গল্প
আকাশবলাকা পাখা মেলল। বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উড়ে চলল সূত্রে। দিনের আলো তখনো কমেনি। বিকালের এসময় পাখায় ভর করতে ভালো লাগে আকাশবলাকার। চিল, পায়রা তার সাথী হয়। তবে সবার পাখায় খেলা করে আলাদা আলাদা ছন্দ। আজও খেলা করছে।
বালুচর দ্বীপের বিকালটা ফারহানের কাছে অন্যরকম ভালোলাগা তৈরি করে। পড়ন্ত বিকালের মোলায়েম আলো ছুঁয়ে আকাশবলাকার পাখায় কবিতার ছন্দ খোঁজে। এক সপ্তাহ হলো বিশেষ কাজে এখানে এসেছে। ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে, কিন্তু ফিরতে ভালো লাগছে না। ফিরলেই ফের হট্টগোল, যানবাহনের কান আজানো প্যা-পু শব্দ, ট্রাফিকিং, নৈরাজ্য, অরাজকতা, হানাহানি। সংবাদ-শিরোনামে ধর্ষণ, বিচার, বিচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-বিক্ষোভ।
খবরের কাগজে কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছে ফারহান। প্রায়ই মনে হয়, দেশটা অন্যরকম হলে কতই না মজা হতো-বালুচরদ্বীপের মতো, এই দ্বীপের আকাশবলাকার মতো।
আজ বিকালটায় ব্যালকনিতে বসে আছে ফারহান। অন্য বিকাল মনীর তীরে কাটে। বিকালের সবকিছু ঝিম ধরে আছে। চিন্তা, কল্পনা, ভবিষ্যৎ- সবকিছুতেই ঝিমঝিম ভাব। চেয়ারে হেলান দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে আকাশবলাকার ওড়াঘুরা দেখছে ফারহান। সাঁই করে মেঘের দল ছুঁয়ে আবার নীলরাজ্যে খেলছে আকাশবলাকা।
মুঠোফোনে কল এসেছে। রিংটোনে বাজছে, ‘এ তুমি ক্যামন তুমি চোখের তারায় আয়না ধরো, এ ক্যামন কান্না বলো আমায় যখন আদর করো?’
কল ধরতে ভালো লাগছে না ফারহানের। অফিসের কল। হয়তো আবারো কোনো দুর্ঘটনা, হয়তো কোনো ধর্ষণ। হতে পারে ফুটপথে গাড়ি উঠিয়ে প্রাণ কেড়ে নিয়েছে উজবুক পরিবহন, হাঁটু পর্যন্ত ছাড়িয়ে নিয়েছে হয়তো।
চিন্তার মাঝেই দুবার কল এসে কেটে গিয়ে মুঠোফোন শান্ত হলো। খানিক বাদে আবারও এলো। এবার মৌমিতার। পরিচয়ে সহধর্মিণী, স্ত্রী, ওয়াইফ-কোনোটাই বলতে নারাজ ফারহান। সরাসরি বউ বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ফোনে বউ নামেই সেভ করা। রিসিভ করল ফারহান। মনটা ভালো হয়ে গ্যালো। এই মেয়েটি মন খারাপের সময়টা বুঝে যায়। বারবার এমন ঘটনার পর বউ নিয়ে তার একটি বক্তব্য আছে-বউরা মন খারাপের সময় টের পায়। সহধর্মিণী, অর্ধাঙ্গিনী, ওয়াইফ, স্ত্রীরা পায় না। তারা পকেট ভরলে টের পায়।
মৌমিতা ফারহানের বিশুদ্ধ বউ। পকেট নিয়ে তার চিন্তা নেই। কখন খালি, কখন ভরা-খোঁজ রাখে না। টেরও পায় না। শুধু ফারহানের মন খারাপ টের পায়। মন খারাপ হলে দুুই মিনিটেই ভালো করে দেয়।
কথা বলতে বলতে বালুচর দ্বীপের সড়কে নেমে এলো ফারহান।
মৌমিতা গিয়েছিল বনশ্রীতে। সেখান থেকে ফিরতি পথে ফারহানকে কল করেছে। ফারহানের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছে। সামান্য দূরত্ব রেখে পুলিশের এক সদস্য তাকে ফলো করছে। ইদানীং আইন বেশ কড়া। ফুটপাথে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা নিষেধ। বালুচর দ্বীপ নিয়ে ফারহানের গবেষণাপত্র প্রকাশের পরই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে মৌমিতার সরকার। জনগণের জীবনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দিতে এই ব্যবস্থা। পুলিশ সদস্য বেশ হ্যান্ডসাম। মৌমিতার ডানপাশ দিয়ে একবার সামনে এগিয়ে আবার হাঁটায় ধীরগতি এনে পেছনে যাচ্ছে। অথচ মৌমিতাকে থামাচ্ছে না, জরিমানা করার জন্যও থামাচ্ছে না।
কিছুটা অস্বস্তিতে ভুগছে মৌমিতা। ফারহানের সঙ্গে কথা বলার সময় ফুল কনসেনট্রেশন থাকে মৌমিতার। এমন ঘটনার মুখোমুখি হবে জানলে পরে কথা বলত।
এবার মৌমিতার প্রায় গা-ঘেঁষে হাঁটছে পুলিশ-যুবক। অস্বস্তির চরমে গিয়ে ঠেকল মৌমিতা। ফারহানকে বলল, ‘ওয়েট, জাস্ট অ্যা মিনিট।’ তারপর পুলিশ যুবকটির দিকে তাকালো। সেও বুঝে নিলো চোখের ভাষা। বলল, ‘ম্যাডাম, কিছু মনে করবেন না। আপনাকে দেখে সচেতনই মনে হচ্ছে। খুব জরুরি না হলে ফুটপাথে হাঁটার সময় নিশ্চয় মুঠোফোনে কথা বলতেন না। কিন্তু কথা বলার সময় আপনি ফুটপাথ থেকে রাস্তার ধারে চলে আসছিলেন। এতে আপনার প্রাণহানি হতে পারে। তাই ডানপাশ দিয়ে আগেপিছে হাঁটছিলাম। ওসময়ে আপনি রাস্তার ধার থেকে সরে যাচ্ছিলেন।
পুলিশ সদস্যের এমন সব কথায় বিমুগ্ধ হয়ে গ্যালো মৌমিতা। মনে হচ্ছিল, কোনো এক জাদুকর এসে এক নিমিষে দেশটির সবকিছু বদলে দিয়েছে। মানুষের মনকে মানুষ করে দিয়েছে। পুলিশের মনকে মানুষ করে দিয়েছে। মৌমিতার ভাবনার মাঝে পুলিশমানুষটি ‘হ্যাভ অ্যা নাইস ডে, ম্যাম। সাবধানে সুস্থ থাকুন’ বলে চলে গ্যালো। ফারহানের পাশ থেকেও একই কণ্ঠে একই কথা শুনতে পেল মৌমিতা, ‘হ্যাভ অ্যা নাইস ডে, স্যার। সাবধানে সুস্থ থাকুন।’