শিরোনাম
শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
বই বিলানোই যার কাজ

বইয়ের ফেরিওয়ালা

তাহমিদ আহমেদ শুভ্র

বইয়ের ফেরিওয়ালা

বইয়ের ফেরিওয়ালা ইউনুছ খান

বই বিলানো তার নেশা। চান জ্ঞানের আলোয় আলোকিত একটি জগৎ। স্বপ্ন আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর পাঠাগার করার। শুরুতে মানুষের দ্বারে দ্বারে একা বই বিলালেও এখন তার অসংখ্য সঙ্গী-সাথী মিলেছে। সমাজের মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়াই এই ফেরিওয়ালার উদ্দেশ্য

 

অজোপাড়া গাঁয়ে বসে প্রতিদিন নিত্যনতুন বইয়ের গন্ধ পাওয়া সত্যিই অবাক করার মতো। কেমন হয়? যদি সকালের নাস্তা সেরে নেওয়ার পরপরই পছন্দের বই নিয়ে কেউ আপনার বাড়ির সামনে হাজির হয়! তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ থেকে শুরু করে কালজয়ী বহু লেখকের বই হাজির আপনার সামনে। আর সেখান থেকে আপনার বেছে নেওয়ার পালা, কোন বইটি পড়বেন আপনি। আর সেটিই পেয়ে যাবেন বিনা পয়সায়, তবে শর্ত একটাই! কী শর্ত? গত সপ্তাহের বইটি ফেরত দিতে হবে।

ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলায় অবস্থিত মাটিয়াগোধা গ্রামে বাস্তবেই খুঁজে পেয়েছি এমন একজন বইয়ের ফেরিওয়ালাকে; যিনি জীবনের ২৯ বছরের মধ্যে ১৬ বছরই ব্যয় করেছেন এই কাজ করে। নাম ইউনুছ খান। ২০০১ সাল থেকেই বই বিলিয়ে দিচ্ছেন সবার মাঝে। সব বয়সের সব পাঠকের হাতেই তিনি তুলে দিতে চান তার পছন্দের বইটি। না, অন্য কোনো আশা কিংবা ইচ্ছা থেকে নয়, ইউনুছ এই কাজ করেন গ্রামের মানুষকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রেখে বই পড়ার আনন্দ বিলিয়ে দেওয়ার জন্য। শুরু করেছিলেন তার নিজের গ্রাম থেকে। এখন ইউনুছ খানের পাঠক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আশপাশের ১০টি গ্রামে।

কিশোর, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ এমনকি কৃষকরা পর্যন্ত তার পাঠক। পিছিয়ে নেই অন্যরাও। বর্তমানে তার পাঠক সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিনের মতো তার কাজ করে যাচ্ছিলেন ইউনুছ খান। কাঁধে চিরাচরিত ব্যাগ আর হাতে বেশ কটি বই। হেঁটে যাওয়ার সময়ই কথা হয় তার সঙ্গে। জানতে চাইলাম তার শুরুর গল্পটা। বই আর পত্র-পত্রিকার সঙ্গে তার সখ্য ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু শখ থাকলেও সাধ্য হতো না। তার গ্রাম তো দূরের কথা আশপাশের ১০-১২টি গ্রামেও ছিল না কোনো পাঠাগার। শখ মেটাতে যেতে হতো উপজেলা শহরে। তখন থেকেই নিজ এলাকায় একটি পাঠাগার করা ও বইকে সবার মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন জাগে। তার এসএসসি পরীক্ষার পর বন্ধু ও বড়ভাইদের মাঝে এই পরিকল্পনার কথা জানান। কেউ কেউ হেসে উড়িয়ে দিলেও জাহাঙ্গীর কবির, শেখ জুটন, রেজাউল করিম, আবদুল্লাহ ইবনে মনির, দেলোয়ার হোসেনসহ অনেকেই হাত মেলান তার সঙ্গে। তখন থেকে শুরু হয়ে গেল পাঠাগার আন্দোলন। ২০০১ সালের মাঝের দিকে মাত্র ৩০০ বই ও ১৯ জন পাঠক নিয়ে গড়ে তোলেন ‘মহামায়া গণ  পাঠাগার’। কিন্তু অনেকেরই পাঠাগারে আসার সুযোগ হয় না, তাদের জন্য তিনি বের করেছেন ঘরে বসে বই পাওয়ার অভিনব পদ্ধতি। তবে বর্তমানে তিনি একা নন, তার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন মোহাম্মদ উল্লাহ, জামাল উদ্দীন, শাওন, রাশেদ, আবুল কালামসহ আরও বহু তরুণ-তরুণী। তাদের হাত ধরে ৪৬ বছর বয়সী আবদুর রউফ হয়ে উঠেছেন বইপোকা। তিনি অবসর পেলেই পাঠাগারে ঢুকে হাতে নেন পত্র-পত্রিকা কিংবা গল্প ও উপন্যাসের বই। যতক্ষণ অবসর পান ততক্ষণ বই পড়েই সময় কাটান তিনি। এখন তিনি শুধু নিজেই বই পড়েন না, বই পড়তে উৎসাহ দেন অন্যদেরও। আবদুর রউফ বলেন, ‘প্রতিদিনই পাঠাগারে আসা হয়, নিজের ইচ্ছামতো বই ও পত্র-পত্রিকা পড়ি। আর কোনো কারণে না আসতে পারলে বই সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়ে বাসায় পড়ি।’ কথায় কথায় জানা গেল, ইউনুছ খান বই পড়ার আন্দোলনটাকে শুধু একটা ঘরের মধ্যে (পাঠাগার) বন্দী না রেখে সব জায়গাতেই ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। পাঠাগার থেকে নেওয়া ও তার বিলানো বই নিতে পারেন যে কেউ, এর জন্য কোনো চাঁদা বা জামানতের প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়া প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার বিকালে পাঠাগারে চলে সাহিত্য আড্ডা।

