শনিবার, ৮ জুলাই, ২০২৩ ০০:০০ টা
বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা

মানবতার ডাক্তার অধ্যাপক আতিক

♦ পিতার নামে গড়েন শরীফ আতিয়ার রহমান স্মৃতি সংসদ ♦ পরিবারের ছয়জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সহায়তায় মেডিকেল ক্যাম্প আয়োজন ও তত্ত্বাবধান ♦ হাজারো মানুষকে সেবা দিয়ে পেয়েছেন ‘গরিবের বাতিঘর’ খ্যাতি

সাজ্জাদ হোসেন, নড়াইল

মানবতার ডাক্তার অধ্যাপক আতিক

মানবতার এক অনন্য চিকিৎসক অধ্যাপক শরীফ জাহাঙ্গীর আতিক সংক্ষেপে এস. জেড. আতিক। তার জন্ম নড়াইলে হলেও কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে সাতক্ষীরায়। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ শল্য চিকিৎসাবিদ ডাক্তার আতিক গরিব-অসহায় রোগীদের চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে মানুষের মাঝে ‘মানবতার চিকিৎসক’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।

মানবিক ডাক্তার পরিচিতি পাওয়া এই মানুষটি নড়াইল সদর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামের প্রখ্যাত এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নড়াইল শহরের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ শরীফ আতিয়ার রহমান ও মনোয়ারা বেগম গৃহিণীর ছয় ছেলে-মেয়ের মধ্যে ডাক্তার আতিক জ্যেষ্ঠ সন্তান। শৈশবে নড়াইল সদরের ভদ্রবিলা ইউনিয়নের ভবানীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৭২ সালে নড়াইল সরকারি বালক বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্টিক (মাধ্যমিক) পাস ও ১৯৭৪ সালে রাজধানীর ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ১৯৮১ সালে চিকিৎসা শাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি (এমবিবিএস) অর্জন করেছেন বিদেশের একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দেশে ফিরে ১৯৮২ সালে তৃতীয় বিসিএসের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ক্যাডার সার্ভিসে যোগদান করেন। এরপর ১৯৮৯ সালে চাকরিরত অবস্থায় সরকারিভাবে বিদেশ থেকে শল্য চিকিৎসার ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করলেও শিকড়ের টানে দেশে ফিরে মানবসেবায় নিজেকে ব্রতী করে স্বল্প সময়ে পরিচিতি পান। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৩ সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের কনসালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়া ২০০৭ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় মেয়াদে সাতক্ষীরায় চাকরি করাকালীন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন-বিএমএর সাতক্ষীরা জেলার সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। কোন অসহায় রোগীর হাসপাতালে সিট প্রয়োজন, কারও আইসিইউ লাগবে, কারও বা আবার জরুরি রক্তের প্রয়োজন। সব এক হাতে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। এমনকি কোনো কোনো রোগীকে বাড়ি থেকে হাসপাতালে আসার জন্য অ্যাম্বুলেন্সটাও পর্যন্ত ঠিক করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অপারেশন থিয়েটারে হঠাৎ কোনো রোগীর জরুরি রক্তের প্রয়োজন। রক্ত ছাড়া রোগীকে বাঁচানো যাবে না। তখন হন্যে হয়েও রোগীর স্বজনরা রক্ত খুঁজে পাচ্ছেন না। কিন্তু সেই মুহূর্তে কাকতালীয়ভাবে নিজের রক্তের গ্রুপ মিলে যাওয়ায় ডাক্তার আতিকের রক্ত ডোনেট করার ঘটনাও নেহাত কম নয়।

এদিকে কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে শুনলে মানবতার সেবায় এগিয়ে আসেন এই চিকিৎসক। মহামারি কভিড-১৯ সংক্রমণের মধ্যেও দুটি বেসরকারি হাসপাতালে হাসিমুখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসংখ্য রোগীর অপারেশনের মাধ্যমে সেবা দিয়েছেন। এ সেবা দিতে গিয়ে নিজেও করোনায় আক্রান্ত হন তিনি। আবার এ সংকটময় সময়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে রেড ক্রিসেন্টের মাধ্যমে মুমূর্ষু রোগীর জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করেন। এভাবেই করোনা সংকটকালীন রোগীর সেবায় নিয়োজিত থেকে তিনি হয়েছেন ‘মানবিক ডাক্তার’।

কর্মজীবনে মানবসেবার মানসিকতার ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে অবসর গ্রহণ করার পর থেকে নড়াইল পৌর শহরের সরকারি জিলা স্কুলের বিপরীতে থানা সড়কে অবস্থিত পৈতৃক বাড়িটির নিচতলায় প্রয়াত পিতা শিক্ষাবিদ শরীফ আতিয়ার রহমান স্মৃতি সংসদ নামে ‘ফ্রি’ চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন। ২০২২ সালের ৪ নভেম্বর এ চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রের যাত্রা শুরু। উদ্বোধনের দিন ব্যক্তিগত অর্থায়নে ২৬ দেশসেরা প্রখ্যাত চিকিৎসককে নিয়ে প্রায় ৩ হাজার রোগীকে সেবা দেওয়া হয়। সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত কয়েক হাজার রোগী বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেছেন। এখানে প্রতি মাসের শেষ শুক্রবার সারা দিন বিভিন্ন গ্রামের দরিদ্র মানুষ এসে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করছেন। প্রতি সপ্তাহে প্রায় শতাধিক ‘ফ্রি’ রোগী দেখা হচ্ছে এ দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রে। লোকজন এ চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রকে সুচিকিৎসার বাতিঘর বলেন। স্বেচ্ছাসেবী অলাভজনক প্রতিষ্ঠান শরীফ আতিয়ার রহমান স্মৃতি সংসদের স্বপ্নদ্রষ্টা ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডাক্তার এস. জেড. আতিকের নিজ হাতে গড়া এ সংগঠনটির মাধ্যমে তিনি ও তার পরিবারের মোট ছয়জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়মিত ‘ফ্রি’ মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে কাজ করে যাচ্ছেন।

সহকর্মী ও বন্ধুদের নিকট সজ্জন মানুষ হওয়ায় রোগীদের কাছে পরিচিতি পেয়েছেন মানবিক চিকিৎসক হিসেবে। অভিজাত পরিবারের একজন সন্তান হয়ে সাফল্যের চূড়ায় অবস্থান করেও নিজেকে এক মুহূর্তের জন্যও জনবিচ্ছিন্ন করেননি। এই চলার গল্প বলতে গিয়ে তাই কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমাকে যারা চেনেন তারা জানেন, রোগীর প্রয়োজনে, দেশের প্রয়োজনে কখনো পিছপা হয়নি আমি।’

তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের সেবা করার জন্য যদি কেউ মনস্থির করেন তাহলে কোনো বাধাই তখন তার কাছে আর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আমার ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল মানবসেবায় ব্রতী হব। মানবসেবায় নিজেকে যখন নিয়োজিত করেছি তখন বেঁচে থাকার শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে যেতে চাই।’ গরিব মানুষের শেষ ভরসা ডাক্তার আতিক ও তাঁর স্বেছাসেবী সংগঠন। বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা করে তিনি রোগীর আস্থা অর্জন করেছেন।

সর্বশেষ খবর