শনিবার, ৬ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা
রিকশা চালিয়ে সংসার চালান

ব্যতিক্রমী এক ইউপি সদস্যের গল্প

শরীয়তপুর প্রতিনিধি

ব্যতিক্রমী এক ইউপি সদস্যের গল্প

আমার স্বামীর শিক্ষা-দীক্ষা ও টাকা নেই। কিন্তু তাঁর মহৎ একটি হৃদয় আছে। আমাদের মতো দরিদ্র মানুষ যারা, তাদের সেবা করার জন্যই ইউপি সদস্য হয়েছেন। সমাজসেবা করতে গিয়ে তাঁকে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। এ সময় কাজ করলে আরও আয় হতো, সংসার  চালাতে সুবিধা হতো...

 

৪৪ বছর বয়সী মাইকেল ঢালী। এলাকায় রিকশাওয়ালা নিউ মাইকেল নামে পরিচিত। তিনি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচিত সদস্য। জীবিকার তাগিদে ১৬ বছর ধরে গ্রামের রাস্তায় রিকশা চালান। মাইকেলের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার পোরাগাছা গ্রামে। তিনি ওই উপজেলার মোক্তারেরচর ইউপির ৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য। গত বছর জানুয়ারিতে ইউপি নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত হন। এরপরও তিনি জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম রিকশা চালানো ছাড়েননি। রিকশা নিয়েই মানুষের বাড়িতে যান। কষ্টের কথা শোনেন। সাধ্যমতো তাদের পাশে দাঁড়ান। দরিদ্র মানুষদের সরকারের নানা প্রকল্পের সুবিধা পেতে সহায়তা করছেন।

গ্রামবাসী জানান, নড়িয়ার মোক্তারেরচর ইউপির পোরাগাছা গ্রামের মৃত আবদুর রব ঢালী ও নীলুফা বেগম দম্পতির ছেলে মাইকেল। আট ভাই-বোনের মধ্যে মেজো মাইকেলের কিশোর বয়সে বাবা-মা মারা যান। জীবিকার তাগিদে ঢাকায় গিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকা চালানোর কাজ শুরু করেন। ১০ বছর নৌকা চালিয়ে ফিরে আসেন গ্রামে। শুরু করেন রিকশা চালানো। রিকশা নিয়ে গ্রামের মানুষকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আনানেওয়া করতে গিয়ে দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে। জড়িয়ে পড়েন তাদের নানা সুখ-দুঃখের সঙ্গে। নির্বাচিত হয়ে ভোটের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখেন না অনেক জনপ্রতিনিধি। সরকারের নানা প্রকল্প থেকে অসহায় মানুষদের বঞ্চিত করা হয়। এমন চিত্র দেখে মনে কষ্ট হয় দরিদ্র রিকশাচালক মাইকেলের। গরিব মানুষের ন্যায্য পাওনা বুঝিয়ে দিতে মনে বাসনা জাগে। ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও কয়েক ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। এতেও থেমে যাননি মাইকেল। গত বছর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে আবার ভোটে দাঁড়ান। এবার ভোটাররা তাঁকে নিরাশ করেননি। নির্বাচিত হয়ে দরিদ্র মানুষের অধিকারের কথা বলতে ইউনিয়ন পরিষদে যান।

দারিদ্র্যতার কারণে লেখাপড়া করতে পারেননি মাইকেল। তাই তো এক মেয়ে ও এক ছেলেকে রিকশা চালানোর আয়ে লেখাপড়া করাচ্ছেন। তাঁর কোনো কৃষিজমি নেই। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া দুই শতাংশ জমিতে একটি বসতঘর রয়েছে। রিকশা চালানোর ৫০০-৬০০ টাকা আয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়। তাই স্ত্রী লিপি বেগম হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালন করে কিছু আয় করেন।

মাইকেলের স্ত্রী লিপি বেগম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমার স্বামীর শিক্ষা-দীক্ষা ও টাকা নেই। কিন্তু তাঁর মহৎ একটি হৃদয় আছে। আমাদের মতো দরিদ্র মানুষ যারা, তাদের সেবা করার জন্যই ইউপি সদস্য হয়েছেন। সমাজসেবা করতে গিয়ে তাঁকে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। ওই সময় কাজ করলে আরও আয় হতো, সংসার চালাতে সুবিধা হতো। তাতে আমাদের কোনো আক্ষেপ নেই। মানুষ ভরসা ও বিশ্বাস করে তাদের মূল্যবান ভোট দিয়েছে। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি আমার স্বামী যেন মানুষের ভোটের মর্যাদা রাখতে পারেন।

পোরাগাছা গ্রামের আলমগীর ঢালী বাকপ্রতিবন্ধী। অভাবের সংসার। কেউ তাকে সহায়তা করছিল না। মাইকেল নির্বাচিত হওয়ার পর আলমগীরের পরিবারকে খাদ্যসহায়তার ভিজিডি কার্ড দিয়েছেন। আলমগীরের স্ত্রী ফুলমালা বলেন, আমরা অনেক গরিব মানুষ। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সহায়তা পাচ্ছিলাম না। মাইকেল ভাই নির্বাচিত হওয়ার পর আমরা প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল পাচ্ছি। তিনি গরিব মানুষের জন্য কাজ করছেন। 

ইউপি সদস্য মাইকেল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি গরিব মানুষ। যাত্রী নিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে যাই। তাদের দঃখের কথা শুনি। গরিবদের সঙ্গে মানুষ কীভাবে প্রতারণা করে, তাদের বঞ্চিত করে তা দেখে বড় হয়েছি। আমার মনে হয়েছে আমি মেম্বার হলে বঞ্চিত মানুষের উপকার হবে। তাই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিই। মানুষও আমাকে বিশ্বাস করেছেন। চেষ্টা করছি সাধ্যমতো তাদের পাশে থাকতে। জনপ্রতিনিধি হয়েছি, মানুষের অধিকার আদায়ে পাশে থাকছি। কিন্তু নিজের পরিবারকেও তো বাঁচাতে হবে। তাই আয় করার জন্য রিকশা চালাই।

মোক্তারেরচর ইউপি চেয়ারম্যান বাদশাহ শেখ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের বরাদ্দ অনুযায়ী ৬ নম্বর ওয়ার্ডে যা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে তা সঠিকভাবে বিতরণ করছেন মাইকেল। মাইকেলের কার্যক্রমে ওই ওয়ার্ডের মানুষ সন্তুষ্ট। সে খুব তৎপর। রিকশা নিয়ে গ্রামে ঘুরে ঘুরে মানুষের খোঁজ নেন। আমরা তাকে নিয়ে গ্রামের মানুষের সমস্যার সমাধান করছি।’

সর্বশেষ খবর