তার হাতে তৈরি হয়েছে অজস্র খেলোয়াড়। মেয়েদের খেলাধুলায় আগ্রহ বাড়াতে দিনরাত পরিশ্রম করতেন আবুল হোসেন। অনেক সময় আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য বাবা-মা মেয়েদের স্কুলে আসা বন্ধ করে দিতেন। বন্ধ হয়ে যেত খেলাধুলাও। তাদের বাড়িতে গিয়ে বাবা-মাকে বুঝিয়ে নিয়ে আসতেন স্কুলে। নিজের পকেটের টাকা খরচ করতেও কার্পণ্য নেই তার। তবুও যদি একটা খেলোয়াড় তৈরি হয়। খেলা পাগল এই মানুষ এখনো ছুটছেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে
ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি ঝোঁক ছিল তাহমিনার (ছদ্মনাম)। দৌড় আর গোল্লাছুটে সাথীদের পেছনে ফেলে বরাবরই অধরা সে। কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হতেই স্বপ্ন ধরা দিল হাতের মুঠোয়। খেলাধুলায় বিশেষত্ব দেখে শরীরচর্চা বিষয়ের শিক্ষক আবুল হোসেন তাকে ডেকে নিলেন হ্যান্ডবল টিমে। ভালোই চলছিল সবকিছু, কিন্তু হঠাৎ করে ফিকে হয়ে গেল তাহমিনার রঙিন স্বপ্নগুলো। অষ্টম শ্রেণিতে উঠতেই বিয়ে হয়ে গেল তার। এরপর পাল্টে যাওয়া জগতে আরেক ধাক্কা। বছরখানেক যেতেই ঘটল বিবাহবিচ্ছেদ। হঠাৎ করে খসে পড়ছিল দপ করে জ্বলে ওঠা তারা। হতাশায় দিশাহারা তাহমিনাকে পথ দেখালেন সেই আবুল স্যার। পরিবারকে বুঝিয়ে তাকে আবার ভর্তি করালেন স্কুলে। আগের চেয়ে আরও মনোযোগী হলো সে খেলাধুলায়। এখন জাতীয় দলে তার সরব অবস্থান। শুধু তাহমিনা নয়, এরকম অসংখ্য থেমে যাওয়া গল্পকে সাফল্যে রূপ দিয়েছেন হিমালয়কন্যা পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়ার ‘আবুল স্যার’। আবুল হোসেনের ‘আবুল স্যার’ হয়ে ওঠার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের হ্যান্ডবলে নারীদের অংশগ্রহণের জয়গাথা। তাইতো তাকে বলা হয় খেলোয়াড় গড়ার কারিগর।
সময়টা তখন ১৯৮৩। আবুল হোসেনের বয়স ২৬ ছুঁইছুঁই। খেলার মাঠে পরিচিত নাম আবুল হোসেন। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি ঝোঁক ছিল তার। তেঁতুলিয়ার তেলিপাড়ার তরুণ আবুল হোসেনের ফুটবল, হ্যান্ডবল ও ভলিবল ছিল পছন্দের খেলা। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে ক্রীড়াঙ্গনে তার বিচরণ বাড়তে থাকে। আন্ত স্কুল ও কলেজ পর্যায়েও তার কৃতিত্ব ছিল বেশ। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান পড়াশোনা শেষ করেই শরীরচর্চা বিষয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে তেঁতুলিয়ার কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেই থেকেই এলাকায় ছাত্রছাত্রীসহ সর্বস্তরের মানুষের কাছে ‘আবুল স্যার’ নামে তার পরিচিতি। স্কুলের মেয়েদের খেলাধুলায় এগিয়ে নিতে মনোযোগী হন আবুল হোসেন। কিন্তু মেয়েদের ঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়া যখন যুদ্ধ জয়ের শামিল তখন খেলার মাঠে তাদের বিচরণ তো অকল্পনীয়। পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবার ও সমাজ। হতদরিদ্র পরিবারের কন্যা সন্তানরা স্কুলে গেলেও খেলাধুলায় খ্যাতি অর্জন কববে— এমনটা তখন ছিল আকাশ-কুসুম কল্পনা।
সেই গল্প শোনাতে গিয়ে গলাটা ভারি হয়ে আসে আবুল হোসেনের। ফিরে যান স্মৃতির পাতায়। ‘স্কুলে চাকরি শুরু করার পর আমি মেয়েদের খেলাধুলায় নিয়ে আসার চিন্তা করি। মেয়েরা স্কুলে তখন গোল্লাছুট, বউচি এসব খেলত। সেখান থেকে যারা ভালো দৌড়ায় এবং চৌকস তাদের নিয়ে দল তৈরির চেষ্টা করি। ফুটবল, ক্রিকেট এগুলো খেলতে অনেক সরঞ্জাম এবং বড় মাঠ লাগে। তাই আমি চিন্তা করি হ্যান্ডবল টিম তৈরির। এতে ছোট একটা মাঠ আর একটা বল হলেই চলে। তখন আনসার ও বিজিবিতে কর্মরত ছিলেন এই এলাকার আবুল কালাম আজাদ ও হায়দার আলী। তারা বাড়িতে এলে মেয়েদের সঙ্গে হ্যান্ডবল খেলত। খেলার বিভিন্ন কৌশল তারা কর্মস্থল থেকে শিখে এসে মেয়েদের শেখাত। সেখান থেকে আমিও শিখে নিতাম এবং পরবর্তীতে মেয়েদের সেগুলো অনুশীলন করাতাম। মেয়েরা মাঠে খেলবে এটা ছিল হিমালয়কন্যাদের কাছে স্বপ্নের মতো। ১৯৯৬ সালে প্রথম আন্তজেলা হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতায় প্রথমবার অংশগ্রহণ করে রানার্স আপ হয় আমার দল। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আমার এই স্বপ্নযাত্রায় সবকিছু দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আমার সহকর্মী, স্কুল কমিটি আর কাজী বাড়ির বড় মনের মানুষগুলো। মেয়েদের এই সাফল্যে পরিবারও আস্তে আস্তে আগ্রহী হয়ে ওঠে। অনেক মেয়েই খেলাধুলায় জাতীয় পর্যায়ের সনদ থাকায় আনসার, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা-বাহিনীতে যোগদান করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম অর্জন করেছেন তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন গ্রাম থেকে উঠে আসা মেয়েরা। তাদের এই কৃতিত্বে বিশাল অবদান আবুল হোসেনের। মহিলা হ্যান্ডবলে বাংলাদেশ আনসারের হয়ে খেলছেন তেঁতুলিয়ার মেয়ে রওশন আক্তার বুলু, রোকসানা আক্তার, মালেকা বেগম, ফাতেমা খাতুন, নিশি, ময়না, রুবিনা আক্তার, রহিমা খাতুন, কহিনুর আক্তার, হোসনে আরা পারভীন, শিফা আক্তার, শারমীন আক্তার রুমি, নাজিরা খাতুন প্রমুখ। বিজেএমসির হয়ে খেলছেন শাহীদা খাতুন, শিল্পী আক্তার, ঝর্ণা আক্তার, রাজিয়া সুলতানা, শিউলি পারভীন, সুমি আক্তার, সুশিলা, তৃপ্তি, হাবিবা আক্তার রূপা, শিরিনা আক্তার, শাহিনা আক্তার প্রমুখ। বর্তমানে জাতীয় মহিলা কাবাডি দলে সুনামের সঙ্গে খেলছেন তেঁতুলিয়ার মমিনপাড়া গ্রামের মেয়ে মালেকা পারভীন। আবুল স্যারের হাতে গড়া এই খেলোয়াড় তার শিক্ষকের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, আমার আজকের এই অবস্থানের পেছনে আবুল স্যারের অবদান বলে শেষ করা যাবে না। আমার বাবা-মাও আমার জন্য এতটা করতে পারত না। স্যারের হাতেখড়িতে আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কুড়িয়েছি সুনাম।
তেঁতুলিয়াকে মানুষের কাছে পরিচিত করিয়েছেন আবুল স্যার। তার হাত তৈরি হয়েছে অজস্র খেলোয়াড়। মেয়েদের খেলাধুলায় আগ্রহ বাড়াতে দিনরাত পরিশ্রম করতেন আবুল হোসেন। অনেক সময় আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য বাবা-মা মেয়েদের স্কুলে আসা বন্ধ করে দিতেন। বন্ধ হয়ে যেত খেলাধুলাও। তাদের বাড়িতে গিয়ে বাবা-মাকে বুঝিয়ে নিয়ে আসতেন স্কুলে। নিজের পকেটের টাকা খরচ করতেও কার্পণ্য নেই তার। তবুও যদি একটা খেলোয়াড় তৈরি হয়। খেলা পাগল এই মানুষ এখনো ছুটছেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে। এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন জাতীয় হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতা নিয়ে। টিম নিয়ে খেলতে এসেছেন যশোরে। এ বছর তার টিম রাজশাহী এবং রংপুর অঞ্চল থেকে প্রথম হয়েছে। এখন চলছে পরবর্তী পর্যায়ের খেলা। বাংলাদেশের হ্যান্ডবলে অধিকাংশ খেলোয়াড় উঠে এসেছে তেঁতুলিয়ার কাজী শাহাবুদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। আর এর পেছনে বছরের পর বছর রক্ত-জল করা পরিশ্রম করে চলেছেন খেলোয়াড় গড়ার কারিগর আবুল হোসেন, খেলোয়াড়দের ‘আবুল স্যার’।