শনিবার, ২৬ আগস্ট, ২০২৩ ০০:০০ টা

স্বেচ্ছাসেবায় বদলে গেছে গ্রাম

সৈয়দপুর প্রতিনিধি

স্বেচ্ছাসেবায় বদলে গেছে গ্রাম

স্বেচ্ছাশ্রমে ও নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি রাস্তা

ইতোমধ্যে সংগঠনের জন্মের ছয় মাসের মধ্যে শতাধিক মামলার আপস মীমাংসা করা হয়েছে। বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয়েছে অর্ধশতাধিক। মাদকসেবীদের সঙ্গে মাদকের কুফল নিয়ে আলোচনা করে মাদক সেবন থেকে রক্ষা করা হয়েছে...

 

নীলফামারীর সৈয়দপুরের মাঝাপাড়া গ্রাম। এর অবস্থান বোতলাগাড়ী ইউনিয়নের মধ্য বোতলাগাড়ীতে। ওই গ্রামটিতে প্রায় ২ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশুর বসবাস। গ্রামটির বেশির ভাগ মানুষ কৃষি নির্ভরশীল। আধুনিক শিক্ষার ছোঁয়া লাগলেও হৃদয়ে গেঁথে আছে সামন্ত চিন্তা ভাবনা। অধিবাসীদের সিংহভাগ মানুষ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। অন্ধবিশ্বাস তাদের সঙ্গী। এজন্য সামান্য বিষয় নিয়ে বিবাদ হলেই থানা, পুলিশ কোর্টে ছুটে যেত সাধারণ মানুষ। বছরের পর বছর মামলা চালাতে গিয়ে অনেক পরিবার ভিটেমাটি শূন্য হয়ে পড়েন। অভাব আর অন্ধত্বের কারণে কন্যা শিশুদের বাল্যবিয়ে দেওয়া ছিল অনিবার্য। আর সন্ধ্যা নামলেই উঠতি বয়সের কিশোর ও তরুণরা গাঁজা পানে বুঁদ হয়ে যেত। এমনও দেখা গেছে প্রতিবেশীদের চলাচলের রাস্তা ও লাশ কবর দেওয়ার পথও অবরুদ্ধ করে রাখা হতো। এমন অবস্থা যুগের পর যুগ চলে আসছিল। এলাকায় কারও সঙ্গে বিবাদ শুরু হলেই মাতব্বররা দুই ভাগে ভাগ হয়ে নেতৃত্ব দিত। এতে ঝগড়া ছোট না হয়ে বৃদ্ধি পেত। একপর্যায়ে তা গড়াত থানা পুলিশ ও কোর্ট পর্যন্ত। এমন অবস্থায় আর্থিক ক্ষতির শিকার হতো কর্মজীবী মানুষ। বিশেষ করে যারা দিন আনে দিন খায়। গ্রামের এমন পরিস্থিতি নিয়ে ভাবা শুরু করেন স্থানীয় যুবকরা। অবশেষে দায়িত্ব কাঁধে নেয় আধুনিক মনস্ক অগ্রসর চিন্তক আনজারুল হক ও আমিরুজ্জামান মনা। গ্রামের সমমনা ৬০ যুবক একত্রিত হয়ে বোতলাগাড়ী আদর্শ বিদ্যা নিকেতনের মাঠে বসেন। শুরু হয় মতবিনিময়। তারা সবাই ঐকমত্যে পৌঁছেন গ্রামকে করতে হবে মামলা, মাদক ও বাল্যবিয়ে মুক্ত। একই সঙ্গে তারা সিদ্ধান্ত নেয় অর্থের অভাবে গ্রামের কোনো শিক্ষার্থী যাতে ঝরে না পড়ে। এ জন্য তারা গঠন করেন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠন ‘মানবিক সহযোগিতা ফাউন্ডেশন’। এর মাধ্যমে তারা প্রথমে গ্রামকে মামলা মুক্ত করার কাজে হাত দেয়। শুরু করে মামলার বাদী ও বিবাদীদের সঙ্গে বৈঠক। কাউন্সিলিং করলে উভয় পক্ষ বিবাদ মিটিয়ে ফেলতে সম্মত হয়। পরে তারা নিজ নিজ মামলা থানা ও কোর্ট থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। ইতোমধ্যে সংগঠন প্রতিষ্ঠার ছয় মাসের মধ্যে শতাধিক মামলার আপস মীমাংসা করা হয়েছে। বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয়েছে অর্ধশতাধিক। মাদকসেবীদের সঙ্গে মাদকের কুফল ও সমাজের পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে আলোচনা করে মাদক সেবন থেকে রক্ষা করা হয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে মাদক সেবন করতে না পারে সেজন্য মাদকসেবীদের রাখা হয়েছে বিশেষ নজরদারিতে। গত এসএসসি পরীক্ষায় ২৬ জন পরীক্ষার্থীকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। সবাই কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল করেন। ইতোমধ্যে সংগঠন চাঁদায় কবরস্থানে যাতায়াতের জন্য ৬০ ফুট আরসিসি ও গ্রামের মানুষের চলাচলের সুবিধার্থে ইটের সলিং দিয়ে প্রায় ৩০০ ফুট লম্বা শাখা রাস্তা স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও ঈদে অতি দরিদ্র পরিবারের মাঝে মাংসসহ খাদ্য সামগ্রী উপহার দেওয়া হয়। সংগঠনের সহ-সভাপতি আনজারুল হকের মতে, মানুষকে সঠিকভাবে মোটিভেশন করতে পারলে খুব সহজে সমাজের সংস্কার করা সম্ভব। মধ্য বোতলাগাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, যুবকরা ভালো চিন্তা নিয়ে কায়মনে কাজ করলে সমাজ থেকে অনাচার দূর করা কোনো কঠিন নয়। সৈয়দপুর থানার অফিসার ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম বলেন, মাঝাপাড়া গ্রামের যুবকদের মতো অন্য এলাকার যুবকরা এগিয়ে আসলে সমাজের অপরাধ অনেকাংশে কমে আসবে। সংগঠনের সভাপতি আমিরুজ্জামান বলেন, ভালো কাজে যুবকরা ঐক্যবদ্ধ ও সৎ মনোভাব নিয়ে কাজ করলে সব অসাধ্য সাধন করা সম্ভব। ইতোমধ্যে সংগঠনের জন্মের ছয় মাসের মধ্যে শতাধিক মামলার আপস মীমাংসা করা হয়েছে। বাল্যবিয়ে বন্ধ করা হয়েছে অর্ধশতাধিক। মাদকসেবীদের সঙ্গে মাদকের কুফল নিয়ে আলোচনা করে মাদক সেবন থেকে রক্ষা করা হয়েছে। যাতে ভবিষ্যতে মাদক সেবন করতে না পারে সেজন্য তাদের রাখা হয়েছে বিশেষ নজরদারিতে। বোতলাগাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান সরকার জুন বলেন, মধ্য বোতলাগাড়ীর মাঝাপাড়া গ্রাম এখন ইউনিয়নের মডেল। সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফয়সাল রায়হান বলেন, সংগঠনটিকে সাধ্যমতো সহযোগিতা অব্যাহত রাখব।

সর্বশেষ খবর