শনিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

রুলিবালার গ্রাম রনসিঙ্গার

নওগাঁ প্রতিনিধি

রুলিবালার গ্রাম রনসিঙ্গার

গ্রামটির প্রতিটি ঘরেই রয়েছে রুলিবালা তৈরির কারিগর। এমদাদ ও রুমা দম্পতি হলেন তাদের অনুপ্রেরণার প্রতীক। এই সফল দম্পতির নেতৃত্বেই গ্রামটির প্রায় ২৫০ জন দক্ষ কর্মী তৈরি হয়েছে...

 

গ্রামে প্রবেশ করতেই গৃহবধূর হাতুড়ি ও ছোট ছোট সেনির শব্দ। পুরো গ্রামটিই দিনের আলোয় যেন একটি কারখানা। প্রতিটি ঘরে ঘরেই তৈরি হচ্ছে রুলিবালার অলঙ্কার। বাংলার সেই গ্রামটির নাম রনসিঙ্গার। অনেকেই গ্রামটিকে রুলিবালার গ্রাম বলে থাকেন। নওগাঁর রাণীনগর উপজেলায় অবস্থিত গ্রামটি। এই গ্রামের সাবেক সেনাসদস্য এমদাদুল হক ও তার স্ত্রী রুমি গড়ে তুলেছেন রুলিবালা তৈরির কারখানা এবং এর নাম দিয়েছেন ‘এমদাদ বালাঘর’। ইতিমধ্যে সফলতা ছুঁয়ে নাম কুড়িয়েছেন এই দম্পতি। শুধু তাই নয়, গ্রামের শতাধিক গৃহবধূ ও শিক্ষার্থীদেরও কপাল খুলেছে। স্বাবলম্বীও হয়েছে সবাই। পিতলের পাত দিয়ে তৈরি করা হয় রুলিবালা। পিতলের রং ও সোনার রং প্রায় কাছাকাছি। এর ওপর এক ধরনের কেমিক্যাল দিলে হুবহু সোনার রংই ধারণ করে। আসল-নকল চেনার উপায় থাকে না। বর্তমানে স্বর্ণের প্রচুর দাম হওয়ায় সবার পক্ষে স্বর্ণ কেনার সামর্থ্য নেই। এমন সামর্থ্যহীন মানুষের সাজে পূর্ণতা দিতে এমদাদ ও রুমা দম্পতি রুলিবালার কারখানা তৈরি করেন।

গ্রামটির গৃহবধূ সুলতানা জানান, ‘আগে তারা সংসারের কাজ শেষ করে অলস সময় পার করতেন। এখন অবসর সময়টুকু কাজে লাগিয়ে মাসে ৫/৭ হাজার টাকা আয় করছেন। ফলে আমাদের সংসারে এসেছে আর্থিক সচ্ছলতা।’ আরেক গৃহবধূ সালমা বেগম জানান, ‘পিতলের পাতের রোল কিনে পরিমাণ অনুযায়ী কেটে নিয়ে ঘুঁটোর আগুনে পুড়িয়ে টেম্পার লেস করা হয়। এরপর বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এ হাত ও হাত ঘুরে রুলিবালার আকৃতি পায় পিতলের পাতে। শেষে সালফিউরিক অ্যাসিডে ডুবিয়ে পরিষ্কার করে সোনার রং দেওয়া হয়।’

সাধারণত ‘র’-ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি করা হয় এসব অলঙ্কার। বিভিন্ন ধরনের চেইন, নাকফুল, ব্রেসলেট, লকেটে রঙিন কৃত্রিম পাথর বসিয়ে সোনার রং দেওয়া হয়। মেশিন দিয়ে অলঙ্কারের অগোছালো স্থানগুলো নিখুঁতভাবে মসৃণ করা হয়; যা খুবই কঠিন কাজ। গ্রামটিতে ঘুরে সবার মুখে শোনা যায় রুলিবালা তৈরি এবং সংসারের সফলতা আনার গল্প।

শুধু নারীরাই নন, অনেক পুরুষও লাভজনক এই কাজে যুক্ত হয়েছেন। পাশাপাশি কিছু শিক্ষার্থীকেও দেখা যায় অবসর সময়ে রুলিবালা তৈরির কাজে। তাদের মধ্যে অন্যতম পলি ও রেশমি। তারা দুই বোন। দুজনই নবম শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে এ কাজ করে। প্রতিদিন ২/৩ জোড়া রুলিবালাতে নকশা দিয়ে থাকে। এতে প্রতিদিন আয় হয় ৫০০ টাকা। আর তারা পরিবারের ওপর নির্ভর না করে নিজেরাই নিজেদের পড়াশোনার খরচ মেটাতে পারছেন।

এমদাদুল হক বলেন, ‘২৪ বছর সেনাবাহিনীতে চাকরি করি। ২০১৩ সালে অবসর নিয়েছি। অবসর জীবনে কিছু একটা করার ইচ্ছা থেকেই এই উদ্যোগ। কাছের এক আত্মীয়ের পরামর্শে নাটোর, সৈয়দপুর, পার্বতীপুর এবং বিরামপুর থেকে রুলিবালা তৈরির প্রশিক্ষণ নেই। এরপর ২০১৪ সালে স্ত্রী রুমাকে রুলিবালার কাজ শেখাই। একই বছর ৭ জন নারী শ্রমিক নিয়ে কারখানা শুরু করি।’ স্ত্রীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রসঙ্গে এমদাদ বলেন, ‘গ্রামের মেয়েরা সাধারণত পুরুষের কাছে কাজ শিখতে সংকোচ বোধ করে। তাই স্ত্রীকে রুলিবালা তৈরির কাজ শেখানো। এতে গ্রামের মেয়েরা সহজেই এগিয়ে এসেছে।’ ১৫০ জন নারী এবং ১২ জন পুরুষ কাজ করেন রুলিবালা বাতিঘরে। প্রত্যেকের গড় আয় দিনপ্রতি ২৫০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা। সাধারণত একজোড়া রুলিবালা পাইকারি ২৩০ থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি করা হয়। এসব রুলিবালা ঢাকার তাঁতিবাজার, সিলেট, বগুড়া, নাটোর ও নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়াও কন্ডিশনে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অনেকে নিয়ে থাকেন।

উদ্যোক্তা এমদাদ বলেন, ‘নারী কারিগরদের প্রত্যেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। প্রতি মাসে তারা ব্যাংকের এজেন্টদের কাছ থেকে আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে নিজেদের অর্জিত টাকা তুলে নেন।’

সর্বশেষ খবর