নেদারল্যান্ডসের ইতিহাস হচ্ছে পানির সঙ্গে যুদ্ধ করার ইতিহাস। সপ্তদশ শতকে নির্মিত খালগুলো শহরতলির ঐতিহ্য। পুরোটা জুড়েই আছে আমস্টারডাম নদী। ৯০টি দ্বীপের মধ্যে ১৫০০ ব্রিজের আন্তসংযোগ সৃষ্টি করে রাজধানী শহর আমস্টারডাম। পানির সঙ্গে অদ্ভুত মিলনে বন্দী আশপাশের মানুষের জীবন। এখানকার বাড়ির শাসন অনুশাসনগুলো যেন পানিতে লেখা। অবশ্যই ডুবে মরতে হবে, না হয় সাঁতরে পার হতে হবে। আসলে পানির সঙ্গে দুহিতা যে জীবনের, সেই জীবন এমনই
আমস্টারডাম নদী, খাল এবং পানির মধ্যে মানুষের জীবনগাঁথা, সত্যিই প্রেমে পড়ার মতো। অপরূপ সৌন্দর্যের এই শহরের কথাবার্তাগুলোই যেন পানি। এক ফোঁটা গুজব আমাদের ডুবিয়ে মারতে পারে। কী ভয়ঙ্কর কথা! পানি জীবন আর পানি মরণ। এমন নগর কি আর কোথাও আছে। আমরা জানি- পানি, নদী ও খালেই গ্রামের অস্তিত্ব। প্রিমিটিভ বা খুবই আদিম মানুষ কেবল নদীকে আশ্রয় করে বাস করে। কিন্তু না, সব ধারণারই একটি প্রতিধারণা খোদ এই দুনিয়াতেই আছে। আর সেটি আছে ইউরোপের অন্যতম সমৃদ্ধ নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম নগরীতে। এটি যেন নদী খাল আর পানির সন্তান। নদী, খাল আর পানির নিয়ামতের মধ্যেই নগরীটিকে প্রসারিত করেছে। একটি নদীকে যে আধুনিক নগরজীবনে যোগাযোগের প্রাকৃতিক হাইওয়ে হিসেবে ব্যবহার করা যায়, আমস্টারডামকে না দেখলে বোঝা যাবে না। নদী ও খালের বাঁকে বাঁকে তিন-চারশ বছরের পুরনো স্থাপত্য ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সেই নদী, খাল যেমন এই নগরের যোগাযোগের হাইওয়ে তেমনি সেখানে আছে ট্রাম, বাস ও গাড়ি চলাচলের উপযোগী উন্নত রাস্তাও। আপনার চলার স্বাধীনতা সবদিক দিয়ে।
আমস্টারডাম, নেদারল্যান্ডসের রাজধানী। প্রায় ৯০টি দ্বীপের মধ্যে ১৫০০ ব্রিজের আন্তসংযোগ সৃষ্টি করে ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি জায়গা জুড়ে খালের মধ্যে থাকা এই শহরটি। এগুলোর মধ্যে তিনটি প্রধান খাল— হেরেনগ্রাকট, প্রিন্সেনগ্রাকট এবং কেইজেরগ্রাকট। এগুলো সবই সপ্তদশ শতকে ডাচ স্বর্ণযুগের সময় নির্মিত। এই খালের পাশে প্রায় ১৫৫০টির মতো ঐতিহ্যবাহী ইমারত রয়েছে। সপ্তদশ শতকের খালচক্রের মধ্যে প্রিন্সেনগ্রাকট, কেইজেরগ্রাকট, হেরেনগ্রাকট এবং জর্ডান ২০১০ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই খালের কারণেই আমস্টারডামকে ‘উত্তরের ভেনিস’ বলা হয়। তবে এই শহরের সবটুকুই যে খাল তা কিন্তু নয়, এই খালের বাইরে আছে বিস্তৃত সমতল এবং সেগুলো ইউরোপের অন্যান্য শহরের মতোই। সপ্তদশ শতকে খনন করা এই খালগুলোর মধ্যে গড়ে ওঠা দ্বীপগুলোই এলাকার সবচেয়ে বনেদি এলাকা এবং এগুলো শহরের অন্যান্য অংশের চেয়ে ব্যয়বহুল। এক সময় এই খালগুলো দিয়েই আমস্টারডামের অভ্যন্তরে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। বর্তমানে এই খালগুলো দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের বিনোদনের যেমন অন্যতম আকর্ষণ তেমনি ওই দ্বীপগুলোতে চলাচলের টেকসই মাধ্যম। অত্যন্ত নিরাপদ, শব্দবিহীন এবং বৃষ্টি ও বাতাসের কষ্ট থেকে মুক্তির জন্য এয়ারটাইট ছাউনিযুক্ত নৌ-যান এতটাই মনোরম যে পর্যটকরা এই নৌ-যানের কারণেও নৌপথে আমস্টারডামে ভ্রমণে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। গোটা আমস্টারডামকে সড়কপথের চেয়ে নৌপথেই বেশি মায়াবী মনে হয়। দিনে যেমন, রাতে আমস্টারডাম যেন আরও মনোরম আর মধুময়। ব্রিজগুলোর গায়ে লাগানো আলো যেন আছড়ে পড়ে গোটা খালের বুকে। তার ওপর ঐতিহাসিক ইমারতগুলোতে আলোকসজ্জা তো রয়েছেই। অধিকাংশ ক্যানাল ক্রুইজগুলো এক ঘণ্টার একটি ট্যুর প্যাকেজ পরিচালনা করে। ঘণ্টাপ্রতি ক্যানাল ক্রুজের গড় খরচ ২৫ ইউরো। এক ঘণ্টার ভ্রমণ প্যাকেজের বাইরে আছে হফ অন হফ সার্ভিস, যার আওতায় কোনো স্থান থেকে ক্যানাল ক্রুজে উঠে আরেক স্থানে গিয়ে নামে। এর বাইরে আছে রোমান্টিক ক্যান্ডল ট্যুরস, আছে শিশুবান্ধব ভ্রমণ ও ছোট ছোট দল করে একজন গাইডের অধীনে ভ্রমণ। আমস্টারডামে সুপরিচিত এমন কয়েকটি ক্যানাল ক্রুজ অপারেটর হচ্ছে— হল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল, ক্যানাল, ব্লু বোট, রেডারিজ প্লাজ অ্যান্ড লাভার্স ইত্যাদি। আপনি কিছুদূর নৌভ্রমণ করে বিরতি দিয়ে বাসে যাত্রা করতে চাইলে ক্যানাল বাস সেবার মাধ্যমে ‘এনসি এবি এসডি আইডি’ সেবা দেওয়া হবে। একই সঙ্গে নৌভ্রমণ ও বাস ভ্রমণ উভয়দিক থেকে আনন্দ উপভোগ করা যায়।
খালের মধ্যে আধুনিক বসতবাড়ি
খাল কেবল চলাচলের জলজ রাস্তা এমনটা নয়, আমস্টারডামের খালের মধ্যেই গড়ে উঠেছে আধুনিক যুগের সব বৈশিষ্ট্য নিয়ে ভাসমান বাড়ি। মূলত নেদারল্যান্ডসের অর্ধেকেরও বেশি লোক বাস করে সমুদ্রসীমার নিচে। সমুদ্রসীমা যতই বাড়ছে দেশটিতে বসবাসের পরিবেশও তত জটিল হয়ে আসছে। এ অবস্থায় তারা জলাশয়গুলো মাটি দিয়ে বুজিয়ে ভাসমান বাড়ির কনটেস্ট গ্রহণ করেছে। আমস্টারডামের জিবুর্গে ৯৭টি ভাসমান বাড়ি নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি মহল্লা। এই ভাসমান বাড়ির স্থপতি কোয়েন ওলথিয়াস অ্যাসোসিয়েটেড। এখানে পানির নিচে শক্ত কংক্রিটের গাঁথুনি তৈরি করে, তার ওপর স্টেরিওফোম দিয়ে একটি কাঠামো তৈরি করে, যা দৃশ্যত ডুবে না। মূলত ভাসমান বাড়ির এক তলার অর্ধেক অংশ পানির নিচে ডুবে থাকে যার সঙ্গে কংক্রিটের সংযুক্তি রয়েছে। এর ওপর হালকা ওজনের স্টিলের অবকাঠামোর ওপরে নির্মিত, যা আবার কাঠের প্যানেলের সঙ্গে সংযুক্ত। শোবার ঘর এবং গোসলখানা