দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বদরবারে ইতিবাচক নানা অবদান রাখার ইতিহাস বাঙালির নতুন নয়। নামজাদা সব প্রতিষ্ঠানে সফলতার সঙ্গে কাজ করে কুড়িয়েছেন সুনাম। তবে এর ব্যাপ্তি দিন দিন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। সে ব্যাপ্তিতে নাম রয়েছে ওয়াহিদ ইবনে রেজার। হলিউড সাম্রাজ্যে তিনি বাংলাদেশি চমক। বিস্তারিত লিখেছেন— তানিয়া তুষ্টি
সিনেমা জগতে হলিউডের ভূমিকা বাদশাহী। তাদের তৈরি সব ক্যাটাগরির সিনেমাতে থাকে স্বাতন্ত্র্য অগ্রসরতা। নতুনত্ব আর বিস্ময়ে ভরা সেসব বৈশিষ্ট্য তাবৎ দুনিয়ার অনুকরণের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়। তাই সহজেই বোঝা যায় এর কারিগররাও বিশেষ কৌশল অবলম্বনে সিদ্ধহস্ত। আর সে কৌশল বাস্তবায়নে যদি কোনো বাঙালির অংশীদারিত্ব থাকে তবে তা অবশ্যই গর্বের। হলিউডের নামজাদা প্রযোজনা সংস্থা সনি পিকচার্স স্টুডিওর অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান সনি পিকচার্স ইমেজওয়ার্কসের হয়ে কাজ করার গৌরব অর্জন করেছেন বাংলাদেশি তরুণ ওয়াহিদ ইবনে রেজা। অবশ্য এই পথে তিনি হাঁটছেন আরও আগে থেকেই।
২ অক্টোবর থেকে তিনি সনি পিকচার্স ইমেজওয়ার্কসে অ্যাসোসিয়েট প্রোডাকশন ম্যানেজার পদে কাজ শুরু করেছেন। কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার শহর ভ্যানক্যুভারে এর কার্যালয়। প্রথমে হলিউডের ফ্যান্টাসি-কমেডি ধাঁচের অ্যানিমেটেড ফ্র্যাঞ্চাইজি ‘হোটেল ট্রানসিলভানিয়া’র তৃতীয় পর্বে চূড়ান্ত পর্যায়ের কারিগরি টিমে কাজ করবেন। সেখানে তার দায়িত্ব থাকবে লাইটিং ও কম্পিউটার গ্রাফিক্স বিভাগে। সঙ্গে থাকবেন তার মতো আরও চারজন ম্যানেজার। ২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘হোটেল ট্রানসিলভানিয়া’ এবং ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘হোটেল ট্রানসিলভানিয়া টু’ ছিল দুটি সাড়া জাগানো সিনেমা। ছবি দুটির পরিচালক ছিলেন রুশ নির্মাতা জেন্ডি টারটাভস্কি। কাজ করেছেন ‘আয়রন ম্যান টু’ এর স্টরিবোর্ড আর্টিস্ট হিসেবেও। এবার তার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাবেন ওয়াহিদ।
ওয়াহিদ ইবনে রেজা। কাছের মানুষেরা তাকে চেনেন বাপ্পি হিসেবে। ছাত্রাবস্থায় যোগ দিয়েছিলেন বিখ্যাত কার্টুনিস্ট লেখক আহসান হাবীব সম্পাদিত উন্মাদ-এ স্টাফ রাইটার হিসেবে। প্রিন্টার্স লাইনে ওয়াহিদের নামের পাশে লেথা থাকে ‘বিদেশ প্রতিনিধি’। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক শেষ করেন ওয়াহিদ। যোগ দেন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। কিন্তু চাকরিতে তার মন বসে না, কিছুদিন পরই সব ছেড়েছুড়ে নাটক লেখা শুরু করেন। এরপর বিজ্ঞাপন দুনিয়ায় প্রবেশ করেন। কিছুদিন ক্যারটকমে কাজ করে যোগ দেন গ্রে অ্যাডভার্টাইজিং বাংলাদেশে। সেখানে কপি হেডের দায়িত্বে ছিলেন ওয়াহিদ। ২০১০ সালে ওয়াহিদ দেশ ছেড়ে কানাডায় পড়তে যান। ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব
ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় ফিল্ম প্রোডাকশন বিষয়ে। দেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত উন্মাদ-এ তার পরিচয় ছিল অ্যাসোসিয়েট এডিটর হিসেবে। বিদেশে গিয়েও কাজের ধাঁচ বদলাননি। ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে ইন্টার্নশিপের জন্য যান মার্কিন প্রতিষ্ঠান এনবিসি ইউনিভার্সেলে। সেখানে তার প্রথম কাজ ছিল টেলিভিশন ধারাবাহিক স্যুটস ও ডিফায়েন্সে। ফাইনাল ইয়ারের প্রজেক্ট হিসেবে ‘হোয়াট আই অ্যাম ডুয়িং হেয়ার’ নামের একটি শর্ট ফিল্ম নির্মাণ করেন। ফিল্মের জন্য পারসিসটেন্স অব ভিশন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তার হাতে ওঠে বেস্ট সিনেমাটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ড। গ্র্যাজুয়েশন শেষে যোগ দেন অ্যানিমেশন স্টুডিও বার্ডেলে। তার কিছুদিন পর এমপিসিতে প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর হিসেবে যোগ দেন। সেটাও বেশিদিন করেননি তিনি। যোগ দেন মেথড স্টুডিওস নামের আরেকটি বিখ্যাত ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট কোম্পানিতে। প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে মার্ভেল এন্টারটেইনমেন্টের সঙ্গে। মার্ভেল এন্টারটেইনমেন্টের সঙ্গে মেথড ভিএফএক্স স্টুডিও যুক্ত থাকার সুবাদে ‘ক্যাপ্টেন আমেরিকা : সিভিল ওয়ার’ ও ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জ’ ছবির ভিজ্যুয়াল টিমে ছিলেন ওয়াহিদ।
হলিউডের ‘ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান : ডন অফ জাস্টিস’ সিনেমায় অনেক মানুষ কাজ করেছেন। এদের মধ্যে পর্দার আড়ালের বা কম্পিউটারের পেছনে থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের অংশীদারও ছিলেন ওয়াহিদ। কানাডার মুভিং পিকচার কোম্পানিতে (এমপিসি) চাকরির সুবাদে ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যানের নতুন ছবিতে ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। সেখানে তার কাজটি ছিল পুরো ভিজ্যুয়াল ইফেক্টসের বিষয়টা সমন্বয় করা। সেখানে কোন দৃশ্য আগে তৈরি হবে কোনটা পরে, কখন কে ডিউটিতে থাকবে, আজ সুপারম্যান নাকি ব্যাটম্যান মারামারির দৃশ্য হবে, নাকি অন্য জায়গার কোনো দৃশ্য পুনরায় তৈরি করতে হবে এরকম হাজারো বিষয় সমন্বয় সাধন তাকে করতে হয়।
ওয়াহিদ তার কর্মজীবনে হলিউডের ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস সেভেন’, ‘নাইট অ্যাট দ্য মিউজিয়াম : সিক্রেট অব দ্য টম্ব, ‘এক্সোডাস : গডস অ্যান্ড কিংস’ এবং ‘ফিফটি শেইডস অব গ্রে’ ছবিতেও ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করেছেন।
আজকের এই গাদা গাদা সফলতা ঘরে নিয়ে আসা মানুষটাও ছাত্রজীবনে মেতে ছিলেন হিমু নিয়ে। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে কাজ করার আগে থেকেই হিমুর মতো সারা ঢাকা শহর খালি পায়ে ঘুরেছেন। বনে গিয়ে চাঁদনী রাত উপভোগ করেছেন। এমনকি পকেট ছাড়া হলুদ পাঞ্জাবি পরেও দিন পার করেছেন। ২০০৭ সালের বইমেলায় হুমায়ূন আহমেদের এই বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে একজন স্বাস্থ্যবান মানুষকে হলুদ পাঞ্জাবি পরিয়ে সারা মেলায় র্যালি করা হয়। তারপরই সেই ব্যক্তি পরিচিতি পেয়ে গেছিলেন হিমু নামে। ‘উন্মাদ’-এরই আরেকটি প্রকাশনা ‘ট্রাভল অ্যান্ড ফ্যাশন’ ম্যাগাজিনের জন্য হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন ২০০৬ সালে। তখনই হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে আজ হিমুর বিয়েতে অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলেন। সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে পরদিনই নুহাশ পল্লীতে যাত্রা। একে একে ‘টার্গেট মিলিনিয়র’ নাটকে কাজের পর ‘চন্দ্রকারিগর’ নাটকে অভিনয় করে পেলেন খ্যাতি। সেজন্যই মূলত ‘আজ হিমুর বিয়ে’ বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলামের বুদ্ধিতে ওয়াহিদকে হিমু বানিয়ে র্যালি করানো হয়েছিল। এ ছাড়াও ২০০৭ সালের একটি টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনচিত্রে দেখা গেল টুথপেস্টের কল্যাণে দাঁত এতই শক্ত যে, খেতে গিয়ে কাঁটা-চামচ পর্যন্ত চিবিয়ে ভেঙে ফেলছে। বিজ্ঞাপনের মডেল একজন স্থুলকায় পুরুষ। আর সেই পুরুষটিই ওয়াহিদ ইবনে রেজা। তার করা প্রতিটি কাজই ব্যাপকভাবে পরিচিতি ছড়ায়।
এসবের মাঝেও অ্যানিমেশন নিয়ে মেতেছিলেন ওয়াহিদ। তৈরি করেছেন অ্যানিমেইটেড শর্ট ‘দ্য প্যারানয়েড ক্যাট’। আর ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান হোজে শহরে সিনে-কোয়েস্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে চারশ জনের মধ্যে মাত্র সাতজনের চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত হয়। তার মধ্যে ওয়াহিদের ‘দ্য প্যারানয়েড ক্যাট’ ছিল একমাত্র অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র। অ্যানিমেশন ছবিটি তৈরি করা হয়েছিল ‘বারকো এস্কোপ’ নামের নতুন ফরম্যাটে। এই ফরম্যাটে সিনেমা হলে চোখের সামনে যে পর্দা থাকে, তার দুই প্রান্তে আরও দুটি ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে পর্দা লাগানো থাকে। ফলে খালি চোখেই অনেকটা থ্রিডি-ভাব মনে হয়। ছোটবেলা থেকেই তার এসবের প্রতি দারুণ আগ্রহ ছিল। মামার কমিক বইয়ের ভাণ্ডার থেকে বিভিন্ন সুপার হিরোর প্রতি আকর্ষণের শুরু। আমেরিকা চেনার আগে, আমি ক্যাপ্টেন আমেরিকাকে চিনেছিলেন। মায়ের পরিয়ে দেওয়া ব্যাটম্যানের পোশাকে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন পুরো বাড়ি। তখন হয়তো কেউ বুঝতে পারেননি ছোট্ট ওয়াহিদ বড় হয়ে মনের ভিতরকার শখকে পেশা হিসেবে নেবেন। তিনি হলিউডের জন্য একটি সিনেমার গল্প লিখেছেন। বাংলাদেশের জন্য একটি সিনেমার চিত্রনাট্যও করেছেন তিনি।