শিরোনাম
শনিবার, ২০ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা
ড. হোসনে আরা বেগম

৪৩ বছরে বদলে দিলেন অর্ধকোটি মানুষের জীবন

দীর্ঘ চার দশকের শ্রমে ড. হোসনে আরা বেগম গড়ে তুলেছেন বেসরকারি মহিলা উন্নয়ন সংগঠন টিএমএসএস। এ সংগঠন দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত মানুষের কল্যাণে কাজ করছে।

আবদুর রহমান টুলু, বগুড়া

৪৩ বছরে বদলে দিলেন অর্ধকোটি মানুষের জীবন

ইচ্ছাশক্তি আর একাগ্রতা মানুষকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। ন্যায়নীতি আর সততাকে সঙ্গী করে আলোর দিকে ধাবিত হচ্ছেন অধ্যাপিকা ড. হোসনে আরা বেগম। ব্যক্তিজীবনে তিনি প্রথমে ছিলেন পুরুষ। পরে নারীতে রূপান্তরিত হওয়া ড. হোসনে আরা বেগম লক্ষাধিক মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছেন। ভিক্ষা আর মুষ্টির চালে ভিক্ষুকদের গড়া সংগঠন টিএমএসএস এখন বিভিন্ন দেশে উন্নয়নের সুনাম ছড়িয়েছে। একসময় বসার মতো চেয়ার ছিল না, রাত কাটানোর মতো ঘর ছিল না, তিনবেলা খাওয়ার নিশ্চয়তা ছিল না। এখন তারাই স্বপ্ন পূরণ করে হাজারো মানুষের খাবার, বাসস্থান আর আধুনিক জীবন গড়তে সহযোগিতা করছে। গত ৪৩ বছরে অর্ধকোটি মানুষকে আয়ের মুখ দেখিয়েছেন টিএমএসএস-এর নির্বাহী পরিচালক ড. হোসনে আরা বেগম। চলতি অর্থবছরে ১৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন করে টিএমএসএস পরিচালনা পরিষদ।

জানা যায়, অধ্যাপিকা ড. হোসনে আরা বেগমের জন্ম ১৯৫৩ সালে বগুড়া সদর উপজেলার ঠেঙ্গামারা গ্রামে। পিতা সোলাইমান আলী পাইকাড়। মাতার নাম জোবাইদা বেগম। জন্মের সময় স্বাভাবিক পুরুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। সে সময় তার নাম ছিল মো. আবদুস সামাদ। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন পুরুষ হয়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় ২৩ বছর বয়সে অলৌকিকভাবে শারীরিক পরিবর্তন ঘটলে তিনি অপারেশনের মাধ্যমে পুরুষ আবদুস সামাদ থেকে নারী হোসনে আরা বেগম হয়ে এক নতুন জীবন শুরু করেন। পুরুষ ছাত্রাবাস থেকে তাকে চলে যেতে হয় ছাত্রীদের আবাসে। সেই সময় তাকে অন্যান্য শিক্ষার্থীরা নানা কথা বলত। সেসব কথা মানিয়ে নিতে তার খুব দুর্বিষহ সময় কেটেছে। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে সে সময় পেরিয়ে ১৯৭৫ সালে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করেন। তিনি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী একই এলাকার বন্ধু আনসার আলী তালুকদারকে বিয়ে করেন। প্রফেসর আলহাজ আনসার আলী তালুকদার ও অধ্যাপিকা ড. হোসনে আরা বেগমের সংসারে একমাত্র পুত্র সন্তান টি এম আলী হায়দার রয়েছেন। টি এম আলী হায়দারও গড়েছেন নিজের সংসার।

শিক্ষাজীবন শেষ করে হোসনে আরা বেগম বগুড়া সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। শিক্ষকতা চালিয়ে যাওয়ার সময় এক দিন তার গ্রামের ফাতেমা বেওয়া (ফুতুবুড়ি) দেখা করেন। দেখা করে ফাতেমা বেওয়া ভিক্ষুকদের নিয়ে গড়া একটি সমিতির কথা জানান। সেই সমিতিতে কিছু মুষ্টির চালও আছে বলে জানান। এই সমিতির দায়িত্ব নিতে ড. হোসনে আরাকে অনুরোধ করেন। ভিক্ষুকদের সেই সংগঠনের কাজ ছিল সারা দিন যা চাল ভিক্ষা পাবে তা থেকে একমুঠ করে চাল জমিয়ে রেখে বিপদে আপদে সহযোগিতা করা। ফাতেমা বেওয়ার নানা অনুরোধের পর ভিক্ষুকদের কথা ভেবে তিনি দায়িত্ব নিতে সম্মত হন। ১৯৮০ সালে ভিক্ষুকদের সংগঠনের দায়িত্ব নেওয়ার সময় জমা ছিল ২০৬ মণ চাল। আর ছিল ১৪ দলে বিভক্ত ১২৬ ভিক্ষুক। দায়িত্ব গ্রহণ করে চার গ্রামের ভিক্ষুকদের নিয়ে একটি সম্মেলন করেন। এই সম্মেলনে এলাকার ভিক্ষুকদের খিচুড়ি খাওয়ান। খিচুড়ি খাওয়ানোর পর তাদের সদস্য সংখ্যা ৩৭৬ জনে দাঁড়ায়। ভিক্ষুকদের চাল জমানো আর তাদের সংগঠনের নেত্রী হওয়া নিয়ে মানুষের বিভিন্ন কথা শুনতে হতো। সেসব কথা উড়িয়ে দিয়ে ভিক্ষুকদের উন্নয়নে কাজ করতে থাকেন। একসময় গিয়ে চাল নেওয়া বন্ধ করে দিয়ে দুই টাকা করে সঞ্চয় সংগ্রহ শুরু করেন। ভিক্ষুকদের এই সঞ্চয় থেকেই এক সময় গড়ে ওঠে ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস)। এই সংগঠনের মাধ্যমে অনেক ভিক্ষুক সদস্যই জীবনে বহু সহযোগিতা পেয়ে সফলতা অর্জন করেন। ধীরে ধীরে এই সংগঠনের সঙ্গে অনেকেই যুক্ত হতে থাকেন। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে বিভিন্নজনের সহযোগিতায় অবহেলিত মানুষের উন্নয়নে কাজ করে যায় টিএমএসএস। বাড়তে থাকে বিস্তৃতি। এরপর সবই রূপকথার মতো। যা এখন চোখে দেখা যায়। গড়েছেন অসংখ্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। মেডিকেল কলেজ, নার্সিং কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, ট্রাভেলস অ্যান্ড টুরিজম, পুণ্ড্র ইউনির্ভাসিটিসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গরিব রোগীদের জন্য চিকিৎসাসেবা হাসপাতাল, সিএনজি স্টেশন, পাঁচতারকা হোটেল মম ইন, রয়েছে নিজস্ব হেকিপ্টারসহ বিভিন্ন সম্পদ। ড. হোসনে আরা বেগম ২০০৭ সালে রোকেয়া পদক পেয়েছেন। তিনি বগুড়াকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে সবই করছেন।

জনগোষ্ঠীর চাহিদার ভিত্তিতে টিএমএসএস বর্তমানে শতাধিক  কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবার পরিকল্পনা, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, মেডিকেল শিক্ষা, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ, ঋণ কর্মসূচি, মানবাধিকার ও জেন্ডার কর্মসূচি, কৃষি ও পরিবেশ উন্নয়নসহ অন্যান্য বিষয়। দেশের প্রতিটি এলাকায় টিএমএসএস-এর শাখা উপশাখা রয়েছে। সেসব শাখার মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক উন্নয়নের প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। টিএমএসএস-এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপিকা ড. হোসনে আরা বেগম সংগ্রামী এক নারী। দেশের সব জেলায় তিনি কোনো না কোনো নারীর উন্নয়নে জড়িয়েছেন। সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে ও পারিবারিক আয় বৃদ্ধি করতে নারীদের দিয়েছেন বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রশিক্ষণ, নিরাপত্তা, সচেতনতা, সামাজিক ব্যাধি থেকে নারীকে সুরক্ষায় প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এসব প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি তিনি কয়েক হাজার নারীকে চাকরিও দিয়েছেন। যাদের কিছুই ছিল না তারা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন স্বাবলম্বী হয়ে জীবনযাপন করছেন।

দীর্ঘ চার দশক ধরে শ্রম দিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন দেশের নামি বেসরকারি মহিলা উন্নয়ন সংগঠন টিএমএসএস। এ সংগঠন দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত জনগণের কল্যাণে কাজ করছে। দেশের দরিদ্র নারীদের উন্নয়নে কাজ করতে গিয়ে দেশে-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছেন অধ্যাপিকা ড. হোসনে আরা বেগম (অশোকা ফেলো অ্যান্ড পিএইচএফ)। ‘পরিবারই হোক নারী উন্নয়নের কেন্দ্রস্থল’ এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি কাজ শুরু করেন। বর্তমানে টিএমএসএসে ৪০ হাজার নারী কর্মরত। আর দেশের ৬৩ জেলায় এই সংগঠনটি ৫০ লাখ মহিলাকে সংগঠিত করে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। দেশে করোনাভাইরাস হানা দিলে অসংখ্য মানুষকে সেবা ও খাবার দিয়ে সহযোগিতা করেছেন।

অধ্যাপিকা ড. হোসনে আরা বেগম জানান, দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার উন্নয়ন করছে। সরকারের পাশাপাশি শেষ সময়ে এসে আরও কিছু উন্নয়নমূলক কাজ করার ইচ্ছা আছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্যান্সার নিরাময় হাসপাতাল, ট্রমা সেন্টার, ইকোনমিক জোন, কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরিকরণ এবং নারীদের জন্য আরও এমন কিছু প্রশিক্ষণ দেওয়ার ইচ্ছা, যেখানে একেকজন নারী এমনভাবে তৈরি হবেন যেন প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাছে এসে চাকরি ও সম্মান দেবে। সবার সহযোগিতা নিয়ে ভিক্ষুকদের সংগঠনের দায়িত্ব নিয়ে আজকে টিএমএসএস বিভিন্ন দেশে সুনাম কুড়িয়েছে। দেশ-বিদেশের অনেকেই আসেন টিএমএসএস পরিদর্শন করতে। সমাজের বঞ্চিত মানুষের জন্য মানসম্মত জীবন গড়ে তুলবেন। দেশ হবে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরমুক্ত।

সর্বশেষ খবর