শনিবার, ২২ জুন, ২০২৪ ০০:০০ টা
চাঁদমনি আশ্রম

অনাথ বালিকাদের নিরাপদ ঠিকানা

আবদুল বারী, নীলফামারী

অনাথ বালিকাদের নিরাপদ ঠিকানা

চাঁদমনি আশ্রম অনাথদের দিয়েছে মাথা গোঁজার ঠাঁই। বাবা-মায়ের আদর-ভালোবাসা। লেখাপড়ার সুযোগ। করেছে ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা। দিয়েছে জীবনের নিশ্চিত নিরাপত্তা। এই আশ্রমটি চালাচ্ছেন পিজিরুল আলম দুলাল। জলঢাকা উপজেলার বালাগ্রাম ইউনিয়নের তিস্তা প্রধান সেচ খালের কোলঘেঁষে চাওড়াডাঙ্গী গ্রামে গড়ে তোলা হয়েছে চাঁদমনি আশ্রম। অনাথ মেয়েদের জন্য ১৯৯৯ সালে নীলফামারীর জলঢাকার বালাগ্রাম ইউনিয়নের চাওড়াডাঙ্গী গ্রামে ১ একর ১০ শতাংশ জমির ওপর এই আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা পিজিরুল আলম দুলাল। ১৯৯৬ সালে উত্তরা ব্যাংকের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। এরপর স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে চলে আসেন। নিঃসন্তান হওয়ায় সমাজের অবহেলিত ও অনাথ শিশুদের জন্য কিছু করার স্বপ্ন ছিল তার। এরপর পাঁচ অনাথ শিশুকে নিয়ে পৈতৃক সম্পত্তিতে ‘চাঁদমনি’ নামে অনাথ আশ্রম গড়ে তোলেন। কন্যাদের লালন করতে গিয়ে শেষ করেছেন নিজের পেনশনের টাকা। ‘চাঁদমনি’ অনাথ আশ্রমে বর্তমানে বসবাস করছে ৩০ জন অনাথ মেয়ে। তারা বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। পেনশনের টাকায় ২৫ বছর ধরে মেয়ে শিশুদের লালন-পালন করছেন।

এখানে এতিম, অনাথ ও দরিদ্র মেয়েদের থাকা খাওয়া ও লেখাপড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া ধর্মীয় শিক্ষা ও খেলাধুলাসহ চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির সহায়তায় অনেকে পাচ্ছেন উচ্চশিক্ষার সুযোগ। গত ২৫ বছরে আট শতাধিক মেয়ে লেখাপড়া শিখে বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করছেন। এখানে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়া ও লেখাপড়া শেখানো হয়। যাদের বাবা-মা নেই, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই এমন শিশুদের শিক্ষিত করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাই তার মূল উদ্দেশ্য। এখানে মেয়েদের সপ্তাহে চার দিন আলেম দিয়ে দেওয়া হয় কোরআন শিক্ষা, ছবি আঁকার ক্লাস হয় সপ্তাহে এক দিন, মাসে দুই দিন গান শেখানো হয়। এ ছাড়া হস্তশিল্প ও সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। নিশাত আক্তার বলেন, এখানে আমি তিন বছর আগে এসেছি। আমার মা মারা যাওয়ার পর আমার বাবা আরেকটা বিয়ে করেছেন, এজন্য এখানে এসেছি। এখানে খাবার খাচ্ছি, নতুন কাপড় পাচ্ছি কোনো অসুবিধা নেই। বৃষ্টি আক্তার বলেন, এখানে থাকতে অনেক ভালো লাগে। আমি বড় হয়ে চাকরি করতে চাই। এখানে আমি বই পড়ি, ছবি আঁকি, টিভি দেখি, খেলাধুলা করি। আশ্রমটিতে রান্না ও দেখভালের দায়িত্বে থাকা মমিনা বেগম বলেন, এখানে প্রায় ১২ বছর ধরে কাজ করছি। রান্নার পাশাপাশি বাচ্চাগুলোর দেখাশোনা করি। আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা পিজিরুল আলম দুলাল বলেন, প্রথমে আমি পাঁচজন মেয়ে দিয়ে শুরু করি। পরে দেখা যায় আরও অনেকে মেয়ে দিতে চায়। এভাবে ১৫ জন মেয়ে এলো। ১৫ জন মেয়ে দিয়ে এভাবে ৩-৪ বছর চলল। তারপর এক পর্যায়ে ৩৫ জন মেয়ে হলো। আশ্রমের নাম পরে দেওয়া হলো চাঁদমনি। চাঁদমনি মানে চাঁদের মতো শিশু। এটা কোনো রেজিস্টার্ড প্রতিষ্ঠান নয়। আমরা কোথাও কোনো রেজিস্ট্রেশন করিনি।

আশ্রমটিতে যারা ছিল বা থাকছে তারা দীর্ঘদিন ধরে আছে। কেউ ১০-১২ বছর ধরে, কেউ আবার ৩-৪ বছর ধরে। মেয়েরা বিভিন্ন সময় আসছে, গেছে। এরকম মেয়ের সংখ্যা ১ হাজারেরও বেশি। আর স্থায়ীভাবে যারা বসবাস করছে তাদের সংখ্যাও একশর বেশি। এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে গেছে এদের সংখ্যা দুইশ এর বেশি। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেছে কয়েকজন। আমি অবসরের পর ১৫ লাখের মতো টাকা পেয়েছিলাম, আমার নিজের পৈতৃক কিছু সম্পত্তি ও কেনা কিছু সম্পত্তি ছিল সব এখানে দিয়েছি। এছাড়া কিছু লোক আমাকে সাহায্য করে। আমার ভাগ্নিরা আছে তারাও আমাকে এখানে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে।

আশ্রমটিতে রয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আছে হলরুম ও লাইব্রেরি। নিজ নিজ কক্ষে রয়েছে চেয়ার-টেবিল। ক্লাসের বই পড়া ছাড়াও ছবি আঁকা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ছোটগল্প, উপন্যাস ও গুণীজনদের জীবনী পড়ার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। জলঢাকা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনছার আলী মিন্টু বলেন, বৃদ্ধ বয়সে এসেও এই অনাথ শিশুদের আলোকিত করে তুলছেন দুলাল। এটি মহৎ উদ্যোগ। তার এই কাজে সবাইকে সহায়তার হাত বাড়ানো উচিত।

সর্বশেষ খবর