নিচের তলায় থাকবে যা খানিকটা ডুবন্ত। পানি থেকে ওপরে রান্নাঘর ও খাবার ঘর। উন্মুক্ত বারান্দার ওপর, যেখানে ক্যান্টিলিভারযুক্ত মূল তলা রয়েছে। উপরতলা, ভাসমান বারান্দা, বেলকনি, সবই একটি কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত। ইজমির হ্রদে মাথা উঁচু করে দাঁড় করা বিভিন্ন বাড়ি দেখলে মনে হবে কয়েকটি কৃত্রিম দ্বীপ। এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্পটি এখনো বাস্তবায়নাধীন, তবু বিশ হাজারেরও বেশি লোক ইতিমধ্যে সেখানে বাস করা শুরু করেছে। প্রকল্পটি শেষ হলে এখানে থাকবে স্কুল, বিপণিবিতান, বিনোদন কেন্দ্র এবং সৈকত। বাড়িগুলো ৬৫ কিলোমিটার উত্তরের শিপইয়ার্ডে তৈরি করা হয় এবং প্রতিটি বাড়ি গড়ে প্রায় ২৭৫ বর্গমিটার এবং বসবাসের জন্য মোট আয়তন ১০৬২৫ বর্গমিটার। পরে সেগুলো খালের সরু স্থান দিয়ে টেনে আনা হয়, অর্থাৎ এই বাড়িগুলো ৬.৫ মিটারের বেশি প্রস্থের পথ অতিক্রম করতে পারে না। নেদারল্যান্ডস বন্যা মোকাবিলা করে বহুদিন তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রামে উত্তীর্ণ; সেই ধারাবাহিকতায় ভাসমান বাসা একটি নতুন সমাধান। বিশেষ করে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং মেট্রোপলিটন এলাকায় ঘনবসতির কারণে আবাসন সংকটের প্রেক্ষাপটে ভাসমান বাড়ি একটি যথাযথ বিকল্প সমাধান। তবে এই বাড়ির খরচও কম নয়, প্রতিটি ভাসমান বাড়ির দাম ধরা হচ্ছে ৫ লাখ মার্কিন ডলার।
এই বাড়িতে যারা ইতিমধ্যে বাস করতে শুরু করেছেন, তাদের অনুভূতি বেশ মজার। কেউ কেউ বলছেন, তাদের কাছে মনে হচ্ছে তারা কোনো হলিডে পার্কে বাস করছেন। শহরের প্রাণ কেন্দ্র থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে তাদের এই বাড়ি। তার ওপর জানালা থেকে নয়নাভিরাম দৃশ্য, সামনে পানি; সব মিলিয়ে ভিন্ন রকম স্বাদের কিছু! মূলত নেদারল্যান্ডসের ইতিহাস হচ্ছে পানির সঙ্গে যুদ্ধ করার ইতিহাস। বন্যাকে মোকাবিলা করার জন্যই সেখানে তৈরি করা হয়েছে খাল, বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণের বিশেষ গেট। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দেশটির স্থপতি, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলীরা সম্প্রতি নতুন কিছু করার একটি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন, আর তারই ফসল ভাসমান বাড়ি তৈরির ধারণা। ২০১১ সালে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে হারিকেন আঘাত হানে, তখন নিউইয়র্কের মেয়র মিখাইল ব্লুমবার্গ ডাচেদর কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন। এক কথায় ডাচ্রা পানির সঙ্গে দুহিতা করে টেকসই প্রযুক্তি আবিষ্কারে শীর্ষে আছে।