শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪ ০০:০০ টা
‘আবদুল্লাহ’ জাহাজ নাবিকদের ৩৩ দিন বন্দিদশা

ঘরে ফেরার দমবন্ধ করা অপেক্ষা

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

ঘরে ফেরার দমবন্ধ করা অপেক্ষা

চলতি বছরের ৪ মার্চ দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে কয়লার চালান নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরে যাচ্ছিল বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। জলদস্যুর ঝুঁকি এড়াতে ভারত মহাসাগরের অপরপ্রান্ত সোমালিয়ান উপকূল থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূর দিয়ে পাড়ি দিচ্ছিল আবদুল্লাহ। তবে শেষ পর্যন্ত দস্যুদের কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা সফল হয়নি। এক মাসের অধিক সময় শিকারের অপেক্ষায় থাকা সোমালিয়ান দস্যুদের নজর এড়াতে পারেনি জাহাজটি। ১২ মার্চ বাংলাদেশ সময় দুপুর দেড়টায় সোমালিয়ান জলদস্যুরা কবজায় নেয় চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং করপোরেশনের মালিকানাধীন জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে। এরপর থেকেই শুরু হয় সোমালিয়ান জলদস্যুদের ডেরায় রুদ্ধশ্বাস ৩৩ দিন।

জিম্মিদশার শুরু যেভাবে : অন্যান্য দিনের মতোই নাবিকদের কাছে ১২ মার্চও ছিল সাধারণ একটি দিন। কেউ ব্যস্ত ছিলেন জাহাজে থাকা কয়লার তাপমাত্রা পরীক্ষায়। কেউ ব্যস্ত অন্যান্য দায়িত্ব নিয়ে। বাংলাদেশ সময় দুপুর সাড়ে ১২টার কাছাকাছি। এমন সময় ১১ নটিক্যাল মাইল দূরে একটি ইরানি মাছধরা ট্রলার চিহ্নিত করেন তৃতীয় অফিসার তারিকুল ইসলাম। ট্রলারটি জাহাজের দিকে ধেয়ে আসতে দেখে তৃতীয় অফিসার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেনকে তা অবহিত করেন। এ সময় সব নাবিক জাহাজের ব্রিজে চলে আসেন এবং ট্রলার থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এমন অবস্থা থেকে দস্যুরা হাইস্পিড বোটে করে জাহাজটিকে ধাওয়া করে। দস্যুদের স্পিডবোট জাহাজের কাছাকাছি এলে ‘জিকজ্যাক কোচ’ করা হয়, যাতে দস্যুরা জাহাজে উঠতে না পারে। নাবিকরা দস্যুদের ঠেকানোর চেষ্টা করেন। এরই মধ্যে বিভিন্ন নেভি জাহাজকে সহায়তার জন্য বার্তা পাঠানো হয়। কোয়ালিশন ট্রান্সপোর্ট জাহাজের সহায়তার জন্যও চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কারও সাড়া পাওয়া যায়নি। চালু করা হয় ‘শিপ সিকিউরিটি অ্যালার্ট সিস্টেম’। সঙ্গে ইউকে এমটিকেও ফোন করা হয়। প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় জাহাজটি কবজায় নেয় দস্যুরা। এরপর জাহাজ নিয়ে সোমালিয়ান উপকূলের দিকে রওনা দেয়। নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দুই দিন পর সোমালীয় উপকূলের গ্যারাকাদ থেকে ৭ নটিক্যাল মাইল দূরে প্রথম নোঙর করা হয় জাহাজটি। এরপর একাধিকবার স্থান পরিবর্তন করা হয় জাহাজের।

জিম্মি হওয়ার পরিস্থিতি বর্ণনা দিয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ বলেন, ‘জাহাজের তৃতীয় অফিসার প্রথম দস্যুদের স্পিড চিহ্নিত করেন। এটা আমাকে অবহিত করলে দ্রুত জাহাজ সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করি। কিন্তু দস্যুরা হাইস্পিড বোট ব্যবহার করায় আমরা আর তাদের সঙ্গে পেরে উঠিনি। অল্প সময়ের মধ্যেই তারা জাহাজে উঠে পড়ে। প্রথমে তৃতীয় অফিসারকে জিম্মি করে। এরপর আমাদের জিম্মি করে। জিম্মি করার পর দস্যুদের জানাই আমরা মুসলমান এবং রোজা রেখেছি। এটি বলার উদ্দেশ্য ছিল তারা যাতে আমাদের ওপর কম নির্যাতন করে।

জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান বলেন, ‘দস্যুরা আমাদের জিম্মি করার পর সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। এ সময় ক্যাপ্টেন আমাদের নির্দেশ দেন সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার। একই সঙ্গে তাদের

সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার। এ ক্ষেত্রে আমরা সফলও হয়েছি। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের সঙ্গে ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে।’

কষ্টের দিনগুলো : জাহাজ জিম্মি করার সময় ভারী অস্ত্রধারী ১২ দস্যু জাহাজে উঠলেও তীরে যাওয়ার পর বাড়তে থাকে দস্যুর সংখ্যা। জিম্মিদশার শেষ দিন জাহাজে উপস্থিত ছিল ৬৫ জন জলদস্যু। জিম্মি নাবিকদের শারীরিক নির্যাতন না করলেও বন্দিদশার দিনগুলো ছিল দুর্বিষহ। শুরুর ১০ দিন মানসিকভাবে নির্যাতন চালাত দস্যুরা। এরপর পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ হলেও সারাক্ষণ আতঙ্কে দিন কাটত নাবিকদের। মাদক শেষ হয়ে এলে দস্যুরা নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়ত। ফাঁকা গুলি ছুড়ত। প্রায় মাঝ রাতে বিকট শব্দে ঘুম ভাঙত নাবিকদের। দস্যুদের ভারী অস্ত্রের ফাঁকা গুলিতে কেঁপে উঠত পুরো জাহাজ। শেষের দিকে দিনের বেলায় নাবিকদের দেওয়া হয় অবাধ ঘোরাঘুরির সুবিধা। কিন্তু রাতে থাকত কড়াকড়ি। সবাইকে ঈদের নামাজ পড়ার সুযোগ দেওয়া হলেও নামাজের পর ছবি ভাইরাল হলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় ইন্টারনেট সংযোগ বেশ কিছু সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন করে দেয় দস্যুরা। জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান বলেন, ‘দস্যুরা প্রায় ভারী অস্ত্র দিয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ত। গুলির বিকট শব্দে মাঝ রাতে ঘুম ভাঙত। এ সময় মনের মধ্যে ভয় কাজ করত। কখনো কখনো পরিবার-পরিজনের কথা মনে পড়লে বুক ফেটে কান্না আসত। তখন সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করতাম দ্রুত মুক্তির ব্যবস্থা করার জন্য।’

বাড়ি ফেরা : ২০ মার্চ দুপুরে জলদস্যুদের কাছ থেকে প্রথম ফোন আসে জাহাজের মালিক এসআর শিপিং করপোরেশনের কাছে। এরপর শুরু হয় দুই পক্ষের দর কষাকষি। শুরুতে দস্যুরা বড় অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করলেও শেষ পর্যন্ত ৫০ লাখ ডলারে রফাদফা হয়। সমঝোতা হওয়ার পর মুক্তিপণের অর্থ পৌঁছে দেওয়ার জন্য ছোট উড়োজাহাজ ভাড়া করে অর্থ পরিবহনের জন্য নিয়োজিত সংস্থা। ১৪ এপ্রিল ভাড়া করা উড়োজাহাজ মুক্তিপণের অর্থ নিয়ে আসার পর সব নাবিক অক্ষত আছেন এমন নিশ্চয়তা পাওয়ার পর ডলার ভর্তি তিনটি ব্যাগ এক এক করে ফেলা হয় সাগরে। এ সময় উল্লাস করতে করতে পানি থেকে ব্যাগগুলো সংগ্রহ করে দস্যুরা। বিকালে মুক্তিপণের অর্থ পেলেও দস্যুরা তাৎক্ষণিকভাবে জাহাজ থেকে নেমে যায়নি। আরও ৮ ঘণ্টা পর ৬৫ জলদস্যু জাহাজ থেকে নামে। দস্যুমুক্ত হয় জাহাজ। এরপর আরব আমিরাতের আল হামরিয়া বন্দরের দিকে রওনা হয় এমভি আবদুল্লাহ। ২১ এপ্রিল বিকালে আল হামরিয়া বন্দরে নোঙর করে জাহাজ। এরপর আরেকটি চালান দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে রওনা দেয় জাহাজটি। ১২ মে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরের কুতুবদিয়ায় নোঙর করে। ১৪ মে নাবিকদের বহনকারী জাহান মণি-৩ নোঙর করে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) ১ নম্বর জেটিতে। এখানে ২৩ নাবিককে দেওয়া হয় বীরোচিত সংবর্ধনা। অতঃপর আপন নীড়ে ফিরে যান নাবিকরা। তাদের এ অবিশ্বাস্য বেঁচে ফেরার ঘটনায় আনন্দিত স্বজনরা।  প্রসঙ্গত, জলদস্যুদের কবলে পড়া এমভি আবদুল্লাহর আগের নাম ছিল ‘গোল্ডেন হক’। ২০১৬ সালে তৈরি হওয়া ১৯০ মিটার লম্বা জাহাজটি গত বছর কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং করপোরেশনের বহরে যুক্ত হওয়ার পর নামকরণ করা হয় ‘এমভি আবদুল্লাহ’। এরপর থেকে জাহাজটি সাধারণ পণ্য পরিবহন করে আসছিল।

সর্বশেষ খবর