শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪ ০০:০০ টা
মৃত্যুর ২৪১৫ বছর পর আদালত তাঁকে নির্দোষ ঘোষণা করেন

সক্রেটিসের কারাগারে পর্যটকের ভিড়

মতিউর রহমান মুন্না, গ্রিস

সক্রেটিসের কারাগারে পর্যটকের ভিড়

সক্রেটিস। একজন বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক। বিশ্বে যত বড় বড় দার্শনিকের জন্ম হয়েছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম তিনি। এই গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসকে চেনেন না এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। ইউরোপের দেশ গ্রিসে তাঁর জন্ম। এই এথেন্সকে বলা হয় সভ্যতার আঁতুড়ঘর। এথেন্সের কোনায় কোনায় কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসের ছাপ রয়েছে। এথেন্স শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান অ্যাক্রোপোলিস। বিশ্বের যত পর্যটকই গ্রিস ভ্রমণ করেন, এথেন্সের অ্যাক্রোপোলিস যান না এমন পর্যটক পাওয়া দুষ্কর। এখানে রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসের কারাগার। যেখানে কেটেছিল সক্রেটিসের জীবনের শেষ দিনগুলো। যা দেখতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের ভিড় থাকে লক্ষণীয়।

ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে সক্রেটিসের শৈশব সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। তবে তাঁর শিষ্য প্লেটোর লেখনীতেই সক্রেটিস সম্পর্কে জানা যায়। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০ সালে গ্রিসের এথেন্সে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তরুণদের ভুলপথে চালিত করা, ধর্মের অপব্যাখ্যা এবং দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার মতো অভিযোগ আনা হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে।

সক্রেটিস এমন এক দার্শনিক চিন্তাধারার জন্ম দিয়েছিলেন, যা দীর্ঘ ২০০০ বছর ধরে পশ্চিমা সংস্কৃতি, দর্শন ও সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু প্রাচীন গ্রিসের শাসকরা সক্রেটিসের তত্ত্বগুলোকে মানতে চাননি। সক্রেটিস ছিলেন এক মহান সাধারণ শিক্ষক, যিনি কেবল শিষ্য গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষায়তন ছিল না। যেখানেই যাকে পেতেন তাকেই মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর বোঝানোর চেষ্টা করতেন। তিনি মানব চেতনায় আমাদের ইচ্ছাকে নিন্দা করেছেন, কিন্তু সৌন্দর্য দ্বারা নিজেও আনন্দিত হয়েছেন। এথেন্সের তৎকালীন আরাধ্য দেবতাদের নিয়ে প্রকাশ্যেই প্রশ্ন তুলেছিলেন সক্রেটিস। তাঁর বিরুদ্ধে অত্যাচারী শাসকদের সমর্থনেরও অভিযোগ আনা হয়েছিল। যদিও বলা হয়, সক্রেটিস নির্দোষ হলেও মুখ বুজে বিচারকদের রায় মেনে নিয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় কারারক্ষীরাও তাঁর জ্ঞানে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তারা তাঁকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করতে চেয়েছিল। কিন্তু সক্রেটিস বিনয়ের সঙ্গে  বলেছিলেন, ‘আজ পালিয়ে গেলে ইতিহাস আমায় কাপুরুষ ভাববে।’ পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাসে মহান দার্শনিক সক্রেটিসের নাম উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়ে আছে। প্লেটোর বর্ণনা মতে, সক্রেটিসের বাবার নাম সফ্রোনিস্কাস, যিনি পেশায় একজন স্থপতি (অন্য মতে, ভাস্কর) এবং মায়ের নাম ফিনারিটি, যিনি একজন ধাত্রী ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম জ্যানথিপ। সংসার জীবনে তাঁদের তিন ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। অভাবের সংসার বলে ব্যক্তিগত জীবনে খুব একটা সুখী ছিলেন না। সংসারের জ্বালা-যন্ত্রণা ভুলতে তিনি বেশির ভাগ সময় দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। তাঁর নাক নাকি ছিল থ্যাবড়া। দেখতেও ছিলেন অনেকটা কুৎসিত। তবে ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। তর্কে ছিলেন তুখোড়। তর্ক করে কেউ তাঁকে হারাতে পারত না। তাঁর প্রিয় বাক্য ছিল ‘নিজেকে জানো’। সক্রেটিস তাঁর নিজ দর্শন প্রচারের জন্য নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। রাস্তাঘাট, হাটবাজার প্রভৃতি যখন যেখানে সুবিধা সেখানেই আবালবৃদ্ধবনিতার সঙ্গে বিনামূল্যে তিনি দর্শন আলোচনায় প্রবৃত্ত হতেন। সোফিস্টদের মতো তিনি শিক্ষাদানের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণকে ঘৃণা করতেন। দার্শনিক আলোচনার প্রতি তাঁর এত বেশি ঝোঁক ছিল যে, তিনি প্রায়ই বলতেন : ‘নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়াই আমার অভ্যাস, আর এজন্যই এমনিতে না পেলে পয়সা-কড়ি দিয়ে হলেও আমি দার্শনিক আলোচনার সাথী সংগ্রহ করতাম।’ তিনি নিজেকে কখনো সোফিস্টদের মতো জ্ঞানী ভাবতেন না। বরং তিনি বলতেন, ‘আমি জ্ঞানী নই, জ্ঞানানুরাগী মাত্র। একটি জিনিসই আমি জানি; আর সেটি হলো এই যে, আমি কিছুই জানি না।’ জ্ঞান, শিক্ষা দিয়ে তিনি এথেন্সের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেন। তাঁর অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাঁর প্রিয় শিষ্য প্লেটো প্রচার করতে থাকেন গুরুর শিক্ষা-দীক্ষা। কিন্তু দেশটির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সক্রেটিসের এ খ্যাতি মেনে নেয়নি। পছন্দ করেনি তাঁর শিক্ষা-দর্শন। 

এদিকে মৃত্যুদন্ড কার্যকরের ২৪১৫ বছর পর গ্রিসের একটি আদালত জানালেন, সক্রেটিস নির্দোষ ছিলেন। সেই বিচারেই সক্রেটিসকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে রায় দিয়েছেন ওই আদালত। ২০১৬ সালে নিউইয়র্কের একটি আদালতেও সক্রেটিস নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছিলেন।

সর্বশেষ খবর