সাহিত্য আড্ডা ছাড়াও পাঠাগারে শিক্ষার্থীদের নিয়ে কুইজ প্রতিযোগিতা, রচনা প্রতিযোগিতা, গল্প/কবিতা লেখা প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। পুরস্কার হিসেবে তাদের হাতেও তুলে দেওয়া হয় অসংখ্য নতুন নতুন বই। রাজ্যভার হতাশা মুখ নিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেকে বই নিয়ে ফেরত দেন না বা হারিয়ে ফেলেন। এতে করে কমছে পাঠাগারের বই সংখ্যা। নতুন বই কেনার মতো আর্থিক অসচ্ছলতা তো আছেই! পাঠাগার চালাচ্ছি কোনোমতে।’ এমনিতে পাঠাগার পরিচালনা ব্যয় মেটানোই ভার। সহায়তা পেলে এখনো পাঠাগারটি আধুনিক ও তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর করার স্বপ্ন দেখেন ইউনুছ খান।

বর্তমানে তাদের নিবন্ধিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ও পাঠক সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার।

এর বাইরেও অনেক পাঠক আছেন যারা শুধু পাঠাগারে এসে বই পড়ে যান, কিন্তু নিবন্ধিত হননি। এখন দৈনিক গড়ে ১০০ থেকে ১২০ জন পাঠক পাঠাগারে এসে বই পড়েন। বইয়ের পাশাপাশি দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্র-পত্রিকা পাঠদানের কার্যক্রমও বেশ দৃষ্টিনন্দন। শুধু বই পড়া আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ নন ইউনুছ খান ও তার পাঠাগার। পাঠাগারের জন্মলগ্ন থেকেই বৃত্তি পরীক্ষা, কুইজ প্রতিযোগিতা, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, চিকিৎসা ক্যাম্প, গরিব ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বই বিতরণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতাসহ আরও বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার রাতে সাহিত্য আসর বসে এখানে। তাছাড়া জাতীয় দিবসগুলো বেশ ঘটা করে পালন করে পাঠাগার কর্তৃপক্ষ। আর তাই তো সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকেও মিলেছে স্বীকৃতি। সারা জীবন এভাবেই বই পড়া আন্দোলন চালিয়ে যেতে চান ইউনুছ। গ্রামের মানুষকে দিতে চান আনন্দময় এক জগতের খোঁজ। যে জগতের খোঁজ তিনি পেয়েছিলেন বইয়ের ছাপানো অক্ষরে। সেই আনন্দের ভাগ মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতেই তিনি হাঁটেন মাইলের পর মাইল। জয়তু বইয়ের ফেরিওয়ালা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর