শনিবার, ১১ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা

ঐতিহ্য রক্ষায় নৌকা জাদুঘর

রেজা মুজাম্মেল, চট্টগ্রাম

ঐতিহ্য রক্ষায় নৌকা জাদুঘর

আধুনিকতার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে দেশের অনেক ঐতিহ্য। যান্ত্রিকতার দাপটে হারাচ্ছে চিরায়ত বাংলার বিভিন্ন স্মারক। হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির অন্যতম বর্ণিল অনুষঙ্গ নৌকা। নদীমাতৃক দেশের নদীগুলোতে কমছে নৌকা চলাচলের সংখ্যা। ফলে বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছে নৌকা এখন দেশের অতীত ঐতিহ্যের প্রতীক।

হারাতে বসা নৌকাকে প্রজন্মের কাছে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো নির্মাণ করা হচ্ছে ‘চট্টগ্রাম নৌকা মিউজিয়াম’। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে মিউজিয়াম নির্মাণ কাজ। এখানে শোভা পাবে দেশের প্রতিটি জেলার স্থানীয় নামের নৌকা। ইতোমধ্যে দেশের ১১টি জেলার ১৯টি নামের নৌকার রেপ্লিকা সংগ্রহ করা হয়েছে। এ সংগ্রহ অব্যাহত আছে। সংগ্রহ করা হচ্ছে বিভিন্ন দেশের নৌকার রেপ্লিকাও। চট্টগ্রামের ফৌজদার হাট ডিসি পার্কের পাশেই চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নিজস্ব অর্থায়নে মিউজিয়ামটি তৈরি করা হচ্ছে। গত ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ নৌকা জাদুঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। দেশে এর আগে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর বরগুনা জেলায় ১৬৫ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৩০ ফুট প্রস্থের একটি নৌকা মিউজিয়াম চালু করা হয়েছিল।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় ভিন্ন নামে ভিন্ন ডিজাইনে নৌকার প্রচলন আছে। কিন্তু এরই মধ্যে অনেক নৌকা হারিয়ে গেছে, অনেক নৌকা হারানোর পথে। তাই বর্তমান প্রজন্মের কাছে চিরায়ত বাংলার ঐতিহ্য নৌকাকে বাঁচিয়ে রাখতে নৌকা মিউজিয়াম নির্মাণ করা হয়। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলার ঐতিহ্যবাহী নৌকার রেপ্লিকা সংরক্ষণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, এটি কেবল নৌকা মিউজিয়াম নয়, এখানে থাকবে নৌকার দাঁড়, গুল, পাল ইত্যাদি। থাকবে একটি থ্রি-ডি থিয়েটার, যেখানে সমুদ্রগামী নাবিকরা ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে কী ধরনের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি হয় সেটি তুলে ধরা হবে। স্থাপন করা হবে বড় আকারের বিভিন্ন ডিজাইনের সাম্পান। থাকবে নৌকার ইতিহাস-ঐতিহ্য।

জানা যায়, ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ঐতিহ্যবাহী নৌকা সংগ্রহ অব্যাহত আছে। এর মধ্যে আছে- চট্টগ্রাম জেলার ‘সাম্পান’ নামের ৮ ফুট ও ২৫ ফুট দৈর্ঘ্যরে নৌকা এবং শুলুক নামের ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে নৌকা। রাজশাহী জেলার ‘পানসি’ নামের ৮ ফুট দৈর্ঘ্যরে নৌকা। কক্সবাজার জেলার ‘চাঁদ’ নামের তিন ফুট দৈর্ঘ্যরে নৌকা ও ‘ফিশিং ট্রলার’ নামের ২৫ ফুট দৈর্ঘ্যরে নৌকা। কিশোরগঞ্জ জেলার ‘গয়না’ নামের ৮ ফুট দৈর্ঘ্যরে নৌকা। গাইবান্ধা জেলার ‘ফেটি’ নামের ৮ ফুট দৈর্ঘ্যরে নৌকা। ফরিদপুর জেলার ‘বিক’ নামের ২৫ ফুট দৈর্ঘ্যরে নৌকা। রংপুর জেলার ‘বাঁশের ভেলা’ নামের ১২ ফুট দৈর্ঘ্যরে নৌকা। সাভারের ‘ডিংগি’ নামের ৮ ফুট দৈর্ঘ্যরে নৌকা। ময়মনসিংহের ‘ময়ূরপঙ্খী’ নামের ৩ ফুট দৈর্ঘ্যরে নৌকা। চাঁদপুরের ‘ঘাসি’ নামের ৩ ফুট দৈর্ঘ্যরে নৌকা। পাবনা জেলার ‘মালার’ নামের ২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে এবং ‘তালের ডোংগা’ নামের ১২ ফুট দৈর্ঘ্যরে নৌকা। জানা যায়, দেশে অঞ্চল ও এলাকাভেদে নানা ধরনের নৌকা আছে। অঞ্চলভেদে এগুলোর আকার-ধরন ও ডিজাইন ভিন্ন। গঠনশৈলী ও পরিবহনের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের নৌকার প্রচলন আছে। এর মধ্যে আছে- ছিপ নৌকা, বজরা নৌকা, ময়ূরপঙ্খী নৌকা, গয়না, পানসি, কোষা, ডিঙি, পাতাম নৌকা, বাচারি, রপ্তানি নৌকা, ঘাসি, সাম্পান, ফেটি নৌকা, নায়রি, সওদাগরি নৌকা, ইলশা নৌকা, পালতোলা নৌকা, কেড়াই নৌকা, বেদে বা সাপুরিয়া নৌকা, ভোট নৌকা, বৌচোরা নৌকা, লক্ষ্মীবিলাস, গণ্ডীবিলাস, খেয়া নৌকা, বাইচের নৌকা। তবে কালের পরিক্রমায় অনেক ডিজাইন ও নামের নৌকা এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কিছু হারিয়ে যাওয়ার পথে এবং কিছু এখন জাদুঘরে। মিউজিয়ামের মাধ্যমে এসব নৌকার স্মৃতিচিহ্ন সংগ্রহ করে এখানে সংরক্ষণ করা হবে। পক্ষান্তরে, একই সঙ্গে কমে যাচ্ছে মাঝিমাল্লা ও নৌকা তৈরির কারিগর। গ্রামীণ আদলে নৌকা তৈরির স্থান দখল করেছে যান্ত্রিকতা। যান্ত্রিক সভ্যতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে নৌকা তৈরির সনাতন পদ্ধতি।

 

সর্বশেষ খবর