শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা
মুক্তিযুদ্ধে ড. সুলতানা আলম ও ড. ডেভিড নোলীনের স্মরণীয় অবদান

একাত্তরে পাকিস্তানিদের অস্ত্র প্রদানে নিক্সনকে বিরত করেছিলেন যেভাবে

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

একাত্তরে পাকিস্তানিদের অস্ত্র প্রদানে নিক্সনকে বিরত করেছিলেন যেভাবে

বিএডিভি ক্রেস্ট হাতে ড. সুলতানা আলম ও ড. ডেভিড নোলীন

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে তরুণী বাঙালি বধূ সুলতানা আলমের অবিস্মরণীয় ভূমিকা রয়েছে। তাঁর অহিংস আন্দোলনে মার্কিন আইনেও পরিবর্তন হয়।  সেই ঐতিহাসিক ঘটনাবলি বিবৃত হলো তারই কণ্ঠে। অবাক বিস্ময়ে সে গল্প শুনলেন পেনসিলভেনিয়া স্টেটের প্রবাসীরা। ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ডেলোয়ার ভ্যালি’র (বিএডিভি) উদ্যোগে ১৭ ডিসেম্বর, ৫৩তম বিজয় দিবস উদযাপন এবং নতুন কমিটির অভিষেক অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন বন্ধু ডেভিড নোলীনও একাত্তরের স্মৃতিচারণা করেন। বিএডিভির এবারের অনুষ্ঠানের মূল স্লোগান ছিল ‘বিজয়ের ঐক্যতানে, লাল সবুজের প্রাঙ্গণে’। অনুষ্ঠানটির মূল আকর্ষণ ছিল সভাপতি ডা. আশিক আনসারের দুই বিরল ব্যক্তিত্ব ড. সুলতানা আলম এবং ড. ডেভিড নোলীনকে নিয়ে গোলটেবিল আলোচনা। এ আলোচনায় ড. সুলতানা আলম তাঁর স্মৃতির পাতা থেকে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করেন। আমেরিকার খালাসিদের সম্মেলনে গিয়ে তিনি এমন সুন্দর বক্তৃতা দিয়েছিলেন যা খালাসিদের অনেককেই অনুপ্রাণিত করেছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা পাকিস্তানের জাহাজে আমেরিকান অস্ত্র তুলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ফলে আমেরিকা থেকে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়।

ড. ডেভিড নোলীন তিনি মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর আগে থেকেই বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন। কলেরার ওপর গবেষণা করতে গিয়ে মুখে কলেরার খাবার স্যালাইন পদ্ধতি ডা. ক্যাশের সঙ্গে মিলে আবিষ্কার করে বিশ্বে খ্যাতি লাভ করেন। এই আবিষ্কারের জন্য ১৯৭১ সালে ভারতে শরণার্থী শিবিরের অনেকের প্রাণ রক্ষা পায় এবং এ কাজটি ভারতের ডাক্তাররা পরে গবেষণা পেপার বের করেন। তিনি স্লাইড শো এবং বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকাতে তাদের কর্মব্যস্ত দিনগুলোর মধ্যে দিয়ে কীভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন তা তুলে ধরেন। তিনি এবং ডা. গ্রিনো মিলে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার গড়ে বিভিন্ন মিডিয়া, কংগ্রেসম্যান, সিনেটরসহ বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যার কথা তুলে লবিং করেন এবং অন্যদের সঙ্গে সমন্বয় করেন। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমেরিকা সরকার পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ ও অন্যান্য সহায়তা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। আমেরিকার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করার মাধ্যমে পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করতে সরকারকে বাধ্য করা হয়েছিল। মানবিকতার স্বার্থে এমন ঐতিহাসিক ঘটনার নায়ক ড. সুলতানা আলমকে এ অনুষ্ঠানে হাজির করাটাই ছিল বড় একটি সাফল্য। বয়সের ভারে ন্যুব্জ ড. আলম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সাহসী ভূমিকার কথা কখনো কাউকে বলেননি। বলতে আগ্রহবোধও করেন না। অথচ সেটি হচ্ছে বাঙালির বিজয় অর্জনের ক্ষেত্রে এক অনবদ্য অবদান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন ড. সুলতানা আলম পিএইচডির ছাত্রী এবং একজন তরুণী মাতা ছিলেন। যে গুটিকয় বাংলাদেশি ফিলাডেলফিয়াতে মানবতাবাদী আমেরিকানদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্দোলনে নেমেছিলেন তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন সুলতানা আলম। উল্লেখ্য, নিক্সন সরকার কংগ্রেসের আইন ফাঁকি দিয়ে গোপনে পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠাতে থাকে। তখন কোয়েকার গ্রুপের নেতা রিচার্ড টেইলার বিচলিত হয়ে পড়েন। তার দল জীবন বিপন্ন করে বিশাল ঢেউয়ের মাঝে ছোট ছোট নৌকা দিয়ে বাল্টিমোর আর ফিলাডেলফিয়ায় পাকিস্তানি অস্ত্র নিতে আসার জাহাজগুলোকে অবরোধ করতে থাকেন। মিডিয়াতেও খবর হতে থাকে কিন্তু এভাবে কতদিন করা যায়। তিনি ফিলাডেলফিয়া খালাসিদের নেতা আফ্রিকান আমেরিকান রিচার্ড এসকিউর কাছে সহায়তা চান। বিশাল দেহের আর বিশাল হৃদয়ের এসকিউ তখন তাদের সঙ্গে নিয়ে ফ্লোরিডার মায়ামিতে খালাসিদের বাৎসরিক সম্মেলনে নিয়ে যান। তার অনুরোধে দলের বাংলাদেশি সুলতানা আলমকে হাজারো শ্রোতার উদ্দেশে ৩ মিনিট বক্তৃতা করতে সুযোগ দেওয়া হয়। সুলতানা আলম তাঁর পরিষ্কার ইংরেজিতে অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রশ্ন করেন, ‘আমার দেশে আমরা গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরও পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ক্ষমতা না দিয়ে গণহত্যা শুরু করেছে। কংগ্রেস না করার পরও কেন আপনারা আমার দেশের নিরীহ মানুষ ও আত্মীয়স্বজনকে মারার জন্য পাকিস্তানি সৈন্যদের অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন? কী অপরাধ করেছি আমরা’- এমন কথা শুনে গর্জে ওঠে তাদের কেন্দ্রীয় নেতা, আরেকজন আফ্রিকান আমেরিকান। এদেশে তাদের দুঃখেরও শেষ নেই। ঘোষণা দিলেন শ্রমিক নেতারা, ‘আজ থেকে আমরা কোনো পাকিস্তানি জাহাজে অস্ত্র তুলব না।’ সবাই তাতে স্বাগত জানাল। ফিলাডেলফিয়ার সভাপতি এসকিউ বললেন, আমরা শুধু অস্ত্র নয়, আমরা কোনো মালামালই পাকিস্তানি জাহাজে তুলব না। আমার শ্রমিকরা রক্তের টাকা নেবে না। সেই থেকে আমেরিকা বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে লুকিয়েও সহায়তা করতে পারল না। আমেরিকার ইতিহাসে প্রথমবারের  মতো অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে বিদেশি নীতি এভাবেই পরিবর্তন হয়েছিল। ড. সুলতানা আলম পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উন্নয়ন কাজ করেছেন। তবে কোথাও বক্তৃতা দিতে বা অ্যাওয়ার্ড নিতে যাননি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমেরিকা থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ড. ডেভিড নোলীন। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ ঢাকায় কলেরা রিসার্চে গবেষণা করে তিনি এবং ডা. রিচার্ড ক্যাশ ওর‌্যাল স্যালাইনের কনসেপ্টটি আবিষ্কার করেন এবং বিশ্বেব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন। কলেরার জন্য যখন সব জায়গায় ইনজেকশনের মাধ্যমে স্যালাইন দেওয়া সম্ভব হতো না এবং অনেক মৃত্যু ঘটত, তখন মুখে এই পাউডার থেকে পানীয় খাইয়ে ডাইরিয়া রোগীদের বাঁচিয়ে রাখার এই আবিষ্কার ছিল ওই শতাব্দীর একটি বড় অবদান। পরে এ স্যালাইন প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ নিজ হাতে তৈরি করে তা কলেরা আক্রান্তদের প্রদান করে স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি ছিল বিশাল অর্জন। বাংলাদেশের মানুষের জন্য ড. নোলীনের ভালোবাসা সেই থেকে শুরু। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের গণহত্যা শুরু হলে তিনি আমেরিকাতে গড়ে তোলেন বিশাল আন্দোলন। নিক্সন আর কিসিঞ্জারের পাকিস্তান নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য ডা. গ্রিনোর সঙ্গে কো ফাউন্ডার হয়ে গড়েছিলেন ওয়াশিংটনে “বাংলাদেশ সেন্টার’’। এ সংগঠনের সদস্যরা সরকার, কংগ্রেস আর সিনেটে অনবরত চাপ তৈরি করেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় আরও মানুষ তখন গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে থাকে। নিক্সন সরকার শেষে বাধ্য হয় পাকিস্তানকে কোনো সাহায্য না দিতে। মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালনকারি এই দুজনকে কাছে পেয়ে প্রবাসীরা আপ্লুত হয়ে পড়েন।

‘বিজয়ের ঐকতানে-লাল সবুজের প্রাঙ্গণে’ বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার জন্য ড. সুলতানা আলম এবং ড. ডেভিড নোলীনকে বিশেষ সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। এ ছাড়া আকতার আহমেদ রাশার একক শিল্প প্রদর্শনী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন কণ্ঠশিল্পী এস আই টুটুল, কৃষ্ণাতিথি এবং জলি দাস ও তার দল। এ ছাড়া আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য এবং সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন নিউইয়র্কে বাংলাদেশের ডেপুটি কনসাল জেনারেল এস এম নাজমুল হাসান।

 

সর্বশেষ খবর