ড তীব্রতা নিয়ে হাজির হয় আর তার সাথে মনের উত্তাপ যুক্ত হয়; আর তাই প্রমাণিত হয়, প্রেম হল নির্বুদ্ধিতার ফসল। তারাই উত্তম যারা প্রেমকে এড়াতে না পারলেও তাকে সঠিক সীমার (বিয়ে) মধ্যেই রাখতে সক্ষম হন, এবং জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম থেকে একে আলাদা করে রাখতে পারেন; কারণ এটা যদি আর সব কাজকর্মের মধ্যে ঢুকে পড়ে, তাহলে সৌভাগ্য বিপন্ন হয় এবং মানুষকে এমন করে ফেলে যে, সে আর তার কাজকর্মের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারে কীভাবে বলতে পারব না। কিন্তু যুদ্ধে ব্যাপৃত মানুষরাও প্রেমে লিপ্ত থাকেন। আমার ধারণা, তাদের জন্য এটা পানাসক্তির মতোই ব্যাপার। কারণ বিপদ ভুলে থাকতে গেলে আনন্দে ডুবে থাকতে হয়। মানুষের স্বভাবে অন্যকে ভালোবাসার একটি সহজাত প্রবণতা রয়েছে; আর তা যদি এক-আধজনের পেছনে অপব্যয় করা না হয় তাহলে তা অনেকের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে মানুষকে উদার ও মানবিক করে তোলে, যেমন সাধুসন্তদের বেলায় দেখা যায়।

বিবাহিত জীবনের প্রেম বংশ বৃদ্ধিতে সহায়ক, বন্ধুত্বপূর্ণ প্রেম মানুষকে সত্যিকার মানুষরূপে গড়ে তোলে, কিন্তু কামসর্বস্ব প্রেম মানুষকে বিকৃত ও অধঃপতিত করে।

বেকনের উপর্যুক্ত প্রবন্ধ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তিনি আবেগপ্রবণ প্রেমের জন্য একটি প্রথাগত পন্থা অবলম্বন করেছেন- যা একজন জ্ঞানী ব্যক্তিকে বোকা করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, ২৯ এবং ১৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ভার্জিল রচিত ল্যাটিন মহাকাব্য Aeneid-এ বর্ণিত Aeneas-এর গল্পের উল্লেখ করা যায়। Aeneas ছিলেন একজন ট্রোজান, যিনি ট্রয় রাজত্বের পতনকালে ইতালিতে পালিয়ে যান এবং সেখানে রোমানদের পূর্ব পুরুষ হয়েছিলেন।

ভার্জিল দেখান যে, কীভাবে প্রেমের আবেগে তাড়িত হয়ে রোমকে প্রতিষ্ঠিত করবার দায়িত্ব নির্বাহে চরম অবহেলা করেন তিনি। হন পথভ্রষ্ট ও কক্ষচ্যুত। কারণ তিনি এক বছর কার্থেজের শাসক ও রানী ডিডোর বাহুবন্ধনে কাটিয়ে দেন। কাল কাটান বিচ্যুত হয়ে নিজের দায়িত্ববোধ থেকে। পরিশেষে Aeneas তার দেশে চলে গেলে ডিডো আত্মহত্যা করে।

এমনকি প্লেটোও প্রেমকে এক ধরনের পাগলামো বলে বর্ণনা করেছেন। আবেগপূর্ণ প্রেমকে যুক্তিযুক্তভাবে আলোচনা করা কঠিন, কিন্তু কবি ও লেখকরা চেষ্টা চালিয়ে যান। আবেগপ্রবণ প্রেম কি যুক্তি বিরোধী? প্রেম যখন দরজায় আসে তখন কি যুক্তি জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়? প্রেমকে যন্ত্রণা হিসাবে বর্ণনা করা হলেও প্রায় সব সংস্কৃতিই এটি উদযাপন করে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যযুগে এগারো শতকের শুরুতে পাশ্চাত্যের কবি এবং ট্রুবাদুররা (ফরাসি মধ্যযুগীয় গীতিকবি যারা, বিশেষ করে রাজদরবারী প্রেমের থিমে সংগীত রচনা ও পরিবেশন করতেন) ব্যক্তিদের উন্নত এবং অধিকতর সহানুভূতিশীল মানুষে রূপান্তরিত করার জন্য ভালোবাসার শক্তির জয়গান গেয়েছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর