শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৪ ০০:০০ টা
সাদত হাসান মান্টো’র গল্প

চোখ

ভাষান্তর : শহীদ সাবের তুহিন

চোখ

ওর চোখ দুটো আমার ভালো লেগেছিল। শুধুই চোখ দুটো! সারা দেহের মধ্যে ওর চোখ দুটোই আমার ভালো লেগেছিল। আমায় অভিভূত করেছিল।

চোখ দুটো দেখে মনে হচ্ছিল অন্ধকার রাতে সবার আগে চোখে পড়া মোটর গাড়ির হেড লাইট। ভাববেন না যে চোখ দুটো খুবই সুন্দর, তা কিছুতেই নয়। সুন্দর এবং অসুন্দরের মধ্যে পার্থক্য করার মতো বোধশক্তি আমার আছে। ওই চোখ দুটো আদৌ সুন্দর ছিল না। কিন্তু ওই চোখ দুটোয় কী যেন এক অস্বাভাবিক রকমের আকর্ষণ ছিল। ভীষণ সুন্দর চোখ দুটো।

ওই চোখের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল এক হাসপাতালে। আমি সে হাসপাতালের নাম বলতে চাই না, কারণ এ গল্পের সঙ্গে হাসপাতালের নামের কোনো প্রয়োজন নেই।

ব্যস, বুঝে নিন যে কোনো একটা হাসপাতাল হবে। সে হাসপাতালে আমার এক আত্মীয় অপারেশনের পর জীবনের শেষ দিনগুলো গুনছিল।

এমনিতে আমি রোগীদের কাছে গিয়ে ভরসা দেওয়া, সান্ত্বনার কথা শোনানোর পক্ষপাতী নই। ওসব আমাকে দিয়ে হয় না, কিন্তু স্ত্রীর ঐকান্তিক অনুনয়ে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর প্রতি আমার অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রমাণ দেওয়ার জন্য আমাকে হাসপাতালে যেতে হলো।

বিশ্বাস করুন হাসপাতালে যেতে আমার একেবারেই ভালো লাগে না কেন তা আমি জানি না। হাসপাতালের নার্সদের প্রতিই আমার ঘৃণা রয়েছে কেন, তা জানি না। সম্ভবত এ কারণে যে, একবার আমার এক বৃদ্ধ প্রতিবেশিনীর অবস্থা দেখতে আমাকে বোম্বের জে. জে. হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। বৃদ্ধার পায়ের গোড়ালীতে আঘাত লেগেছিল। হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে আমাকে কম পক্ষে আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ওখানে যার সঙ্গেই আমি আলাপ করেছি তাকেই মনে হয়েছিল লোহার মতো ঠান্ডা এবং অনুভূতিহীন।

মেয়েটি হাসলো। এতে ওর চোখ দুটো আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠল। আমি আমার জীবনে অনেক সুন্দর সুন্দর আকর্ষণীয় চোখ দেখেছি। কিন্তু হানিফার চোখ দুটি ছিল অস্বাভাবিক আকর্ষণীয়। আমি জানি না এই আকর্ষণের কী কারণ। কী ছিল ওই চোখ দুটোয়। আগেই বলেছি খুব সুন্দর চোখ বলা যায় না তবু আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করছিল। আমার মনে একটা অদ্ভুত দাগ কেটেছিল ওই চোখ দুটো। আমি সাহসিকতার পরিচয় দিলাম। এক গোছা চুল ওর একটা চোখ ঢেকে দিয়েছিল। আমি সে চুলের গোছা সরিয়ে ওর মাথায় গুঁজে দিলাম। সে কিছু মনে করল না।

সে যাই হোক, আমার ভালো লাগা চোখ দুটোর কথা বলছিলাম।

পছন্দ-অপছন্দ একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। খুব সম্ভব এ দুটো চোখ দেখে আপনাদের মন মানসে কোনো প্রতিক্রিয়া হবে না। আপনাদের কাছে মন্তব্য চাওয়া হলে আপনারা বলবেন খুব বাজে চোখ-এও বিচিত্র নয়। কিন্তু মেয়েটিকে দেখে সর্বপ্রথম ওর চোখ দুটোই আমার ভালো লেগেছিল

মেয়েটি বোরখা পরে ছিল, তবে মুখে নেকাব ছিল না। হাতে একটা ওষুধের বোতল নিয়ে সে জেনারেল ওয়ার্ডের বারান্দায় একটি ছোট ছেলের হাত ধরে হাঁটছিল।

আমি ওর দিকে তাকাতেই ওর চোখ দুটোতে এক অদ্ভুত চমক সৃষ্টি হলো। চোখ দুটো বড় নয় ছোটও নয়, নীল বা সবুজ-কালো বা বাদামিও নয়। ওর দিকে তাকাতেই কেন যেন আমার পা দুটো থেমে গেল। সেও দাঁড়িয়ে পড়ল। সঙ্গের ছেলেটির হাত জোরে আঁকড়ে ধরে বলল, হাঁটছিস না কেন?

 

ছেলেটি বিরক্তির স্বরে বলল, হাঁটছি, তো-

এ কথা শুনে আমি আবার ওর চোখের দিকে তাকালাম। ওর সমস্ত অস্তিত্বের মধ্যে শুধু চোখ দুটোই আমাকে আকর্ষণ করল।

আমি ওর কাছাকাছি যেতেই ও আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এক্সরে করতে কোন দিকে যেতে হবে?

ঘটনাক্রমে সে সময়ে এক্সরে বিভাগে আমার এক বন্ধু কাজ করছিল। আমি ওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করব বলে যাচ্ছিলাম। মেয়েটির জিজ্ঞাসার জবাবে বললাম, এসো, আমার সঙ্গে, আমি ওদিকেই যাচ্ছি।

মেয়েটি সঙ্গে থাকা ছেলেটির হাত ধরে আমার সঙ্গে চলল। ডাক্তার সাদেকের কথা জিজ্ঞেস করে জানতে পারলান সে এক্সরে নেওয়ার কাজে ব্যস্ত রয়েছে।

দরজা বন্ধ। বাইরে রোগীদের ভিড়। আমি দরজায় কড়া নাড়লাম। ভেতর থেকে জোর গলায় ভেসে এলো, কে? দরজার কড়া নেড়ো না।

কিন্তু আমি আবারও দরজার কড়া নাড়লাম। দরজা খুলে গেল। ডাক্তার সাদেক আমাকে গালি দিতে দিতে থেমে গিয়ে বলল, আরে, তুমি।

- হাঁ, ভাই, তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। তোমার অফিসে গিয়ে শুনতে পেলাম তুমি এখানে।

- এসো, ভেতরে এসো।

আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, এসো। ছেলেটিকে বাইরে থাকতে দাও।

ডাক্তার সাদেক ফিসফিস করে আমাকে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটি কে?

আমি বললাম, জানি না। এক্সরে বিভাগ খুঁজছিল। আমি বললাম, চল, নিয়ে যাই।

ডাক্তার সাদেক দরজা খুলে দিলে আমি মেয়েটিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকলাম।

চার-পাঁচজন রোগী ভেতরেও রয়েছে। ডাক্তার সাদেক তাড়াতাড়ি তাদের স্ক্রিনিং করে ছেড়ে দিল। তারপর কামরায় রইলাম আমরা শুধু তিনজন। আমি, ডাক্তার সাদেক আর সেই মেয়েটি।

ডাক্তার সাদেক আমাকে জিজ্ঞেস করল, ওর কী সমস্যা?

আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, কী সমস্যা তোমার? এক্সরে করার জন্য তোমাকে কোন ডাক্তার বলেছিল?

অন্ধকার কামরায় মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে জবাব দিল, আমি জানি না কী অসুখ। আমাদের পাড়ার এক ডাক্তার তিনি বলেছেন এক্সরে করিয়ে আসতে।

ডাক্তার সাদেক মেয়েটিকে মেশিনের কাছে আসতে বলল। মেয়েটি সামনে এগোতে গিয়ে জোরে ডাক্তারের সঙ্গে ধাক্কা খেল। ডাক্তার সাদেক উচ্চস্বরে বলে উঠল, আরে! লাগল নাকি! দেখে হাঁটবে না সামনে কী আছে!

মেয়েটি চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। ডাক্তার বোরখা খুলে তাকে স্ক্রিনের পেছনে দাঁড় করিয়ে সুইচ অন করল। আমি গ্লাসের দিকে তাকিয়ে ওর অভ্যন্তরের সব কিছু দেখতে পেলাম। ওর হৃৎপিণ্ড কালো চাকার মতো এক কোণে কাঁপছিল।

ডাক্তার সাদেক পাঁচ-ছয় মিনিট পর্যন্ত তাকে পরীক্ষা করল। ডানদিক বাঁ-দিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কি যেন দেখতে থাকল। তারপর সুইচ অফ করে দিল এবং আলো জ্বালিয়ে বলল, বুক অত্যন্ত পরিষ্কার। কোনো চিন্তা নেই।

মেয়েটি কী বুঝল কে জানে, পুরুষ্ট বুকে ওড়না পরিপাটি করে জড়িয়ে বোরখা খুঁজতে লাগল।

বোরখা বেঞ্চির এক কোণে পড়েছিল। আমি ওর হাতে তুলে দিলাম। ডাক্তার সাদেক রিপোর্ট লিখে তাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?

মেয়েটি বোরখা পরতে পরতে বলল, জী, আমার নাম-আমার নাম হানিফা।

-হানিফা। বলে ডাক্তার একটি কাগজে এক্সরে রিপোর্ট লিখে মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল, যাও তোমার সেই ডাক্তারকে দেখাবে।

মেয়েটি হাতে দেওয়া কাগজখানা বাহুর কাছে কামিজের ভেতর রেখে দিল।

বাইরে বেরিয়ে আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেয়েটিকে অনুসরণ করলাম। কিন্তু আমি ভালোভাবেই অনুভব করছিলাম যে, ডাক্তার সাদেক আমাকে সন্দেহের চোখে দেখেছেন। তাকে যতটুকু জানি, সে ধরে নিয়েছিল যে মেয়েটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক রয়েছে। অথচ এ ধরনের কোনো ব্যাপার নয়, শুধু ওর চোখ দুটো আমার ভালো লেগেছিল। আমি ওর চোখ দুটোর প্রেমে পড়েছিলাম। এটুকুই। ব্যস!

আমি মেয়েটির পেছনে পেছনে হেঁটে চললাম। সে সঙ্গের ছেলেটির একটা হাত ধরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। টাঙ্গা স্টেশনে গিয়ে আমি হানিফাকে জিজ্ঞেস করলাম-তোমরা কোথায় যাবে?

মেয়েটি একটি গলির নাম বলল। আমি মিছেমিছি বললাম, আমিও ওদিকেই যাব। চল তোমাদের বাসায় পৌঁছে দেব।

আমি মেয়েটির হাত ধরে যখন টাঙ্গায় উঠিয়ে বসালাম তখন মনে হলো আমার চোখ যেন এক্সরের গ্লাসে পরিণত হয়েছে। ওর হাড় মাংস কিছু নয় শুধু যেন দেহ কাঠামোই দেখতে পাচ্ছিলাম। তবে ওর চোখ দুটো সম্পূর্ণ পরিচ্ছন্ন এবং অত্যন্ত আকর্ষণীয়। প্রাণবন্ত, অদ্ভুত সেই চোখ দুটো!

ইচ্ছে হচ্ছে ওর পাশে গিয়ে বসি, কিন্তু ভাবলাম কেউ দেখে ফেলবে, এ জন্য ছেলেটিকে ওর পাশে বসিয়ে আমি মুখোমুখি আসনে বসলাম।

টাঙ্গা চলতে শুরু করলে হানিফা আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?

 

-আমি, আমি মান্টো, সাদত হাসান মান্টো।

-মান্টো-এই মান্টো-টা কী?

-কাশ্মিরীদের একটা জাত।

-আমরাও কাশ্মিরী।

-তাই নাকি?

- আমরা কুণ্ড।

- ও-তো খুব উঁচু জাত!

মেয়েটি হাসলো। এতে ওর চোখ দুটো আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠলো।

আমি আমার জীবনে অনেক সুন্দর সুন্দর আকর্ষণীয় চোখ দেখেছি। কিন্তু হানিফার চোখ দুটি ছিল অস্বাভাবিক আকর্ষণীয়। আমি জানি না এই আকর্ষণের কী কারণ। কী ছিল ওই চোখ দুটোয়। আগেই বলেছি খুব সুন্দর চোখ বলা যায় না তবু আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করছিল। আমার মনে একটা অদ্ভুত দাগ কেটেছিল ওই চোখ দুটো।

আমি সাহসিকতার পরিচয় দিলাম। এক গোছা চুল ওর একটা চোখ ঢেকে দিয়েছিল। আমি সে চুলের গোছা সরিয়ে ওর মাথায় গুঁজে দিলাম। সে কিছু মনে করল না।

আমি আরও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে ওর একটা হাত হাতে তুলে নিলাম। মেয়েটি এতেও কোনো আপত্তি করল না, তবে সঙ্গের ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমার হাত টিপছ কেন?

আমি সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটির হাত ছেড়ে দিয়ে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের বাসা কোনখানে?

ছেলেটি হাতের ইশারায় বলল, ওই বাজারের পরের গলিটায়।

টাঙ্গা সেদিকেই যাচ্ছিল। বাজারে খুব ভিড়। ট্রাফিকও খুব জ্যাম। টাঙ্গা খুব ধীরে ধীরে চলছিল। রাস্তায় ছোট-বড় গর্ত থাকায় টাঙ্গা জোরে জোরে ধাক্কা খাচ্ছিস। বারবার ওর মাথা আমার কাঁধের কাছে এসে পড়ছিল। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল ওর মাথা কোলে টেনে চোখ দুটো মন ভরে দেখতে থাকি

কিছুক্ষণ পর তাদের বাসা এসে পড়ল। ছেলেটি টাঙ্গা থামাতে বলল। টাঙ্গা থামলে সে নিচে নেমে গেল। হানিফা বসে রইল। আমি তাকে বললাম, তোমাদের বাসা এসে গেছে।

হানিফা আমার দিকে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, বদরু কোথায়?

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন বদরু?

সে বলল, যে ছেলেটি আমার সঙ্গে ছিল।

 

আমি টাঙ্গার পাশে দাঁড়ানো ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললাম, এই যে দাঁড়িয়ে আছে।

-আচ্ছা। বলে মেয়েটি বলল, বদরু আমাকে নামিয়ে দাও।

বদরু ওর হাত ধরে অনেক কষ্ট করে নিচে নামালো। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। পেছনের আসনে গিয়ে বসতে বসতে আমি ছেলেটিকে বললাম, কী ব্যাপার বদরু, ও নিজে নামতে পারে না?

বদরু জবাব দিল, জী না, ওর চোখ খারাপ, দেখতে পায় না। ও অন্ধ।

 

 

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর