শিরোনাম
শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
মিনহাজ চৌধুরী

বাংলাদেশি তরুণের হাতে ফোর্বসের পুরস্কার

সাইফ ইমন

বাংলাদেশি তরুণের হাতে ফোর্বসের পুরস্কার

অনূর্ধ্ব ৩০ ইম্প্যাক্ট চ্যালেঞ্জ মঞ্চে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মিনহাজ

স্বল্প খরচে আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানির জোগান নিশ্চিত করে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মিনহাজ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান ড্রিংকওয়েল। দুই বছর আগে ফোর্বসের উঠতি তারকা তালিকায় এসেছিলেন মিনহাজ চৌধুরী। সেই ধারাবাহিকতায় এ বছর ফোর্বসের ‘অনূর্ধ্ব ৩০ ইম্প্যাক্ট চ্যালেঞ্জ’ প্রতিযোগিতায় জিতেছে মিনহাজের ‘ড্রিংকওয়েল’ প্রতিষ্ঠানটি। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে ফোর্বস আন্ডার থার্টি সামিটে এই সাফল্য অর্জন করে তার প্রতিষ্ঠান। বিশ্বে অন্যান্য উদ্ভাবনী প্রকল্পগুলোর সঙ্গে কঠিন প্রতিযোগিতায় নেমে ড্রিংকওয়েল জিতে নেয় ৫ লাখ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি টাকায় এই সম্মাননার মূল্য প্রায় ৪১ কোটি টাকা। পানিকে আর্সেনিকমুক্ত করতে ড্রিংকওয়েল উদ্ভাবিত ফিল্টার তুলনামূলক ৪০ শতাংশ কম দামে পাওয়া যায়। এখন এই ফিল্টার বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, ভারত, লাওস ও নেপালের আড়াই লাখ মানুষ ব্যবহার করছে। মানুষের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা ছাড়াও প্রায় ৫০০ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে মিনহাজের ড্রিংকওয়েলে। ২৭ বছর বয়সী মিনহাজ এর আগে ২০১৫ সালে বিখ্যাত মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস-এর ‘৩০ অনূর্ধ্ব ৩০ সামাজিক উদ্যোক্তা’ তালিকায় স্থান করে নেন। মিনহাজের স্বপ্নের সহযোদ্ধা হিসেবে আছেন অরুপ সেনগুপ্ত, মাইক জার্মান ও সঞ্জয় ভার্মা।

 

ড্রিংকওয়েল কী

ভারতে ফুলব্রাইট স্কলারদের এক সম্মেলনের আয়োজন করা হয় ২০১২ সালে। সেখানেই প্রথম মিনহাজ তার ধারণা তুলে ধরেন। গ্রামের মানুষের পানির জন্য অর্থ ব্যয় করার উপায় সৃষ্টি করলেই এমন সমস্যার সমাধান করা যাবে বলে মিনহাজ ধারণা দেন। সেই সম্মেলনে কলকাতার গবেষক অরুপ সেনগুপ্তের একই বিষয়ে এক অভূতপূর্ব কাজের কথা জানতে পারেন মিনহাজ। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও আর্সেনিক সমস্যা বেশ ভয়াবহ। গবেষক সেনগুপ্ত ২০০৪ সাল থেকে ‘উত্তর চব্বিশ পরগনা’ জেলার অশোকনগর গ্রামে এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য বিশেষ এক কর্মসূচি পরিচালনা করছিলেন। আমার চিন্তার সঙ্গে সেনগুপ্তের চিন্তা মিলে যায়।’

এরপরই মিনহাজ যৌথভাবে ড্রিংকওয়েল প্রতিষ্ঠা করেন অরুপ সেনগুপ্ত, মাইক জার্মান ও সঞ্জয় ভার্মাকে নিয়ে। মিনহাজ সংবাদমাধ্যমকে আরও বলেন, ‘গ্রামে গ্রামে পানি বিশুদ্ধকরণ  প্রযুক্তি ও গ্রামের মানুষের কাজের সুযোগ তৈরির ব্যবসায়িক ধারণা দেয়।’ ড্রিংকওয়েল সিস্টেম অরুপ সেনগুপ্ত উদ্ভাবিত পানি শোধনের বিশেষ এক পদ্ধতির নাম। এই পদ্ধতিতে পানি বিশুদ্ধকরণের প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর চেয়ে ৬০ গুণ বেশি পানি উৎপাদন সম্ভব হয়। এ ছাড়া ১৭ গুণ বেশি জ্বালানিসাশ্রয়ী উপায়ে এই পানি সরবরাহ করে ড্রিংকওয়েল। প্রধানত, কারিগরি সহায়তা দেয় ড্রিংকওয়েল। গ্রামবাসী যে টাকা দিয়ে পানি কেনে তা প্লান্ট রক্ষণাবেক্ষণেই ব্যয় হয়।

 

শেকড় বাংলাদেশে

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক মিনহাজ চৌধুরীর শেকড় বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। মিনহাজের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ডালাসে। মিনহাজের বাবা চৌধুরী আহমেদের আদি নিবাস ছিল চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। মিনহাজের মা নাজনীন আহমেদ ও বাবা চৌধুরী আহমেদ দুজনে তরুণ বয়সে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। তার বাবা যন্ত্রকৌশল বিষয়ে পড়েছেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে।

 

আন্তর্জাতিক যাত্রা

মিনহাজের ড্রিংকওয়েল প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিকভাবে সফলতা অর্জন করেছে বিশ্বের অনেকগুলো দেশে। ২০১২ সাল থেকেই ড্রিংকওয়েলের কাজ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ছুটে বেড়াচ্ছেন মিনহাজ। ইতিমধ্যে তার এ প্রকল্প সাফল্য পেয়েছে ভারত, নেপাল, লাওস ও কম্বোডিয়াসহ নানা দেশে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ১৫০ জায়গায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের কাজ করছে ড্রিংকওয়েল। এ ছাড়াও নেপাল, লাওস, কম্বোডিয়ার ২০০ গ্রামে প্রায় ২০ লাখ মানুষ বিশুদ্ধ পানির সুবিধা পাচ্ছে সরাসরি ড্রিংকওয়েলের কাছ থেকে। মিনহাজ সব সময় চাইতেন বাংলাদেশেও প্রতিষ্ঠা পাক ড্রিংকওয়েলের স্বপ্ন। আর তাই ড্রিংকওয়েলকে চালু করতে মিনহাজ এসেছিলেন বাংলাদেশেও। ইউএসএইডের সহযোগিতায় মানিকগঞ্জে পরীক্ষামূলক প্রকল্প শুরু করেন তিনি। শুরুতেই বেশ সাফল্য পেয়েছেন মিনহাজ। মানিকগঞ্জ, কুমিল্লা আর যশোরের অর্ধশত গ্রামে ড্রিংকওয়েল প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের বিশুদ্ধ পানির সমস্যা দূর করতে চান তিনি।

 

শুরুটা বাংলাদেশেই

মিনহাজ স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে স্নাতকে ভর্তি হন। ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে বাংলাদেশে আসেন তিনি। সে সময় তার সঙ্গে আসেন তারই বন্ধু পল ববলিত্জ। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের গোলাইডাঙা গ্রামের নলকূপের আর্সেনিক দূষণ নিয়ে কাজ শুরু করেন তারা। গ্রামের মানুষকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য ১০০ সনোফিল্টার স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান তিনি এবং পল ববলিত্জ। এর দুই বছর পর ২০১১ সালে স্নাতক সম্পন্ন করে আবারও বাংলাদেশে আসেন মিনহাজ। এবার তিনি ব্র্যাকের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। মানিকগঞ্জের সেই গ্রামে ফিরে এসে দেখেন মাত্র তিনটা সনোফিল্টার কাজ করছিল। বিনা পয়সায় পাওয়া সনোফিল্টারগুলো গ্রামের মানুষের অবহেলায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

 

আরও পুরস্কার...

বিশ্বের ১ হাজার উদ্যোক্তা আর ৬০০ উদ্যোগের মধ্য থেকে মিনহাজ স্থান করে নেন বিশ্বসেরাদের কাতারে। এখানেই শেষ নয়। মিনহাজের আছে আরও অর্জন। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্টার্টআপ জ্যাকপট প্রতিযোগিতায় মিনহাজ ও তার ড্রিংকওয়েল প্রকল্প প্রথম স্থান অধিকার করে। ওই বছরই সাউথওয়েস্ট ইকো অ্যাওয়ার্ডসের প্রফিট সোশ্যাল ইম্প্যাক্ট পুরস্কারও পেয়েছেন মিনহাজ আহমেদ।

সিলিকন ভ্যালিতে অবস্থিত দ্য টেক মিউজিয়াম অব ইনোভেশনের টেক অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইন্টেল করপোরেশন ড্রিংকওয়েল সিস্টেমসকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে।

সর্বশেষ খবর