গ্রামবাংলার ঐতিহ্য মাটির বাড়ি। গ্রামের মানুষের কাছে মাটির বাড়ি মানে গরিবের এসি হিসেবে খ্যাত। মাটির বাড়ি শীত ও গরমের সময় বেশ আরামদায়ক। এক সময় গ্রামের বিত্তশালীরা অনেক টাকা ব্যয় করে মাটির দোতলা বাড়ি তৈরি করতেন। তবে ইট, বালি ও সিমেন্টের এ আধুনিকতায় মাটির বাড়ি এখন প্রায় বিলীনের পথে। এমন এক গল্প রয়েছে নওগাঁর মহাদেবপুরের আলিপুর গ্রামে। বাড়িটি ১৯৮৬ সালে মাটি দিয়ে তৈরি ১০৮ ঘরে। বাড়িটি ৩ বিঘা জমির ওপর নির্মিত। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০০ ফিট, প্রস্থ ১০০ ফিট। বাড়িটিতে ছাউনির জন্য টিন লেগেছে ২০০ বান্ডেল। মাটির এই বাড়িটি দেখতে অনেকটা রাজপ্রাসাদের মতো। বিশাল এই বাড়িটি নির্মাণ করেছেন দুই সহোদর সমশের আলী মণ্ডল ও তাহের আলী মণ্ডল। ৩২ বছর আগে মাটির এই দোতলা বাড়িটি নির্মিত হয়েছে।
![](/assets/archive/images/Print-Edition/Saturday%20Morning/2018/December%20-%202018/22-12-2018/Bd-Pratidin-22-12-18-SF-06.jpg)
আলিপুর গ্রামের ৬০ বছরের বৃদ্ধ আসমত আলী বলেন, মাটি, খড় ও পানি দিয়ে ভিজিয়ে কাদায় পরিণত করে ২০-৩০ ইঞ্চি চওড়া করে দেয়াল তৈরি করা হয়। এ দেয়াল তৈরি করতে বেশ সময় লাগে। কারণ একসঙ্গে বেশি উঁচু করে মাটির দেয়াল তৈরি করা যায় না। প্রতিবার এক থেকে দেড় ফুট উঁচু করে দেয়াল তৈরি করা হয়। কয়েক দিন পর শুকিয়ে গেলে আবার তার ওপর একই উচ্চতার দেয়াল তৈরি করা হয়। এভাবে দোতলা বাড়িটির ২০-২২ ফুট উঁচু দেয়াল নির্মিত হয়েছে। ওই গ্রামের আরেক বৃদ্ধ লয়খত আলী বলেন, বাড়িটির সৌন্দর্য বাড়াতে চুন ও আলকাতরার প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে মাটির দোতলা বাড়ি নির্মাণ করতে ৯ মাস সময় লাগে। তবে এই বাড়িটি সম্পূর্ণ করতে সময় লেগেছিল প্রায় এক বছর। বাড়িসহ আশপাশে মোট ২১ বিঘা জমি রয়েছে। আর ওই বাড়িটি তৈরি করতে একটি বিশাল পুকুর খনন করতে হয়েছে। সে সময় একই দোকান থেকে ২০০ বান্ডেল টিন কিনে বাড়িতে ব্যবহার করেন বাড়িওয়ালারা। আর এ জন্য দোকানদার তাদের একটি চায়না ফনিক্স বাইসাইকেল উপহার দেন। আর টিন সংগ্রহ করতে দোকানি সময় নিয়েছিল সাত দিন।
সমশের আলী মণ্ডলের স্ত্রী ফাতেমা বেওয়া বলেন, পায়ে হেঁটে একবার বাড়ির চার ধার চক্কর দিতে সময় লাগে ৬-৮ মিনিট। ১০৮ ঘরের এই বিশাল বাড়িতে প্রবেশের জন্য রয়েছে ৭টি দরজা। তবে প্রতিটি ঘরে রয়েছে একাধিক দরজা। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি রয়েছে ১৮টি। তবে যে কোনো ১টি দরজা দিয়ে যাওয়া যাবে ১০৮ কক্ষে। ৯৬টি বড় ১২টি ছোট কক্ষ। বিশাল আকারের বাড়িটিতে ছোট বড় সবাই মিলে ৩৬ জন লোক বসবাস করে। বাড়িটি তৈরি করতে সে সময় বিভিন্ন গ্রামের শতাধিক কারিগর লেগেছিল।
আর বাড়িটি তৈরি করতে যে পরিমাণ মাটি লেগেছিল তা বাড়ির পেছন থেকে নেওয়া হয়। বর্তমানে সেখানে একটি বিশাল আকারের পুকুর তৈরি হয়েছে। তাহের আলী মণ্ডলের ছেলে মাসুদ রানা বলেন, এটি গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বহন করে আছে। ১০ বছর আগে বড় চাচা সমশের আলী ও তার বাবা তাহের আলী ৪ বছর আগে মারা গেছেন। তার জানা মতে, সমগ্র বাংলাদেশে আর কোথাও ১০৮ কক্ষের মাটির বাড়ি নেই। তার বাবা ও চাচা শখের বসে এ বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে এ বাড়িটি দেখার জন্য লোকজনের সমাগম ঘটে।