শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

পুরান ঢাকার খাদ্যবিলাস

মাহবুব মমতাজী

পুরান ঢাকার খাদ্যবিলাস

ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির পসরা ছবি : রোহেত রাজীব

ইতিহাস আর ঐতিহ্যের প্রাণকেন্দ্র পুরান ঢাকা। বৈচিত্র্যপূর্ণ এ শহরে একসময় বিস্তৃতি আর জনসংখ্যা ছিল অনেক কম। এখন বদলে গেছে সেই চিত্র। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত দেড় কোটির বেশি মানুষের বসবাস এখানে। পুরান ঢাকাবাসীর খাবার ও তাদের খাদ্যাভ্যাস ঢাকার খাদ্যবিলাসে একটি স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে এর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বহু স্থানে। স্থান পেয়েছে প্রিয় খাবারের তালিকায়। এ এলাকার বাবুর্চিদের অনেক সৃজনশীলতা ছিল। তারা মুঘলদের খাবার রান্নার কৌশল রপ্ত করে নিয়েছে তাদের সহযোগী হিসেবে। তাই দেখা যায়, পুরান ঢাকার শাহি খানাপিনার ধরন আর ঘ্রাণ যে কোনো বাঙালির চিরায়ত খাবারের চেয়ে ভিন্নতা রয়েছে। সেই লোভনীয় আর মুখরোচক ঢাকাই খাবারের ধারার একমাত্র ধারক ও বাহক পুরান ঢাকাবাসী। এরা স্বভাবগতই খেতে আর খাওয়াতে ভালোবাসে। খাবারের মান, স্বাদ, ঘ্রাণ আর রন্ধন প্রণালি খেয়াল রাখে যে প্রক্রিয়া সেটিকেই বেছে নেয়। ঐতিহ্যের কথা এলেই যেসব খাবারের কথা আসে-

ঐতিহ্যের বাকরখানি 

জমিদার আগা বাকের তথা আগা বাকির খাঁর নামে এ রুটির নামকরণ করা হয়েছে ‘বাকরখানি’। বাকরখানি নামের পেছনেও রয়েছে বাকের-খনি বেগমের প্রেমের ইতিহাস। বাকরখানির সৃষ্টি আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে। বাকরখানি মূলত দুই ধরনের রুটি ছিল। একটা ছিল খাস্তা (নরম) আর আরেকটি ছিল নিমসুকা। পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দারা তাদের দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় বাকরখানি রাখে। আর এ প্রিয় বাকরখানি খাওয়া হয় অনেক পদের সঙ্গে। এর মধ্যে মিষ্টি, ঝাল মাংস, ফিরনি আর সর্বাধিক জনপ্রিয় দুধ চায়ের সঙ্গে।

ঢাকার পোলাও ও বিরানি

একসময় পুরান ঢাকায় অতিথি আপ্যায়নে বা জামাই এলে শাহি মোরগ-পোলাওকে প্রাধান্য দিত বেশি। আর সকালের নাস্তায় থাকত তেহারি। পাশাপাশি থাকত মোসাল্লাম, রেজালা, ঝাল গরুর মাংস, জালি কাবাব, নিম কালিয়া, শাহি টুকরা, পেস্তাবাদামের শরবত ইত্যাদি। পোলাও বিরানির মধ্যে বুন্দিয়া পোলাও, খাসির বিরানি, সাদা পোলাও দিয়ে ঝাল গরুর মাংস, ডিমের কোরমা, গরুর গ্লাসি, রোস্ট ইত্যাদি পছন্দ অনুযায়ী খাবার থাকত বিরানির পাশাপাশি। এখনো বিখ্যাত হাজী বিরানিতে সেই শুরু থেকে এখন পর্যন্ত শুকনা কাঁঠাল পাতার তৈরি ঠোঙায় সকাল-বিকাল তেহারি পরিবেশন করা হয়। এ দৃশ্য সেই হারানো দিনের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা পুরনো খাবারের প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- কাজী আলাউদ্দীন রোডের হাজীর বিরানি, নাসিরুদ্দিন সরদার লেনের মাখন পোলাও, ফরিদাবাদের বুদ্দু বিরানি, নারিন্দার ঝুনু পোলাও, বেচারাম দেউড়ির নান্না বিরানি, চকবাজারের শাহসাহেবের পোলাও ইত্যাদি।

পুরান ঢাকার কাবাব

সুস্বাদু কাবাবের আগমন মুঘলদের হাত ধরেই। কাবাব আগে থেকে সন্ধ্যাকালীন, বিশেষ করে রাতের খাবার হিসেবে পছন্দের। জনপ্রিয় কাবাবের মধ্যে শিক কাবাব, বটি কাবাব, কাঠি কাবাব, সুতি কাবাব, রেশমি কাবাব, মুরগির কাবাব, পেষা মাংসের কাবাব, টুন্ডা কাবাব, টিক্কা কাবাব, টেংরি কাবাব, গরুর ছেঁচা মাংসের কাবাবসহ নানা ধরনের মাছের কাবাব ইত্যাদি।

পুরান ঢাকার ইফতার

ইফতারের কথা এলেই চলে আসে ঐতিহ্যবাহী সব নানা পদের কথা। পুরান ঢাকাজুড়ে রয়েছে সেরা ইফতারের ঠিকানা। এর মধ্যে চকবাজার শাহি মসজিদসংলগ্ন ইফতার বাজার, নর্থ-সাউথ রোডের হোটেল আল রাজ্জাক, সুপার হোটেল, লালবাগের রয়েল হোটেল, আনন্দ কনফেকশনারি, ডিসেন্টসহ অসংখ্য দোকান। 

ঐতিহ্যে ঢাকার মিষ্টি

মুঘল আমলে এখানে আসা বিভিন্ন আমির আর শৌখিনদের অনেক মিষ্টি স্থানীয়দের মাঝেও খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। যেগুলো আরব-পারস্য ঘরানার। এর মধ্যে বরফি, শাহি টুকরা, জিলাপি, মোতানজান, ক্ষীর, দরবেশ ইত্যাদি ছাড়াও হালুয়া ছিল জনপ্রিয়। এখানে আগে থেকেই রয়েছে নানা জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির ঠিকানা। এর মধ্যে আলাউদ্দীন সুইটমিট অন্যতম। চকবাজারের শাহি মসজিদের পাশে চোখে পড়বে আলাউদ্দীন সুইটমিটের দোকানটি। একে মিষ্টির জগতে পথিকৃৎ বলা হয়। এখানে রসগোল্লা, গোলাপ বরফি, পান বরফি, কাজু বরফি, গুলাব জাবন, লালমোহন, মতিচুর লাড্ডু, রসকদম, বড় চমচম, হাফসি হালুয়া, দই, কালোজাম, মালাইকারি, দুদিয়া সন্দেশ, কাঁচা সন্দেশ, রসমালাই, জিলাপিসহ অনেক ধরনের মিষ্টি তৈরি হয়। আর মতিচুর লাড্ডু শুধু পুরান ঢাকায়ই নয়, পুরো ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচীন মিষ্টি। যা দুই হাজার বছরের পুরনো। এছাড়া জনপ্রিয় মিষ্টির দোকানগুলো হলো- পাটুয়াটুলীর শাহি দিল্লি, নারিন্দার তানয়ীমস সুইটমিট, আবুল হাসনাত রোডের দয়াল ভাণ্ডার, নবাবপুরের গ্রিন সুইটমিট, গেন্ডারিয়ার সোনামিয়ার মিষ্টি-দই ইত্যাদি। অন্যদিকে পুরান ঢাকার বেকারি আইটেমগুলোও একটি স্বতন্ত্র অবস্থান করে নিয়েছে খাদ্য তালিকায়। হোক সেটা পাউরুটি কিংবা বিস্কুট। কয়েকযুগ ধরে বেশ সুনামের সঙ্গে ভোজনরসিকদের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে এসব বেকারি। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ইউসুফ বেকারি, আনন্দ বেকারি, অলিম্পিয়া, ক্যাপিটাল ইত্যাদি।

ভোরের ছানা-মাঠা

ভোরে ছানা-মাঠা খাবারের অভ্যাস দেখা যায় শুধু পুরান ঢাকায়ই। আর মাঠা বিক্রির সঙ্গে পুরান ঢাকার ইতিহাস জড়িয়ে আছে। আদি থেকে পুরান ঢাকায় গোয়ালরা দুধ বিক্রি করে আসছে। পাশাপাশি এ দুধের ব্যবসার সঙ্গে আরও কিছু পেশা যুক্ত হয়েছে শত শত বছর ধরে। এ গোয়ালের দুধ থেকেই ঢাকাই পনির, যাবতীয় দই-মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার এবং ঘি প্রস্তুত করা হয়। পাটুয়াটুলীতে ঘি পট্টি নামে পাইকারি ঘি বিক্রির স্থান রয়েছে। কাজেই মাঠা ও ছানা তৈরির মূল উপাদান হচ্ছে দুধ আর তার উৎস পুরান ঢাকার দুধের আড়ত। সকাল হলেই নগরীর ব্যস্ততা শুরুর আগেই পুরান ঢাকার নাজিরাবাজার চৌরাস্তায় শ্যামলের মাঠা, গেন্ডারিয়া ধূপখোলা বাজারের পাশে মাঠের গেট, নারিন্দা পুলিশ ফাঁড়ির বিপরীতে সৌরভের মাঠা, লালবাগের চৌরাস্তা, নবাবপুর মোড়, বংশাল, ইসলামপুর, বাংলাবাজার, কসাইটুলী, সূত্রাপুর-লোহারপুল, দয়াগঞ্জ মোড়, নাজিমুদ্দিন রোড, কলতাবাজার, রায়সাহেব বাজার, টিকাটুলী, ফরাশগঞ্জ, উর্দু রোড, শাঁখারী বাজারসহ অসংখ্য স্থানে ভোর থেকে বিক্রেতারা সুস্বাদু মাঠার দোকান নিয়ে বসেন। 

ঢাকার পিঠা

পুরান ঢাকার অলিগলিতে পিঠাওয়ালীদের তৈরি পিঠা আদি ঢাকার মানুষের সকালের নাস্তার অংশ। ক্ষিরসা, দুধপুলি, ডিমপোয়া, খেজুর পিঠা, চুই পিঠা, পুলি, ছিটা পিঠা, পাটিসাপটা, তালের পিঠাসহ আরও অনেক ধরনের পিঠা এখনো প্রচলিত আছে। বর্তমানে সর্বাধিক জনপ্রিয় ভাপা পিঠা মুঘল আমলে তৈরি হতো আরও ভিন্নতরভাবে, যাতে সুগন্ধি গুঁড়া, মালাই, জাফরান, পেস্তা-কিশমিশসহ নানা উপকরণসহযোগে।  ঐতিহ্যের পুরান ঢাকার বিখ্যাত আর জনপ্রিয় খাবারের তালিকা বেশ দীর্ঘ। আদি ঢাকার মানুষের নানা উৎসবে আর সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে আয়োজন করা হয় বাহারি আর শাহি খানার, যাতে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়া অতীতের সঙ্গে মিল না থাকলেও তাতে স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়। 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর