শনিবার, ১১ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা
সমাজসেবায় পেলেন একুশে পদক

দৃষ্টিহীনদের জন্য সাইদুলের লড়াই

জামশেদ আলম রনি

 দৃষ্টিহীনদের জন্য সাইদুলের লড়াই

অন্য সবার মতোই স্বাভাবিক ছিল তার জীবন। ছোটবেলায় টাইফয়েড জ্বরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। এতেও থেমে যাননি তিনি। মানুষের জন্য ভালোবাসা থেকেই ৩২ বছর ধরে অবিরাম কাজ করছেন মনের আলোয়। বলছি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাইদুল হকের কথা। তিনি নিজে দৃষ্টিহীন হয়েও প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনে আলো ছড়িয়েছেন। যার স্বীকৃতিও দিয়েছে সরকার। চলতি বছর সমাজসেবায় একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন এই কর্মবীর।

সাইদুল হকের হাতে গড়া সংগঠন ব্লাইন্ড এডুকেশন অ্যান্ড রিহেবিলিটেশন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (বার্ডো) দৃষ্টি প্রতিবন্ধীসহ সব ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষের উন্নয়নে কাজ করছে। যার প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক তিনি। ১৯৯১ সালের ১৭ জুলাই এর যাত্রা। বর্তমানে বার্ডোর কার্যক্রম পরিচালিত হয় মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকা থেকে।  সাইদুল হকের জন্ম বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে সম্মানসহ মাস্টার্স ডিগ্রি এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্র থেকে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলেজ ও জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষক ছিলেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিন কার্যালয়ে আসেন সাইদুল হক। একুশে পদক ২০২৩ পাওয়ার অনুভূতি ব্যক্ত করে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সমাজসেবায় কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এই পদক পেয়েছি। এটি প্রতিবন্ধী মানুষের পদক বলেই মনে করি। আমি খুবই আনন্দিত এবং প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। সরকার ৩২ বছর পর হলেও একজন প্রতিবন্ধী মানুষকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। প্রতিবন্ধী সংগঠনকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এটি প্রতিবন্ধী সমাজকে মর্যাদার সঙ্গে বসবাসের স্বীকৃতি বলেই আমি মনে করি। আমার সংগঠনটিকে শুরু করেছিলাম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে।

বার্ডোর কার্যক্রম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষসহ অন্য সব প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য ক্ষুদ্র আকারে কাজ করছি। মূলত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীসহ পিছিয়ে পড়া প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীদের জন্য কাজ করাই আমাদের লক্ষ্য।  আমরা এই সংগঠনের মাধ্যমে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। যেখানে প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে। যেখানে আছে একটি ব্রেইল লাইব্রেরি। রয়েছে একটি ব্রেইল প্রেস। সেখানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষ যাতে চাকরি পেতে পারে সেই লক্ষ্যে একটি লবিং সেন্টার রয়েছে। আমরা সরকারি বিভিন্ন কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত আছি। বার্ডো সারা দেশে আটটি কেন্দ্রের মাধ্যমে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। বার্ডোর মূল লক্ষ্যই হলো প্রতিবন্ধী মানুষকে সমাজের মূল স্রোতধারায় যুক্ত করা।’

আগামী দিনের পরিকল্পনা প্রসঙ্গে সাইদুল হক বলেন, ‘আমরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেয়েদের জন্য একটি হোস্টেল করতে চাই। আমাদের যে স্কুলটি আছে সেখানেই তারা পড়তে পারবে। এ ছাড়া, আমরা একটি প্রকল্প করতে চাই যেখানে আয়বর্ধক কর্মকান্ড পরিচালনা করা যাবে। অন্তত ২০০-৩০০ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীসহ যে কোনো প্রতিবন্ধী মানুষ উৎপাদনশীল কাজের মাধ্যমে আয় তৈরি করতে পারে। যেখানে তারা বিক্রি করবে, তারাই মার্কেটিং করবে এমন একটি প্রকল্প করতে চাই। কারণ আমরা জানি প্রতিবন্ধী মানুষের কর্মসংস্থান অত্যন্ত জটিল। সেই লক্ষ্যেই আমাদের এই পরিকল্পনা। আরেকটি পরিকল্পনা হচ্ছে, সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য পূর্বের কোটা ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করা। কোটা আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে সব কোটা বাতিল হয়ে যায়। আমার এখন চেষ্টা হচ্ছে প্রতিবন্ধী মানুষকে যাতে এই কোটার আওতায় নিয়ে আসা যায়। কারণ, কোটা ব্যতীত প্রতিবন্ধী মানুষকে চাকরি দেওয়া অনেক কঠিন হয়ে যায়। সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার ও সুরক্ষায় বিদ্যমান আইনটি যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়। যেখানে ২১টি অধিকারে কথা বলা হয়েছে। সেই অধিকার যদি আমরা দিতে চাই তাহলে এই আইন সুচারুভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।’ সাইদুল হক আরও বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে এবং প্রতিবন্ধী মানুষকে যাতে সামনে এগিয়ে নেওয়া যায় সেজন্য আলাদা একটি মন্ত্রণালয় করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাই সরকারের প্রতি। পাশাপাশি যোগ্য, দক্ষ, মেধাবী যেসব প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছেন এবং যেসব প্রতিবন্ধী নেতা আছেন তাদের মাধ্যমে এই মন্ত্রণালয় চালানো যায় কি না বিষয়টি বিবেচনা করার অনুরোধ জানাই।  বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধী মানুষের ব্যাপারে অত্যন্ত ইতিবাচক। সরকার প্রতিবন্ধী মানুষকে যে ভাতা দিয়ে থাকে সেটি ৮৫০ টাকার স্থলে যেন ৫ হাজার টাকা প্রদান করা হয়।’

সর্বশেষ খবর