শনিবার, ১০ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

সোনারগাঁয়ের বাহারি জামদানি

মো. মশিউর রহমান

সোনারগাঁয়ের বাহারি জামদানি

ঐতিহ্যের ধারায় সজ্জিত আমাদের জামদানি। বিশ্ব দরবারে স্বতন্ত্র মহিমায় সমুজ্জ্বল এক অভিজাত তাঁতবস্ত্র এ জামদানি। বাহারি রং, বুনন কৌশল, নকশা ও জ্যামিতিক মোটিফের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাজারে আজ সমাদৃত নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের জামদানি। অপূর্ব নকশা, বাহারি রং আর সূক্ষ্ম বুননে জামদানি শাড়িতে রয়েছে ভিন্নতা। নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে প্রতিটি শাড়িই যেন সেরা। সৌন্দর্যে একটি অন্যটিকে ছাড়িয়ে যায়। আভিজাত্য, ঐতিহ্য ও শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে সোনারগাঁয়ের জামদানির তুলনা আর কিছুর সঙ্গে হয় না বললেই চলে। সোনারগাঁয়ে বাহারি জামদানি শাড়ি আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। বিশ্বখ্যাত অনন্য মসলিন শাড়ির সংস্করণ অধুনা জামদানি শাড়ি। মূলত তা আমাদের শৈল্পিক কর্মকাণ্ডে সঞ্চারিত এক বিরল অনুপম নিদর্শন। তবে বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেশী ভারতসহ আরও দুই-একটি দেশে জামদানির সূচনার প্রয়াস ‘পণ্ডশ্রম ও অপপ্রয়াসই’ রূপলাভ করেছে। এককালের ঢাকাই মসলিন বিলুপ্ত হলে পরবর্তীতে ঢাকা জামদানি হয়ে ওঠে ভরসা। আজ এ সোনারগাঁয়ের জামদানি শাড়ি বাহারি রঙের সংমিশ্রণে দেশি বাজারের পাশাপাশি বিদেশের বাজারেও স্থান করে নিয়েছে। ঢাকাই মসলিনের পরেই ঐতিহ্যবাহী শাড়ি জামদানির গ্রহণযোগ্যতা সর্বজনস্বীকৃত। তাঁতীদের অসামান্য দক্ষতা এবং নিপুণতায় শত শত বছর ধরে তৈরি কারুকার্যময় সোনারগাঁয়ের জামদানির খ্যাতি বিশ্বজোড়া।

প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার মসলিন এবং জামদানি সৌন্দর্য ও শিল্প-নৈপুণ্যে অনবদ্য। ৩০০ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন ভারতীয় মনীষী কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্র বইতে উল্লেখ করেন, বঙ্গ ও পুণ্ড্রবর্ধন মানে উত্তরবঙ্গে এক ধরনের সূক্ষ্মবস্ত্র বয়ন করা হয়। গ্রিক ইতিহাসবিদ পেরিপ্লাসের বইতে আছে- বঙ্গ থেকে আরব, চীনা ও ইতালীয় বণিকরা চার ধরনের সূক্ষ্ম বস্ত্র ইউরোপে নিয়ে আসেন। এই সূক্ষ্ম-বস্ত্রগুলোর নাম ছিল ক্ষৌম, দুকুল, পত্ররনা এবং কার্পাস। এর মধ্যে দুকুলকে ইতিহাসবিদরা মসলিন ও জামদানির আদি রূপ বলে চিহ্নিত করেছেন। প্রাচীন গ্রিস ও রোমে এই কাপড়ের জনপ্রিয়তা ছিল মূলত অভিজাতদের মধ্যে।

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকেও বঙ্গ থেকে সোনারগাঁ বন্দরের মাধ্যমে মসলিনের মতো সূক্ষ্ম-বস্ত্র ইউরোপে রপ্তানি হতো। তবে মসলিন শব্দটির উৎপত্তি সম্ভবত ইরাকের মৌসুল শহর থেকে। আর জামদানি শব্দটি এসেছে পারস্য থেকে। বুটিদার জামা থেকে জামদানি শব্দটি পাঠান সুলতানদের আমলে বাংলায় সুপ্রচলিত হয়। নবম শতকে আরব ভূগোলবিদ সুলাইমান বাংলাদেশের মসলিন ও জামদানির উল্লেখ করেছেন তাঁর গ্রন্থে। প্রখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ১৪০০ শতকে লেখা তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে সোনারগাঁয়ের বস্ত্রশিল্পের প্রশংসা করতে গিয়ে মসলিন ও জামদানির কথা বলেছেন।

মোগল আমলে মসলিন ও জামদানি শিল্পের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। তখন নানা রকম নকশা করা মসলিন ও জামদানি দিল্লি, লখনৌ ও মুর্শিদাবাদে চড়া দামে বিক্রি হতো। সম্রাট আকবরের নবরত্নের অন্যতম সদস্য ইতিহাসবিদ আবুল ফজল মসলিন ও জামদানির গুণকীর্তন করেছেন তাঁর বইতে। ষোড়শ শতকে ইংরেজ পর্যটক রালফ ফিচ বঙ্গ থেকে দিল্লিতে লাখ লাখ টাকার মসলিন রপ্তানির কথা বলেছেন। রাজধানী ঢাকার অনতিদূরে সোনারগাঁয়ে গড়ে ওঠে জামদানি শিল্পীদের পল্লী। তাদের হাতে তৈরি প্রায় স্পর্শাতীত অদৃশ্য অবিশ্বাস্য সুন্দর মিহি সুতার শাড়ি যা আজ সারা দুনিয়ার বিস্ময় ও মর্যাদার বস্তু। সোনারগাঁয়ে ঐতিহ্যবাহী জামদানি শাড়ি এখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন মার্কেট ও পাশর্^বর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ছাড়াও ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যেও বিভিন্ন দেশে বিক্রি হয়। জানা গেছে, সোনারগাঁয়ের বারদী, আমগাঁও, গণকবাড়ি, বাইশচেঙ্গী, মুছারচর, বরাবো, চেঙ্গাইন, শেকেরহাট, বাসাবো, তিলাব, বস্তল, কলতাপাড়া, কাহেনা, মালিপাড়া, সাদিপুর, বাহ্মণবাওগাঁ, খেজুরতলা, আদমপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে জামদানি শাড়ি তৈরি করেন জামদানি শিল্পী ও কারিগররা।

সর্বশেষ খবর