২৪ নভেম্বর, ২০২৩ ১৮:৩৫

নির্ভরযোগ্য ডেটা স্টোরেজ হতে যাচ্ছে ডিএনএ

অনলাইন ডেস্ক

নির্ভরযোগ্য ডেটা স্টোরেজ হতে যাচ্ছে ডিএনএ

জীবজগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অণু হলো ডিঅক্সি রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড ( ডিএনএ)।  জীবকোষের নিউক্লিয়াসে ক্রোমোজমের মধ্যেই মূলত এর অবস্থান। ডিএনএ অণু দুটো লম্বা সুতোর মতো পরস্পরকে  জড়িয়ে থাকে। তাদের এই জড়িয়ে থাকা কাঠামোটিকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ডিএনএ ডাবল হেলিক্স।

এই ডাবল হেলিক্স কাঠামোটি তৈরি হয়েছে ডিঅক্সি রাইবোস, ফসফেট এবং চার ধরনের নাইট্রোজেন বেস দিয়ে। এদের নাম হলো, অ্যাডেনিন, থায়মিন, গুয়ানিন এবং সাইটোসিন। সংক্ষেপে এদেরকে নামের চারটি আদ্যক্ষর ATGC দিয়ে প্রকাশ করা হয়। ডিএনএ ডাবল হেলিক্সের ভেতর A জোড় বেঁধে থাকে T-এর সাথে এবং C জোড় বেঁধে থাকে G-এর সাথে। 

ডিএনএ বর্ণমালার এই চারটি অক্ষর ATGC দিয়েই সকল জীবের জিনোম রচিত হয়েছে।  জিনোম বলতে কোনো জীবের সামগ্রিক ডিএনএ বিন্যাসকে বোঝায়। যেমন ধরুন, মানুষের জিনোমে রয়েছে তিন বিলিয়ন AT এবং GC বেইস জোড়। তথ্য ভান্ডার হিসেবে এটি বিশাল বড়।

মানুষের জিনোমে রক্ষিত সকল ATGC কে যদি ধারাবাহিকভাবে  A4 সাইজের কাগজে প্রিন্ট করে স্ট্যাক করে রাখা হয়, তাহলে তার উচ্চতা হবে প্রায় ১৩০ মিটার, অর্থাৎ নিউইয়র্কের স্ট্যাচু অফ লিবার্টির চেয়েও উঁচু। মানবদেহের ৩০  ট্রিলিয়ন কোষের প্রতিটিতে এই পরিমাণ তথ্য লেখা আছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, ডিএনএ বিপুল পরিমাণ তথ্যকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র স্থানে সন্নিবেশিত করে রাখে।

এটাই হলো প্রকৃতির নিয়ম। লক্ষ কোটি বছর ধরে, প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে ডিএনএ অণুর ভেতরে জীবনের যাবতীয় তথ্যকে ধারণ করেছে এবং বংশ-পরম্পরায় ছড়িয়ে দিয়েছে।

ডিএনএ অণুকে অনেকে বলেন, দি মাস্টার মলিকিউল অফ লাইফ। এক কথায় বলা যায়, জীবনের ব্লুপ্রিন্টকে ধারণ ও বহন করে ডিএনএ অণু। মজার ব্যাপার হলো, জীব বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক ডিএনএ অণুকে বিজ্ঞানীরা এখন তথ্যপ্রযুক্তির কাজে লাগাচ্ছেন। বিজ্ঞানীদের মতে, ডিএনএ অণু যদি সার্থকভাবে জীবজগতের সকল তথ্যকে ধারণ করতে পারে, তাহলে ইলেকট্রনিক তথ্যপ্রযুক্তির ডেটাকে ধারণ করার ক্ষেত্রে একে কাজে লাগানো  যাবে।  

আমরা জানি কম্পিউটারের সকল তথ্য বাইনারি কোডে লেখা থাকে। এই কোডে দুইটি মাত্র সংখ্যা থাকে, 0 এবং 1। এ দুটো বাইনারি সংখ্যার বিভিন্ন বিন্যাসে কম্পিউটারের অভ্যন্তরে যাবতীয় তথ্য আদান প্রদান হয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ডিএনএ অণুর ক্ষেত্রেও ATGC-কে এরকম বাইনারি কোডে প্রকাশ করা সম্ভব। যেমন ধরুন ,  A = 00, T = 11, G =10, C = 01, এ ধরনের বাইনারি কোডের উপর ভিত্তি করে যেকোনো ডিজিটাল ডেটাকে ডিএনএ’র ATGC কোডে রূপান্তরিত করা সম্ভব। তারপর সেই ডিএনএ কোডকে সংশ্লেষণ করে কৃত্রিম ডিএনএতে রূপান্তরিত করাও যাবে।

এইভাবে বিশাল কোনো ডিজিটাল ডেটা সেট, যেমন ধরুন কোন ছায়াছবি, উপন্যাস অথবা গানকে সংশ্লেষিত কৃত্রিম ডিএনএতে রূপান্তরিত করে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যাবে। তারপর কৃত্রিম ডিএনএর সিকোয়েন্সিং করলেই ওর ভিতরের যাবতীয় তথ্য উদ্ধার করাটাও সম্ভব হবে। এসব কৃত্রিম ডিএনএ অণুর কোটি কোটি কপি তৈরি করাও কোনো সমস্যা নয়।  

বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ইলেকট্রনিক হার্ডডিস্কের চেয়ে ডিএনএ’র তথ্যভান্ডার অনেক বেশি টেকসই হবে। লক্ষ-কোটি বছর ধরে প্রকৃতির তথ্য ভান্ডার হিসেবে ডিএনএ টিকে আছে। সেজন্যই প্রাচীন ফসিল থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন বিলুপ্ত জীব সম্বন্ধে নানান তথ্য উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন।  

বিজ্ঞানীরা আরও মনে করছেন, ডিএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিজিটাল ডেটা সন্নিবেশিত করলে অত্যন্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্থানের ভেতর বিপুল পরিমাণ তথ্য দীর্ঘ মেয়াদের জন্য সংরক্ষণ করা যাবে। এই প্রযুক্তি হবে বর্তমান যুগে প্রচলিত ম্যাগনেটিক টেপ বা যেকোনো ধরনের সলিড-স্টেট ডিভাইসের চেয়ে কয়েক লক্ষ গুণ ছোট।  

এই বিষয়টি নিয়ে গত এক দশক ধরে জোর গবেষণা চলছে। ২০১২ সালে, ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা সর্বপ্রথম ৭৩৯ কিলোবাইট ডিজিটাল ডেটাকে ডিএনএ ডেটায় রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিল সেক্সপিয়ারের সনেট এবং মার্টিন লুথার কিংয়ের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। এর চার বছর পর, ২০১৬ সালে মাইক্রোসফটের গবেষকরা আগের রেকর্ড ভঙ্গ করে, ২০০ মেগাবাইট ডিজিটাল ডেটাকে ডিএনএ ডেটায় রূপান্তরিত করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল, জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ এবং একটি মিউজিক ভিডিও।

এসব পরীক্ষামূলক ডিএনএ ডেটায় তথ্য সংরক্ষণের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি আমেরিকার বিজ্ঞানীরা ঘোষণা দিয়েছেন, তারা একটি নতুন ধরনের ডিএনএ মাইক্রোচিপ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন, এতে বর্তমানে প্রচলিত ডিএনএ ডাটা প্রযুক্তির চেয়ে একশ গুণ বেশি তথ্য তাঁরা ধারণ করতে পারবেন। অনেকেই মনে করেন, ডিএনএর ডেটা সংরক্ষণের ক্ষমতা এতই বেশি যে ভবিষ্যতে ইন্টারনেটের সকল তথ্য ডিএনএর ভেতর সংরক্ষণ করে একটি ছোট্ট বাক্সের মধ্যে রাখা যাবে।  

এখন প্রশ্ন হলো, সংরক্ষিত তথ্যকে ডিএনএর ভেতর থেকে উদ্ধার করে কীভাবে কাজে লাগানো যাবে? আগেই বলেছি, এর জন্য ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করতে হবে। এর মানে হলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ডিএনএ অণুর ভেতর ATGC বেসগুলো কিভাবে সাজানো আছে সেটা বের করা। এটা করা এক সময় খুব কঠিন এবং ব্যয়সাধ্য কাজ ছিল। এখন স্বয়ংক্রিয় ডিএনএ সিকোয়েন্সিং মেশিনের সাহায্যে এটা সহজেই করা যায়।

আজকাল অত্যাধুনিক হাই থ্রুপুট সিকোয়েন্সিং মেশিনে আগের চেয়ে অনেক দ্রুত জিনোম সিকোয়েন্স করা যায়। তবে এটি তথ্য প্রযুক্তির জন্য এখনো উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। তথ্য প্রযুক্তির জন্য দরকার হবে অতি দ্রুত সিকোয়েন্সিং, যেটা সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে ডিএনএর তথ্য পাঠোদ্ধার করে দেবে। এজন্য হয়তো আরো কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হতে পারে।

তবে মনে রাখতে হবে, ডিএনএ ডেটা সংরক্ষণের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর বিশাল ধারণক্ষমতা এবং দীর্ঘকাল টিকে থাকার সক্ষমতা। এজন্যই তথ্যপ্রযুক্তি এবং জীবপ্রযুক্তির গবেষকেরা ডিএনএ ডেটা সংরক্ষণের সম্ভাবনা নিয়ে জোর গবেষণা করছেন।

বিডিপ্রতিদিন/কবিরুল

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর