গল্প
পাঁচটা বিশের সাগরদাঁড়ি ট্রেনটির আজ আধ ঘণ্টা দেরি হলো। হুইসেল বাজিয়ে এইমাত্র যশোর রেলওয়ে জংশনে প্রবেশ করল। হুইসেল শুনতেই কোনার এক বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াল জয়িতা। তাকে ঈশ্বরদী ফিরতে হবে। জয়িতাকে উঠতে দেখে সজীবও উঠল। জয়িতাকে প্যাকেটটি দিতে হবে। এখনই দিতে হবে। ‘জয়িতা কী মনে করবে?’ চিন্তা করল একবার। কিন্তু উপায় নেই। মন শক্ত করে নিল সজীব। ছোট্ট করে ডাক দিল, ‘জয়িতা, শোনো।’
জয়িতাকে এত ক্ষীণ কণ্ঠে কেন ডাকবে সে? অবাক হলো নিজে নিজে। এই ক্ষীণ ডাক এতটাই স্বল্প ছিল যে নিজেই শুনতে পেল না। বরং তিন বছর আগের ডাকটিই যেন কানে ভেসে আসে। যশোর স্টেশনেই জয়িতাকে সেদিন ডাক দিয়েছিল সজীব। সেই স্মৃতি আজ খুব ভর করে তার ওপরে।
সেলুলয়েডের মতো অতীতের দৃশ্যপট যেন হাজির হতে থাকে তার সামনে। অতীতের সেই দিনে জয়িতাকে যশোরে হঠাৎ দেখে অবাক হয়েছিল সজীব। মাঝে বেশ কবছর যোগাযোগ নেই। এরও বছর কয়েক আগে জয়িতার সঙ্গে পরিচয়। বন্ধু তমালের সূত্র ধরে ঢাকায় ওদের দেখা। তমালদের সঙ্গেই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। একটু বেশিই আধুনিক। ঢাকায় বেশ কয়েকবার দেখা ও আড্ডাবাজির কারণে সম্পর্কটা সহজ হয়ে গিয়েছিল। সেই জয়িতা হঠাৎ যশোর স্টেশনে! অবাক হওয়ারই কথা।
ডাক শুনে জয়িতা ফিরে তাকিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, ‘আরে সজীব, তোমার কথাই ভাবছিলাম। ভাবছিলাম যশোরে এলাম, দেখা করতে পারলে ভালো লাগত। আর কী আশ্চর্য দেখা হয়ে গেল!’
সেদিন সজীবের বাইকে চড়েই বেরিয়ে পড়েছিল। এরপর মাঝে মধ্যেই যশোরে আসত জয়িতা। সজীবের সঙ্গে ঘুরতো শহরের আনাচকানাচে। মাঝে মাঝে সজীবকে না বলে হারিয়েও যেত। জিজ্ঞেস করলে বলত, বর খুঁজতে গিয়েছিলাম। বছরখানেক এভাবে ঘোরার পর ধীরে ধীরে হৃদয়ের মাঝে একটু একটু করে দুর্বলতা অনুভব করতে থাকে সজীব। যদিও পাত্তা দিত না। কিন্তু হৃদয়ের টান বলে কথা!
দাপটের সঙ্গে ছাত্ররাজনীতি করে আসা সজীব লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে এখন পুরো দস্তুর ব্যবসায়ী। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ব্যবসাটা বেশ দাঁড়িয়ে গেছে। কাজের চাপে প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকতে হয়। তারপরও জয়িতা এলে সময় দেয়। জয়িতাও সজীবের সঙ্গসুখ উপভোগ করে।
পুরাতন কথা ভাবতে ভাবতে ভাবনার জগতেই ঘুরপাক খেতে থাকে সজীব। ভার্সিটিতে পড়ার সময় কী প্রাণচঞ্চল আর সাহসীই না ছিল জয়িতা। সব কিছুতেই ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিত। কখনো জিতে যেত, কখনো হারত। কিন্তু হারলেও লড়াই চলত সমানে সমান। সেই জয়িতা; এখন কি একটু ম্রিয়মাণ, একটু অন্যরকম? নিজেকে প্রশ্ন করে সজীব।
যদিও ইদানীং পরিচিত বন্ধুমহল থেকে জয়িতা সম্পর্কে অনেক কানকথা কানে আসে। কিন্তু সজীব কানে তোলে না, পাত্তা দেয় না। এ ধরনের কথা ভার্সিটিতে পড়ার সময়ও শুনেছে। কিন্তু সেসব কথার কোনো ভিত্তি পায়নি। তাই পুরোনো সেই কাব্য নতুন মোড়কে হাজির হওয়ায় পাত্তা দেওয়ার কোনো মানে আছে বলে মনে হয়নি সজীবের।
সে সময় জয়িতা আর তমালকে জড়িয়ে গল্প প্রচার করা হতো অতনুর কাছে; অতনুর গল্প হাজির হতো সজীবের কাছে; আর সজীব-জয়িতা কাহিনি শুনত তমাল। এভাবেই বৃত্তাকারে গল্পগুলো ঘুরে বেড়াত এদিক-সেদিক। মাঝে মধ্যে জয়িতাও এসব গল্প আলোচনায় তোলে। মজা করে সজীবের সঙ্গে। বলে, ‘এই খবরদার! প্রেমে পড়ে বসো না কিন্তু; আমার কিন্তু অনেক প্রেমিক।’ তারপর হো হো করে হেসে ওঠে। সঙ্গে হাসতে থাকে সজীবও।
সেই সব নানা ঘটনা, কোনোটার সঙ্গে কোনোটার মিল নেই; কিন্তু একই সঙ্গে জড়ো হতে থাকে স্মৃতির আকাশে।
ঈশ্বরদীর উদ্দেশে ট্রেনটি ছেড়ে যাওয়ার হুইসেল শোনা গেল। স্মৃতির মেঘ সরিয়ে বাস্তবতায় ফিরে আসার চেষ্টা করে সজীব। জয়িতা ট্রেনে উঠে গেছে। জানলার পাশে বসে মুখ বের করে আছে। বাইরে থেকেই ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায় সজীব। জানালা দিয়ে আস্তে করে ছোট্ট একটি প্যাকেট বাড়িয়ে দেয় জয়িতার দিকে। কৌতূহলী দৃষ্টিতে সজীবের দিকে তাকাল জয়িতা। হাতে নিল। তারপর প্যাকেটটির ভিতরে তাকিয়েই যেন ফুঁসে ওঠল। তার চোখ নিমিষেই লালবর্ণ ধারণ করল। ক্রুদ্ধ জয়িতা ফেটে পড়তে চাইছে যেন।
শক্ত হাতে প্যাকেটটি দুমড়ে মুচড়ে সজীবের মুখে ছুড়ে দিল। আর বলল, ‘ছিঃ সজীব! তোমাকে আমি আর দশটা পুরুষের মতো ভাবিনি। অন্য চোখে দেখতাম। একেবারে অন্যরকম। কিন্তু তুমি এটা কী করলে!’ ফুঁসতে থাকে জয়িতা।
শূন্যের দিকে তাকিয়ে জয়িতার সব কথা শুনছিল সজীব। শুনছিল বললে ভুল হবে, হজম করছিল যেন। চোখ ভিজে যাচ্ছিল। কিন্তু সজীবের চোখ ভিজবে কেন- জয়িতা বুঝতে পারছিল না। সে যে কাজ করেছে তাতে আরও বেশি বলা উচিত ছিল বলে মনে করে জয়িতা।
সজীবের বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তের হট্টগোলেও টের পেল জয়িতা। কিন্তু তা হবে কেন। সে তো ভুল কিছু বলেনি। খুব ভালোবাসার মানুষ তাকে পশুতুল্য দৃষ্টিতে দেখলে এভাবেই বলা উচিত। জয়িতা বলবে। তাতে সজীবের চোখ ভিজলে ভিজে যাক। তারপরও বলবে।
সজীব চুপচাপ সময় থেকে বেরিয়ে এলো। বেদনার্ত চোখে জয়িতার দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টিতে কষ্ট, ঘৃণা, হতাশা, তাচ্ছিল্য, ভালোবাসা সব যেন এক সঙ্গে মিশে ছিল। মুখ খুলল। আস্তে আস্তে জয়িতাকে বলল, তোমাকে দেওয়ার উদ্দেশে এই বিশেষ প্যাকেটটি কিনতে আমাকে কোনো ফার্মেসিতে যেতে হয়নি জয়িতা। কোনো বন্ধুও আমাকে সাহায্য করেনি। এই প্যাকেটটি আমার ভালোবাসার নীলপরিটির। এটা আমার অফিসে তার ব্যাগ থেকেই পড়ে গিয়েছিল।’
সজীবের এই কথাগুলো জয়িতার মুখের সব রক্ত শুষে নিচ্ছিল। পান্ডুর মুখটির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল সজীব। ঠোঁট কাঁপছিল। কথা বলতে পারছিল না। চোখে যেন সাগর দেখা যাচ্ছিল। তারপরও তাকে আজ বলতে হবে। সে আবার বলল, ‘জানো আমার ভালোবাসার নীলপরিটির নাম কী?’
জয়িতা যেন সব বুঝে গিয়েছে। সে যেন জেনে গিয়েছে ওই নীলপরিটির সব। একটু আগে জয়িতার চোখে জমে ওঠা রক্ত সারা শরীরে মিলিয়ে গেল। আর সেখানে ভেসে উঠল এক অনুভূতি, ক্ষমা পাওয়ার এক আকাক্সক্ষা।
ট্রেনটি চলতে শুরু করেছে। কিন্তু জয়িতার মনে হলো, ধাবমান ট্রেনটি স্থবির, নিশ্চল। ছুটতে শুরু করেছে প্ল্যাটফর্মটি। আর সেই প্ল্যাটফর্মের উপরেই আরও দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে সজীব। দূর, বহু দূর...।