শনিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
মেয়েকে তাড়িয়ে দেওয়ায় নিজেই স্কুল খোলেন রিকতা বানু

অদম্য এক মায়ের গল্প

একরামুল হক সম্রাট, কুড়িগ্রাম

অদম্য এক মায়ের গল্প

রিকতা আখতার বানু পেশায় একজন নার্স। তার মেয়ে তানভীন দৃষ্টি মণি বাক প্রতিবন্ধী। রিকতা বানু নার্স হিসেবে কখনো কোনো রোগীকে সেবা দিতে অবহেলা করেননি। কিন্তু তার প্রতিবন্ধী মেয়েকে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করলেও শিক্ষকরা খুব অল্প সময়েই বিদ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দেন তাকে। এ বেদনা তাকে খুব কষ্ট দেয়। যাদের সন্তান শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী সেই অভিভাবকদের মনে জমে থাকা কষ্ট অনুভব করতে থাকেন তিনি। তখন তিনি কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে গড়ে তোলেন রিকতা আখতার বানু (লুৎফা) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুল। চিলমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের পাশে একটি জায়গায় নিজেই গড়ে তোলেন সমাজে অবহেলিত বাক ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য এ স্কুল। আর এ কাজে তাকে সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন তার স্বামী। তিনি স্ত্রীকে উৎসাহিত করতে ২৬ শতক জমি স্কুল গড়ার কাজে প্রদান করেন। এরপর নিজেদের অর্থায়নেই প্রথম দিকে দুইচালা একটি টিনের ঘর নির্মাণ করে মাত্র চারজন শিক্ষক ও ৬৩ জন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশু নিয়ে যাত্রা শুরু করে তার স্বপ্নের এ স্কুল। ২০১০ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হলেও ক্রমেই পরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে সরকারের সমাজসেবা থেকে মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার পান (এমপিওভুক্ত) ২০২০ সালে। পর্যায়ক্রমে এখন এ বিদ্যালয়ে তিন শতাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। বর্তমানে এ বিদ্যালয়ে ২১ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়মিত বেতনভাতা পাচ্ছেন। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রিকতা বানু জানান, ‘আমার ৯ বছরের মেয়ে তানভীন দৃষ্টি মণিকে ২০০৮ সালে ইউপি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করার চেষ্টা করি। অনেক অনুরোধের পর শিক্ষকরা ভর্তি করে নিলেও কয়েক দিন পর তাকে পড়াতে রাজি হননি। পরে জানতে পারি, প্রতিটি স্কুলে প্রতিবন্ধীদের জন্য পাঁচটি আসন রয়েছে। সে অনুযায়ী শিক্ষকদের অনেক জোরাজুরি করে মেয়েকে ভর্তি করাই। সেই সঙ্গে ওই স্কুলের এক ছাত্রীকে দিয়ে আমার মেয়েটাকে স্কুলে আনা-নেওয়ার কাজ করি। কিন্তু কয়েক দিন পর শিক্ষকরা আমার মেয়েকে তাড়িয়ে দেন স্কুল থেকে। তখন আমি ভাবি, আমার মতো অনেক অভিভাবক তার সন্তানকে নিয়ে এমন বিপদে নিশ্চয়ই পড়েছেন। তাই নিজের উপলব্ধি থেকে স্কুল তৈরির পরিকল্পনা মাথায় নিই। ২০১০ সালে স্কুল তৈরির সিদ্ধান্ত নিই। এখন রিকতা বানুর স্কুলে চিলমারী উপজেলার থানাহাট, ডাওয়াইটারি, জোড়গাছ, গুরাতিপাড়া ও সরকারপাড়াসহ ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ের গ্রাম থেকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা পড়াশোনা করতে আসে। কেউ কেউ আবার প্রায় চার-পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকেও এ বিদ্যালয়ে আসে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়ার জন্য রয়েছে তিনটি ভ্যানগাড়ি। শ্রেণি কার্যক্রম প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মোট ছয়টি শ্রেণি চালু রয়েছে। প্রথম দিকে চারজন শিক্ষক স্বেচ্ছাশ্রমে এসব প্রতিবন্ধী শিশুকে প্রাথমিক শ্রেণিতে পড়ালেও এখন সেখানে ২১ জন শিক্ষক-কর্মচারী প্রশিক্ষণ নিয়ে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে কাজ করছেন। প্রশিক্ষণ নিয়ে নানা কলাকৌশলে শেখাচ্ছেন পড়াশোনা। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ফেসিয়াল মেসেজ, স্পিচ থেরাপিসহ নানা থেরাপির মাধ্যমে এগিয়ে নিচ্ছেন সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত এই শিশুদের। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহীন শাহ জানান, খেলার সামগ্রীসহ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য আরও কিছু সরঞ্জাম প্রয়োজন। এ ছাড়াও শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণেরও প্রয়োজন। এখানে বিশেষ ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয়। একীভূত শিক্ষার ব্যবস্থা না করলে সমাজের মূলধারায় জায়গা করে নিতে এই শিশুদের সমস্যা হবে। তাই সরকারের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। রিকতা বানু জানান, ১০ বছর ধরে স্কুল নিয়ে সংগ্রাম করে আসছিলাম। ২০২০ সালে বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত হওয়ার পর কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি।

সর্বশেষ খবর