বুধবার, ১৭ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

তিনি মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন

জাফর ওয়াজেদ

তিনি মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন

তিনি ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতা ও মুক্তির। সে ডাকে সাড়া দিয়েছিল বাঙালি। বীরের মতো লড়াই করে স্বাধীন ভূখন্ড অর্জন করেছে তারা। বিশ্বমানচিত্রে সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মুক্তির পথ তিনি দেখিয়েছেন, কিন্তু সে পথ পরিক্রমাকালে ঘাতকের কালো হাত কেড়ে নেয় জীবন। স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হতে থাকে। যে বজ্রকণ্ঠ কোটি কোটি বাঙালিকে উদ্দীপ্ত করেছিল, আন্দোলিত করেছিল, সেই মহামানবকে আততায়ীরা হত্যা করেছে নৃশংসভাবে সপরিবারে। স্বাধীনতা-পরবর্তী মুক্তির সংগ্রামের চাকাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য ঘাতকরা সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের সমাজে বাঙালির মনে এবং ইতিহাসে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির দাপট পরিলক্ষিত হয় তার হত্যাযজ্ঞের পর। কিন্তু অজস্র দুর্গতিতেও বাঙালি স্বাধীনতাকে আঁকড়ে থাকে। এটা বাস্তবিক যে, স্বাধীনতার অভিশাপ কিন্তু স্বীকার্য। অধীনতার আতঙ্কও অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের সমাজ গঠনে, বাংলাদেশের ইতিহাসে, বাংলাদেশের মনে এমন বিশেষ দুর্লঙ্ঘ বাধা রয়েছে, যার ফলে যে স্বাধীনতাকে জেগেছিল, সেই স্বাধীনতা মরীচিকায় পরিণত হলো পঁচাত্তর পরবর্তীকালে। সেই মরীচিকা যখন সরানোর কাজ চলে, তখন প্রতিবন্ধকতার বাহুগুলো আঁকড়ে ধরতে চায় কণ্ঠ। স্তব্ধ করে দিতে চায় স্বাধীনতা শব্দটিকে- এ রকম অবস্থা পাড়ি দিতে হয় আজও বাংলাদেশেকে। ইতিহাস বলে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের স্বাধীনতা-সংগ্রাম বাঙালিরই মাত্র নয়, সমগ্র মানবসমাজের ইতিহাসেই এক অবিনাশী গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আর এ যুগের এক মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটা তো সঠিক এবং সত্য যে, সমকাল যে মূল্যই দিক না কেন, ক্ষণকাল ভুলিয়ে দেওয়ার যত চেষ্টাই করুক না কেন, আজকের বাঙালি সত্তার এই সার সত্যকে চেপে রাখা যায়নি, যাবেও না ভাবীকালে। যত দিন যায়, ততই বঙ্গবন্ধু প্রজ্বলিত হয়ে ওঠেন ইতিহাসের প্রতিটি পাতায়, বাঙালি জাতির আত্মমর্যাদাপূর্ণ হওয়ার প্রতিটি মুহূর্তে। এখনো যেমন, ভাবীকাল থেকে কালান্তরে প্রেরণা জোগাতে থাকবেন তিনি, শোষণহীন কল্যাণময় সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ গড়ার প্রত্যয় ও অঙ্গীকারকে। সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন তার শুধু স্বপ্নই ছিল না। নিজেকেও তৈরি করেছিলেন সেই স্বপ্নপূরণের হাল ধরার জন্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ‘ভাগ্যবিধাতা হিসেবে তিনি মূল্যায়িত হয়েছেন একাত্তর সালে। তাই স্বাধীনতার পুণ্যলগ্নে একাত্তরে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক প্রফেসর মাহমুদ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘উপমহাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসেও এমনটি আর আসেনি খুব কম দেশেই আসে। যেন এক অলৌকিক ঘটনা। তাক লাগিয়ে দিয়েছেন শেখ মুজিব।’ সত্যিই অসাধ্য সাধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। অসাধারণ মহিমায় জেগে উঠেছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। কিন্তু এই জেগে ওঠা ছিল না ফানুসের মতো। কিন্তু ফানুসেই যেন পরিণত হয়েছিল স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায়। পরাজিত শত্রুরা থেমে ছিল না। তার সঙ্গে যোগ দেয় এ দেশের নরাধমরা। যারা সদ্য জেগে ওঠা স্বাধীন ভূখ- পাওয়া বাঙালি জাতির মুক্তির পথ স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল তারা। বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছিল। তাই দেখা যায়, সামরিক জান্তাশাসক ১৯৭৭ সালে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনকালে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে উল্লিখিত জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু শব্দদ্বয় ব্যবহার করতে দেয়নি। ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি মেনে না নেওয়ার মতো স্পর্ধা দেখিয়েছে জান্তাশাসক, যিনি আবার বঙ্গবন্ধুর ডাকে ও পরিস্থিতির চাপে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি ঘাতক এবং পরাজিত শক্তির কাছে সম্ভবত ভূমিকম্পসম ছিল বলেই তারা ভীতসন্তস্ত্র হয়ে পড়েছিল। ‘শেখ মুজিব’ নামটি উচ্চারণ করতে সাহস পায়নি। ক্ষমতা দখলকারী জান্তারা। তারা বুঝত যে, বঙ্গবন্ধুর অবদান যে এ দেশে ভাবীকালের মানুষের জন্য বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ অবদান। কিন্তু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। তাই বঙ্গবন্ধুর নাম ভুলিয়ে দেওয়ার নানা ষড়যন্ত্র, ঘুঁটি চালাচালির ইতিহাস বিকৃত করার কাজটিতে প-শ্রম করেছে।’ এ দেশের মানুষ তো জানেই বঙ্গবন্ধুর সময়কাল থেকে যে, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্থির লক্ষ্য সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়েছেন। নিজ জনগণকে সংগঠিত করেছেন। কোথাও মাথানত করেননি, আপস দূরে থাক। জেল, জুলুম, হুলিয়া, অত্যাচার ইত্যাদি কোনো কিছুতেই ভীত হননি; অথচ তাকে অস্বীকার করার প্রাণপণ চেষ্টা আজও অব্যাহত। স্মৃতি মুছে ফেলার চেষ্টা থেমে নেই। মৃত বঙ্গবন্ধু জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে কম শক্তিশালী নন, এ কথাটা সাময়িক জান্তা-শাসকরা বুঝতে পেরেছিল। শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাত করতে চেয়েছিল যারা, তারা স্বাধীনতার চার দশক পর উপলব্ধি করতে পেরেছে, মুজিবকে অস্বীকার করার অর্থ কার্যত তাদের নিজেদেরই অস্বীকার করা। নিজেদের অস্তিত্ব যখন তারা হারাতে বসেছে মুজিব বিরোধিতার চৌহদ্দিতে। তখনই উপলব্ধি করেছে মুজিব ছাড়া তাদের কোনো ইতিহাস নেই। তাই আজ তারা মুজিব বন্দনা শুধু নয়, সঠিক ইতিহাসেরও সন্ধান করছেন, এতকাল পরে এসে তারা এমনটাও উপলব্ধি করছেন, বঙ্গবন্ধু তো শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি নন, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে ধারার উন্মেষ ঘটিয়েছেন; সে ধারাকে অস্বীকার করে তারা নিজেরা যেমন, তেমনি বাঙালির অগ্রযাত্রার ধারা সূচনা সম্ভব নয়, বস্তুত বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করার অর্থ কার্যত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধারাকে অস্বীকার করারই নামান্তর। ‘বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার বিকল্পে অন্য কারও          ভূমিকা প্রতিস্থাপন করা অত্যন্ত হাস্যকর’।

জাতি হিসেবে বাঙালির জানা যে, এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-যুবা শেখ মুজিবের পেছনে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামে এগিয়ে গিয়েছিল। শিক্ষিত সমাজের একটা অংশ, যাদের ‘নাকউঁচা’ ভাব তারা শেখ মুজিবের নেতৃত্বের বিরোধিতায় সক্রিয় ছিল। এদের অনেকে স্বাধীনতা চেয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীনতা চায়নি। যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তাদের মুজিববিরোধিতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একাত্তরের পরাজিতরা সাহস ও শক্তি সঞ্চয়ে সহায়তা করেছে। মুজিব বিরোধিতার নামে তারা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকারই করে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি একটি স্বাধীন দেশ ও একটি পতাকাই লাভ করেনি; লাভ করেছিল একটি মূল্যবোধ। যা সন্নিবেশিত হয়েছিল সংবিধানে চার মূলনীতি হিসেবে। সেই মূলনীতিগুলো জান্তাশাসকরা পদদলিত করেছে এসবই করা হয়েছিল পরাজিত শক্তির স্বার্থরক্ষায়। এদের কারণেই মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে সব শ্রেণির দেশবাসীর স্বার্থে জাতীয় বিকাশের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, নানা কারণেই তা এগুতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যা সে প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে বিঘিœত হয়েছে। এমনকি নানা ধরনের বিকৃতি দেখা দেয় সমগ্র প্রক্রিয়ায়।

পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে বঙ্গবন্ধু-হত্যা তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হত্যার বিচার চেয়েছিল ছাত্র প্রতিনিধিরা। কর্তৃপক্ষ সে সময় বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে পারেননি সামরিক জান্তার ভয়ে ভীত হয়ে।

স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবের সংগ্রাম ছিল মুক্তির জন্য। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম নিয়ে কোনো গবেষণাধর্মী কাজ হয় না। এমনকি তাঁর সৃষ্ট দলটি ধারাবাহিক তৃতীয় দফা ক্ষমতায় থাকলেও বঙ্গবন্ধুর মাহাত্ম্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে কী যেন এক কার্পণ্যবোধ করে। শেখ মুজিবকে চাপা দিয়ে রাখার সব আয়োজন ব্যর্থ হোক। মুক্ত হন তিনি জনগণের কাছে।

 

লেখক : মহাপরিচালক

প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর