২৩ নভেম্বর, ২০২৩ ১২:২১

আঠা ছাড়াই কীভাবে দেওয়াল আঁকড়ে ঘুরে বেড়ায় টিকটিকি?

নিজস্ব প্রতিবেদক

আঠা ছাড়াই কীভাবে দেওয়াল আঁকড়ে ঘুরে বেড়ায় টিকটিকি?

আঠা ছাড়াই কীভাবে দেওয়াল আঁকড়ে ঘুরে বেড়ায় টিকটিকি?

টিকটিকি, আমাদের প্রাণী জগতের অতিপরিচিত একটি প্রাণী। এটি একটি অমেরুদণ্ড প্রাণী। কিন্তু এই প্রাণীর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে- তা হল দেওয়াল বাং সিলিংয়ে হেঁটে বেড়াতে পারে। চাইলেই সেখানে দিব্যি গ্যাঁট হয়ে বসে থাকে, যা অন্য কোনো প্রাণীর পক্ষে সম্ভব হয় না। কিন্তু কীভাবে এই কঠিন কাজটি করে টিকটিকি?

এই সংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, টিকটিকির পায়ে আর দেওয়ালের মধ্যে এমন এক ধরনের বল কাজ করে, যা এমনিতে এতই ক্ষীণ যে কাজ করার কথা না। কিন্তু সেই ক্ষীণ বলটাই ওদের পায়ের গঠনের কারণে বহুগুণ বেড়ে গিয়ে ওদের গোটা ওজনটাকেই ধরে রাখতে পারে। কী সেই বলের উৎস? টিকটিকির পায়ের গঠনই বা কিরকম যে এই প্রাণী সেই বলকে কাজে লাগাতে পারে?

টিকটিকির পায়ের আঙ্গুলে ওগুলো কী?

টিকটিকি বেশ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন জার্মান বিজ্ঞানী স্টানিস্লাভ। গবেষণা দেখা যায়, টিকটিকি লেজ ব্যবহার করে ভারসাম্য রক্ষা করতে, আর পা ব্যবহার করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে। টিকটিকির মোট চারটি পা, প্রত্যেকটিতে আবার পাঁচটি করে আঙ্গুল।

আঙ্গুলে কিছু আছে নিশ্চয়ই?

টিকটিকির এই আঙ্গুলগুলোর গঠনে যে একটা বিশেষত্ব আছে সেটা আঁচ করেছিলেন গবেষকরা। তারা টিকটিকির পা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করার কথা ভাবলেন। কিন্তু এই গঠন খুঁটিয়ে দেখা সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বহুদিন টিকটিকির রহস্য উদ্ঘাটন বিজ্ঞানীদের কাছে অধরাই থেকে গিয়েছিল।

তবে আধুনিক যুগে ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র (electron microscope) অনেক সহজলভ্য হয়েছে। গবেষকরা টিকটিকির পা আরো খুঁটিয়ে দেখার জন্য এই ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করলেন। আর তখনই বেরিয়ে এলো এক নতুন জগৎ। বিজ্ঞানীরা দেখতে পেলেন টিকটিকির এক একটা আঙুলের চামড়ায় রয়েছে হাজার হাজার ভাঁজ। সেই ভাঁজের মধ্যে রয়েছে কয়েক লাখ লোমের সমাহার। এই লোমগুলোর বৈজ্ঞানিক নাম ‘সিটা’ (setae)। এগুলো আবার কেরাটিন (keratin) নামের এক ধরনের প্রাকৃতিক তন্তুময় (fibrous) প্রোটিন  দিয়ে তৈরি। মজার কথা হল- আমাদের নখ আর চুলও এই কেরাটিন দিয়েই তৈরি।

প্রতি ‘সিটা’ সাধারণত ৩০-১৩০ মাইক্রোমিটার পুরু, মাথাটা চ্যাপ্টা ধরনের, আর একগুচ্ছ তন্তু দিয়ে গঠিত। তাতে তন্তুর সংখ্যা শত-র ঘরে কিংবা হাজারের ঘরে। তাদের এক একটার নাম স্প্যাচুলা (spatula)।  এদের ন্যানোতন্তু বলা যায় কারণ এদের ব্যাস কয়েক ন্যানোমিটার (১ ন্যানোমিটার মানে ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের ১ ভাগ, বা আমাদের মাথার চুলকে আড়াআড়িভাবে এক লাখ ভাগ করলে এক ভাগ যা দাঁড়ায় তাই )।

অনেকের ধারণা ছিল, টিকটিকিরা দেওয়াল বেয়ে ওঠার সময় পায়ের পাতা ও তলের মধ্যে একটা যান্ত্রিক ইন্টারলকিং (মেকানিকাল interlocking) তৈরি হয়। কিন্তু পরীক্ষা করে পাওয়া যায় আজব ব্যাপার। ওরা কিন্তু দেওয়ালে আটকে থাকার জন্য কোনো চটচটে আঠা, আঁকড়ে ধরার জন্য নখ, বা সাকশন তৈরির জন্য অক্টোপাসের মতো কোনো ভ্যাকুয়াম চোষকও ব্যবহার করে না।

বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রবার্ট ফুল এর নেতৃত্বে একটা গবেষক দল ২০০০ সালে একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তাতে দেখানো হয় যে দেওয়ালের সাথে টিকটিকির আটকে থাকা আসলে দেওয়ালের সঙ্গে পায়ের ওই তন্তুগুলোর আন্তঃআণবিক বলেরই (intermolecular forces) ফল। টিকটিকিদের পায়ের পাতা ও তলের মধ্যে আণবিক স্তরে একটা আকর্ষণ বল (adhesive force) তৈরি হয়। এই বলটা আসে ভ্যান-ডার-ওয়াল মিথস্ক্রিয়া (Van der Waal interaction) থেকে।

যদিও ভ্যানডার ওয়ালস বল খুবই দুর্বল একটি বল। যেহেতু টিকটিকির পায়ের তন্তু লক্ষাধিক আর দেয়ালের অণুর সংখ্যাও অনেক বেশি তাই দুইয়ের মধ্যে ভ্যানডার ওয়ালস বলও অত্যন্ত বেশি হয়। তাই টিকটিকি সহজেই দেয়ালে আটকে থাকতে পারে। 

কিন্তু আটকে থাকলে আবার চলে কীভাবে? টিকটিকির এক অসাধারণ ক্ষমতা আছে। টিকটিকি ইচ্ছেমতো ভ্যানডার ওয়ালস বল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ কারণে শুধু এক জায়গায় ঝুলেই থাকতে পারে না; বরং হেঁটেও বেড়াতে পারে।

টিকটিকির পায়ে যে সিটা আছে তার শক্তিও ভয়াবহ। টিকটিকির সবগুলো সিটা একত্রে ব্যবহার করতে পারলে একটি ছোট টিকটিকি মোটামুটি ২৮৬ পাউন্ড ওজনের একজন মানুষকে তুলে ধরতে পারে। কিন্তু টিকটিকি তার সবগুলো সিটা একই সঙ্গে ব্যবহার করতে পারে না। ফলে একটি টিকটিকি বাস্তবে মাত্র ৪.৪ পাউন্ড ভার বহন করতে পারে।

তথ্যসূত্র:
https://cosmosmagazine.com/technology/how-human-can-climb-gecko

http://www.maths.gla.ac.uk/~cc/geckos–GHJ-2005.pdf

https://www.nature.com/articles/35015073

https://www.nature.com/news/2002/020826/full/news020826-2.html

https://www.youtube.com/watch?v=TlyvS1ckDZM

https://www.nature.com/articles/nmat917

https://cosmosmagazine.com/technology/geckos-inspire-new-nasa-technology-to-make-things-stick-together-in-space/

https://www.asc.ohio-state.edu/schumacher.60/class/570/notes/p036.pdf

https://aapt.scitation.org/doi/10.1119/1.1523075

https://royalsocietypublishing.org/doi/pdf/10.1098/rspb.2020.0123

বিডি প্রতিদিন/আজাদ

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর