শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪ ০০:০০ টা

রাজুর ভর্তি পরীক্ষা

হোসেন আবদুল মান্নান

রাজুর ভর্তি পরীক্ষা

রাজু যে বছর ভর্তি হয় সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। আর স্বাধীন বাংলাদেশের মাত্র তিন বছর। মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার আমেজ তখনো যুবকদের চোখেমুখে ঝলমল করছিল। নিজের মাতৃভূমির স্বাধীনতাকে তারা স্বচক্ষে দেখে এবং এতে সশস্ত্র অংশ নেয়। ঢাকার উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে রাজু। সে তখন মুক্তিযুদ্ধ ফেরত টগবগে তারুণ্যে ভরপুর এক যুবক। মুক্তিযুদ্ধের ঠিক পরের বছর এক দুপুরে একদল বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ বরাবর সরাসরি হাজির হয়। এবং সেখানেই তারা ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি হওয়ার সব ঠিক করে ফেলে। যুদ্ধের সময় তারা সবাই এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। যুদ্ধ শেষে নামমাত্র একটা পরীক্ষা দিয়ে অনেকের সঙ্গে রাজুও প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে যায়। এ কথা সত্যি যে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এরা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। বাস্তবে তখনকার সময়টা ছাত্রদের রেজাল্ট বা মেধা যাচাইয়ের জন্য উপযুক্ত ছিল না। ভর্তি চাই, ভর্তি হব। আইনকানুন পরে দেখা যাবে। একজন মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও রাজুর আরও অনেক বড় একটা রেফারেন্স ছিল। কাজেই ভর্তি ঠেকানোর সাধ্য কার? সুতরাং অনেকের সঙ্গে রাজুও ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। তার কাছে ঢাকা কলেজ মানে এক স্বপ্নের ঠিকানা। দীর্ঘ প্রত্যাশিত এক গৌরবময় প্রতিষ্ঠানের নাম।

প্রথম প্রথম কিছুদিন তার কলেজজীবন আনন্দঘন পরিবেশে ভালোভাবেই কাটে। তখন মরণ চাঁদ আর বলাকা সিনেমা হলে কোনো খরচ নেই। নতুন নতুন বন্ধু জুটেছে। একদিন সন্ধ্যা বেলায় তিন বন্ধুসহ রাজু নীলক্ষেত মোড়ের কোহিনূর রেস্তোরাঁয় খাচ্ছিল। হঠাৎ করে পেছন থেকে আলতোভাবে পিঠে হাত রাখেন কলেজের এক বড় নেতা জহির ভাই।

বললেন,

ছোট ভাই কি খাচ্ছ?

রাজু ইতস্তত বোধ করতেই

নেতা বললেন,

ওই শোন, ওদের কাছ থেকে কোনো টাকা-পয়সা নিবে না। ওরা আমার ছোট ভাই।

সেদিন থেকেই রাজু নেতা হওয়ার ঘোর স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে এবং তার জীবনের গতিপথ বাঁকা হতে থাকে।

ইদানীং কলেজের চত্বরে সবাই ভালো ছাত্র, ভালো রেজাল্ট, লাইব্রেরি, পড়াশোনার গল্প এসব দেখে রাজু কিছুটা ভরকে যায়। তার রেজাল্টও মোটামুটি ভালো। তবে মুক্তিযোদ্ধা না হলে ঢাকা কলেজে ভর্তির চিন্তা ছিল তার কাছে আকাশকুসুম। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রাজু বুঝতে পারলো লেখাপড়ার এত চাপ সে নিতে পারবে না। পড়াশোনায় তার ভিত মজবুত নয় বরং অপেক্ষাকৃত দুর্বল। সারা দিন লেখাপড়া তার দ্বারা একেবারেই সম্ভব নয়। নিয়মিত ক্লাসে যাওয়া, শিক্ষকগণের সঙ্গে যোগাযোগ করা, পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ইত্যাদি কাজে ইতোমধ্যেই সে পিছিয়ে পড়েছে। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। তবে তার মাথায় একটাই চিন্তা, লেখাপড়া না করে কীভাবে বিকল্প পথে পরীক্ষার উঁচু দেয়ালটা উৎরে যাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে রাজুর মাথায় সর্বদা নেগেটিভ চিন্তা এসে ভর করে থাকে। কোনো কিছুই সহজ ও সরল রেখায় ভাবতে পারে না। এ কথা সত্যি যে, পৃথিবীতে মানুষের নেতিবাচক মেধার চর্চার কোনো শেষ নেই। এটা অনিঃশেষ।

দুই.

ফাইনাল পরীক্ষা যতই ঘনিয়ে আসছে রাজু ভেতরে ভেতরে ততই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তবে তা কখনো কাছের বন্ধুবান্ধবকে বুঝতে দেয় না। সে সবসময় হাসিখুশি মেজাজে ঘুরেফিরে, হোস্টেলের দোতলায় আসে, একটু বিশ্রাম নেয়, আবার বেরিয়ে যায়। নিষ্পাপ চেহারার সুদর্শন স্মার্ট যুবক রাজু দিনের প্রায় পুরোটাই নেতাদের পেছনে কাটিয়ে দেয়। ভালো জামাকাপড় পরে, রাজু যেন বিনয়ের অবতার। সে অপেক্ষাকৃত অনায়াসেই মানুষকে জয় করে নিতে পারে। অল্প দিনের ব্যবধানে ঢাকা কলেজের সিনিয়র নেতারা তাকে বেশ ভালোবেসে ফেলে। হোস্টেলে সবাই যখন পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত রাজু তখন নিউমার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, বলাকা সিনেমা হলের সামনে বড়ো ভাইদের সঙ্গে চুম্বকের মতন লেগে আছে। মাঝেমধ্যে সুযোগ পেলেই ভিপি, জিএস শ্রেণির নেতাদেরকে জানিয়ে রাখছে,

- ভাইজান আমার পরীক্ষার সময়

একটু সহযোগিতা করতে হবে। আমি তো লেখাপড়া না করে সবসময় আপনাদের সঙ্গেই আছি।

শুনে কখনো কোনো বড়ো ভাই পিঠ চাপড়ে বলে দিচ্ছে

- নো প্রবলেম, তোমার পরীক্ষার ব্যাপারে আমরা দেখবো। তুমি আমাদের সাথে থাক, তুমি ভবিষ্যতে ভালো নেতা হবা। লেখাপড়া করলেই সবকিছু পাওয়া যায় না। এটা যারা করে তারা ছোটখাটো চাকরিবাকরি করবে। আর তুমি থাকবে এমপি, মন্ত্রী।

- জি, ভাইজান। আমার দিকে দেখবেন, পরীক্ষার পরে আমি প্রয়োজনে আপনাদের জন্য জীবন বিলিয়ে দিব।

আশ্চর্য! আই এ ফাইনাল শুরুর ২/৩ দিন আগে থেকে রাজু কিছু বইপত্র সংগ্রহ করতে শুরু করে। সবাই দেখছে সে মন দিয়ে নোটবই, সাজেশন এসব খোঁজাখুঁজি করছে। কেউ বলছে দুই দিনে পাস সম্ভব হবে না। রাজু কারও কথায় কান লাগাতে যায় না। তার কাজ সে নিভৃতে করে চলেছে। সমস্যা হচ্ছে, প্রশ্ন বা উত্তর কোনোটার ওপর তার স্বচ্ছ ধারণা নেই। হাতের কাছে বই থাকলেই যে উত্তর লেখা যাবে এমনটা সব সময় সত্য নয়। রাতভরে লেখাপড়া করে পরীক্ষার দিন সকালে সবাই যে যার মতন হলে যাচ্ছে। রাজু এবং তার আরেক বন্ধু বকুল পাশের একটা ছোট্ট কামরায় প্রবেশ করে। তারা খুব অসুস্থ। সঙ্গে ডাক্তারের পথ্য ও সনদপত্র আছে। তারা পরীক্ষা দিবে সিকবেডে। এ ব্যবস্থা তার বড়ো ভাই কলেজের জিএস রহিম মোল্লা আগেই করে দিয়েছে। শুধু সিক-বেড নয় রাজুর সাহায্যকারী হিসেবে একজন ভালো ছাত্র বকুলকেও একই কক্ষে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলো। প্রতিদিন পরীক্ষা হচ্ছে। সবার সঙ্গে রাজুও দিচ্ছে। তবে আলাদা কক্ষে বসে। বই খাতা সামনে রেখে দিব্যি লিখে দিয়ে যাচ্ছে। তার বিচ্ছিন্ন কক্ষে কেউ উঁকি দিতেও যায় না। মনের আনন্দে সব কিছু লিখে যথাসময়ে খাতা জমা দিচ্ছে। কোনো সমস্যা হলে বড়ো ভাইয়েরা তো আছে। সেবার বিনা বাধায় বিনা ঝামেলায় রাজুর ফাইনাল পরীক্ষা সমাপ্ত হলো। বড়ো ভাইদের প্রতি রাজুর আস্থা, বিশ্বাস ও আনুগত্য দ্বিগুণ ত্রিগুণ বেড়ে গেল। তার মনে পূর্ণাঙ্গ ধারণা জন্মে যে, তাকেও একদিন এমপি, মন্ত্রী হতে হবে। আর এটা হওয়া এদেশে খুবই সহজ কাজ। এখানে সামান্য থেকে বিশেষ হওয়ার সুযোগ পৃথিবীর অন্য দেশের তুলনায় অনেক অনেক বেশি।

তিন.

ফলাফল বের হতে তিন মাস সময় লেগে গেল। রাজু ফার্স্ট ডিভিশন পায়। ঢাকা কলেজ মানে যুগে যুগে প্রথম বিভাগের ছড়াছড়ি। সবাই জানে, দেশের সব ভালো ছাত্র ভর্তি হয়ে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করে ঢাকা কলেজ। দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও প্রায় ঢাকা কলেজের দখলে। কর্মক্ষেত্রেও ঢাকা কলেজের ছাত্রদের আধিপত্য সবার নজর কাড়ে। এসব রাজুর অজানা নয়। এবার রাজুর টার্গেট যে করেই হোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। ভর্তি নিয়ে চিন্তা কি! পরপর দুটো প্রথম বিভাগ তার। এ ছাড়া বড় ভাইয়েরা তো আছেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ বা কোন পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে এসবের ওপর রাজু সারাক্ষণ খোঁজখবর রাখছে। যথাসময়ে আবেদন ফরম সংগ্রহ করা, সাবজেক্ট পছন্দ করা, ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া এগুলো তাকে নিজ উদ্যোগেই করতে হবে। একই সঙ্গে সে নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে। তার রেফারেন্সের কোনো অভাব নেই। ভর্তির আগেই তাকে অনেকে চিনে গেছে। সে এত বিনয়ী নম্র ভদ্র সুদর্শন ছাত্র যে, তাকে প্রথম দর্শনেই সবাই পছন্দ করে ফেলে। মিতভাষী লাজুক স্বভাবের দীর্ঘদেহী যুবক রাজু। সবার কাছেই সে প্রথম প্রেমে পড়ার মতন মুখ। রাজু তার রাজনৈতিক ও সামাজিক যোগাযোগের এমন অভাবনীয় সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রথমেই ড্রাইভ দেয়, যে করে হোক ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আগেই বের করে নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই সে রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের অলিগলি, সহকারী রেজিস্ট্রার, নৈশপ্রহরী, গার্ডসহ নিম্ন পদে চাকরিরত কর্মচারীদের সঙ্গে ওঠা বসা শুরু করে দেয়। এমনকি মুহসীন হলের ভেতরে প্রবেশ করে কত তলায় কোন রুম নিবে তারও হিসাবনিকাশ করতে থাকে। বলাবাহুল্য, মাত্র কিছুদিন আগে হলের নিচ তলায় সেভেন মার্ডারের মতো কলঙ্কজনক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়ে যায়। দেয়ালের গায়ে রক্তের লাল ফোঁটার আলপনা তখনো আতঙ্ক চিহ্ন হিসেবে রয়ে গেছে। এসবে রাজুর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নির্ভার নিঃশঙ্ক। ঢাকার ছেলে তার ওপর মুক্তিযোদ্ধা তার আবার ভয় কীসের? অবস্থা এমন যে, কোথাও কোনো বড় অঘটন ঘটিয়ে ফেললেও তাকে রক্ষা করার মানুষের ঘাটতি হবে না।

চার.

সে বছরের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার এক দিন আগেই মধ্যরাতে রাজুর হাতে একটা মূল খাতাসহ প্রশ্নপত্রের হুবহু কপি চলে আসে। রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের একজন মাঝারি শ্রেণির কর্মকর্তা আর দুজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সহযোগিতায় সে এ কাজে সফলকাম হয়। যদিও বিনিময়ে এদের হাতে তাকে মোটা অঙ্কের টাকা তুলে দিতে হয়েছিল। সেবার রাজুর এক রাতের প্রস্তুতি ছিল আলাদীনের প্রদীপ হাতে পাওয়ার মতন। সে একজন সাহায্যকারী নিয়ে খাতাটি পূর্ণ করে সযত্নে রেখে দেয়। পরদিন সকালে সাজগোছ করে সহাস্য মুখে রাজু পরীক্ষার কেন্দ্রে গিয়ে কিছুক্ষণ অলস সময়ক্ষেপণ করে একপর্যায়ে অতি নিভৃতে গোপনীয় খাতাটি জমা দিয়ে দেয়। একই সঙ্গে নতুন খাতাটি গোপন স্থানে করে নিয়ে বীরদর্পে বেরিয়ে আসে।

অল্প ক’দিনের মধ্যে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো। নোটিস বোর্ডে উপচেপড়া চোখ। কার ক্রমিক নম্বর আছে, আর কার নেই। রাজু এসবের ধারেকাছেও থাকছে না। হঠাৎ সবাই সমস্বরে বলে উঠেছে, রাজু প্রথম হয়ে গেছে। মুহূর্তেই করিডোর জুড়ে রব পড়ে গেছে, রাতারাতি ক্যাম্পাসের প্রিয়মুখ হয়ে যায় রাজু। সামাজিক বিজ্ঞানের যে কোনো সাবজেক্টই তার জন্য দরজা খুলে বসে আছে। এখন শুধু তার সম্মতির অপেক্ষা।

রাজু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য ছিল একজন নিবেদিতপ্রাণ যোদ্ধা। এদিকে বছরখানেক আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নতুন একটা বিষয় চালু করেছে। প্রশাসনিক সার্ভিসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এর চাহিদা তখন তুঙ্গস্পর্শী। রাজু কালবিলম্ব না করে সেই নতুন সাবজেক্টেই ভর্তি হলো এবং মাসদেড়েক অতিবাহিত হওয়ার পরে যথারীতি ক্লাস শুরু হলো। এবারের ভর্তি পরীক্ষায় সর্বাধিক নম্বর প্রাপ্ত ছাত্রটি নতুন সাবজেক্টে এসেছে, জেনে সবাই খুশি ও গর্বিত বোধ করছে। তখন ঢাকার বনেদি পরিবারের ছেলেমেয়েরাও রাজুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এগিয়ে আসছে। কয়েকদিনের ভেতরেই তার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজুর কপালে যেন পূর্ণিমার চাঁদের আলো পড়েছে। বৃহস্পতি হাতে মুঠোয় ধরা দিলে যা হয়।

অপ্রীতিকর ও বিপত্তির কারণ দেখা দেয় টিউটোরিয়াল ক্লাস এবং পরীক্ষাগুলো হলে। শুরুতে রাজু দু-একটা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে আকস্মিক উধাও হয়ে যায়। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রেজাল্ট দেখে বন্ধুরা যত না হতাশ হয়েছে ঢেরবেশি হয়েছেন শিক্ষকগণ। প্রথম বর্ষের প্রথম টেস্টে ২০ মার্কের পরীক্ষায় রাজু পায় সর্বনিম্ন নম্বর। এর পরও রাজু অনিয়মিতভাবে শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হতে থাকে। যদিও পাক্ষিক পরীক্ষাগুলোতে তার আর বসা হচ্ছে না। তবে মধুর ক্যান্টিন, ডাকসু অফিস, টিএসসি চত্বর এবং নেতাদের স্নেহ-ভালোবাসা নিয়ে সে অবলীলায় সময় কাটিয়ে যাচ্ছে। তবে মনে মনে সুযোগ খুঁজছে টিউটোরিয়াল পরীক্ষাগুলো থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার এই আশাটি পূরণ হয়নি। শত চেষ্টাতদ্বিরেও এই সিস্টেমের বাইরে গিয়ে বিকল্প কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। প্রায় বছর তিনেক এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করেও কোনো সুবিধা করতে পারেনি।

অগত্যায় রাজু ঢাকার কবি নজরুল কলেজ থেকে বি এ পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে জয়নাল আবেদীন নামের একজন বেসরকারি কলেজ শিক্ষককে ভাড়া করে। এটাকে ভাড়া বলা যাবে না। বলা যায়, টাকার বিনিময়ে বি এ পাসের কন্ট্রাক্ট করে।

পাঁচ.

একটানা পাঁচ বছর মুহসীন হলের নির্ধারিত কক্ষে থেকেই রাজু নীরবে বি এ পাস করার ব্যবস্থা করে ফেললো। তখন অবধি কেউ বুঝতে পারেনি বা বুঝতে দেওয়া হয়নি যে, সে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র নয়। তবে রাজুর মাথায় সারাক্ষণ কেবল তার বাবা, পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী হাজী জব্বার মিয়ার কথা। আহা! লোকটা না চাইতেই বেহিসাবির মতো বছরের পর বছর ছেলেকে দুই হাত ভরে টাকা দিয়ে গেছেন। কোনো দিন প্রশ্ন তোলেননি। তার একমাত্র ছেলে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র, পাস করে একদিন সে বড় অফিসার বা কিছু একটা হবে। বেচারা এক সমুদ্র স্বপ্ন নিয়ে ছেলের এম এ ডিগ্রির দিকে তাকিয়ে। কাজেই যেভাবেই হোক রাজুর অন্তত একটা স্নাতক পর্যায়ের সনদপত্র থাকা খুবই জরুরি।

দিন যায়, রাত আসে। রাজু প্রতিদিন সকালে কেতাদুরস্ত বেশে বের হয়ে যায়, সন্ধ্যার পরে হাসিমুখে ফিরে আসে। আর ১০ জন জ্যেষ্ঠ ছাত্রের মতন যেন এমফিল, পিএইচডির সার্বক্ষণিক গবেষণায় রত এক পরিশ্রমী শিক্ষাবিদ।

এদিকে অনেক দিন পূর্বেই রাজুর কক্ষটি মফস্বল থেকে আসা একজন নবীন ছাত্রের নামে বরাদ্দ হয়ে আছে। ছাত্রটি তার নিজের কক্ষে ঘুমোতে চায়। নিজের দখলে নিয়ে থাকতে চায়। কিন্তু পারছে না। রাজু তার বহুমাত্রিক ও বহুরৈখিক মেধা দিয়ে তা-ও নিঃশব্দে ম্যানেজ করে চলেছে।

বি এ পাস করার পরে রাজুকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তখন তার টার্গেট এলএলবি করা। এই পরীক্ষা পাসের বিষয়েও একজনের সঙ্গে তার পাকাপাকি চুক্তি হয়ে গেছে।

তার নামে সে পরীক্ষা দিবে। তাই এখন রাজু বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। এক দিন এক বর্ষণমুখর রাতে বাইরে বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাতের বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছিল। রাজু নীলক্ষেতের বইপাড়া থেকে এস, বি, রহিমের একসেট আইনের বই কিনে নিয়ে প্রায় ভেজা শরীরে হলের কক্ষে ফেরে। শরীরের পানি মুছতে মুছতে সে তার রুমমেট কবিরকে বললো, অনেক ভেবে দেখেছি, আমাকে একজন লইয়ার হতে হবে। আমি ওকালতি পেশায় অবতীর্ণ হতে চাই। যা আমার ব্যবসায়ী বাবারও ভীষণ পছন্দের কাজ।

রুমমেট জানতে চাইল,

ভাইজান কোন কলেজে ভর্তি হয়েছেন?

ঢাকা সিটি কলেজে।

এবার রাজু বলতে থাকে

দ্যাখো কবির আমাকে তো তুমি চেনো। আমার মানসিকতা সম্পর্কেও জান। আমি স্বাধীনভাবে চলার পক্ষে। অফিসের বাঁধাধরা চাকরি, লেখালেখি বা প্রথাগত নিয়মনীতি আমার কাছে বরাবরই একঘেয়ে এবং বিরক্তিকর বলে মনে হয়েছে। উদয়াস্ত অন্যের নির্দেশে চলা, অন্যের খবরদারিতে ছোটাছুটি করা- এটা আমার দ্বারা হবে না। এসব আমার একেবারেই স্বভাব-চরিত্র বিরোধী।

 

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর