রবিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ : সমস্যা ও সম্ভাবনা

জাপানের আবাসন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্রিড গ্রুপ নিজ দেশের বাইরে বেশ কয়েকটি দেশে বিনিয়োগ করে আসছে। বাংলাদেশেও বসুন্ধরা গ্রুপ ও জেমস গ্রুপের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগ করছে। কিন্তু আইনি মারপ্যাঁচ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় এখানে বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে পারছে না। এ নিয়ে গত শুক্রবার ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ কার্যালয়ে জাপানি প্রতিষ্ঠানটি তাদের নানা সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে।

বিনিয়োগ আনতে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছি

ইকবাল হোসেন চৌধুরী

চেয়ারম্যান, জেমস গ্রুপ

২০০৮ সাল থেকে আমরা রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় আছি। আমাদের প্রথম পছন্দ বসুন্ধরা। পাশাপাশি ২০১৪ সাল থেকে আমরা ক্রিড গ্রুপের মতো আরও কয়েকটি জাপানি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা করছি। কিন্তু রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চাইলে প্রথমেই তাকে এ দেশে একটি ‘প্রপোজড অ্যাকাউন্ট’ খুলতে হয়। কিন্তু অনেক ব্যাংকের শাখা ম্যানেজাররাই এ ধরনের অ্যাকাউন্ট খোলার সঙ্গে অভ্যস্ত নন। বিদেশি মুদ্রা টাকায় রূপান্তর করতে গিয়েও আমাদের অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে। বিনিয়োগ বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক, জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে বিনিয়োগকারীদের অনেক ঘুরতে হয়। সরকারের উচিত এ ক্ষেত্রে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারের মাধ্যমে সব কটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করা। বিদেশের চেয়ে এ দেশে ব্যাংকের সুদের হার অনেক বেশি। যা বিদেশে ১-২ শতাংশের মতো। এ ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে ঋণ আনার সুযোগ দেওয়া উচিত। অন্তত রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিদেশি ঋণের অনুমোদন চায় জাপানি এই ব্যবসায়ী গ্রুপটি। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সমস্যার আরেকটি দিক হলো আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে বিনিয়োগের পর  মুনাফার টাকা পাঁচ বছরের আগে নিজ দেশে নিয়ে যাওয়া যাবে না। এ নিয়মও পরিবর্তন করে পাঁচ বছরের বদলে অন্তত তিন বছর করার দাবি জানিয়েছেন জাপানি বিনিয়োগকারীরা।


 

বিনিয়োগে বসুন্ধরাই উত্তম জায়গা

 

মুনিওশি তোশিকো

প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ক্রিড গ্রুপ

দুই বছর আগে বাংলাদেশে এসেছি। আমার কাছে ঢাকা শহরকে বেশ ‘এক্সাইটিং’ মনে হয়েছে। কিন্তু এখানকার সবচেয়ে বড় সমস্যাই যানজট। আমরা প্রথমে মতিঝিল ও পান্থপথ গিয়েছিলাম। এরপর গুলশান, বারিধারায়ও ঘুরেছি। জায়গাগুলো বেশ ভালো, কিন্তু ব্যয়বহুল। সেই সঙ্গে যানজটে পরিপূর্ণ। আবার বিমানবন্দর থেকে সেখানে যেতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে। শেষ পর্যন্ত আমরা বসুন্ধরায় এলাম। এটি বিমানবন্দরের কাছাকাছি। নিরাপত্তা আছে, অবকাঠামোও ভালো। তা ছাড়া পাশেই পূর্বাচল নামে সরকারের একটি প্রকল্প আছে। তার পাশে সেনা আবাসন প্রকল্প। সব দিক বিবেচনায় ঢাকা শহরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় বিনিয়োগ করাটাই উত্তম বলে মনে হয়েছে। সে কারণে আমরা প্রথমে খুব ছোট্ট একখণ্ড জমি কিনে পরীক্ষামূলক বিনিয়োগ করলাম। কিন্তু দেখলাম এ দেশে বিনিয়োগের জন্য বিদেশ থেকে অর্থ আনা খুবই কঠিন। সরকারি পলিসি অনুযায়ী আমরা কেবল নগদ টাকা বিনিয়োগ করতে পারব, ঋণ আনতে পারব না। তা ছাড়া টাকা ফেরত নেওয়া আরও কঠিন। যদি আমরা মুনাফার অর্থই নিজ দেশে ফেরত নিয়ে যেতে না পারি, তাহলে বড় ধরনের বিনিয়োগে কী লাভ। এ সমস্যার সমাধান হলে আমরা বড় ধরনের বিনিয়োগে প্রস্তুত আছি। তা ছাড়া আমরা বিদেশ থেকে ঋণ আনতে পারলে বড় বিনিয়োগ করতে পারব। সরকার অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করবে, সেটি সমস্যা নয়। আসলে, আমরা এ দেশে নতুন প্রযুক্তি, নকশা ও উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে আসতে চাই। এ ক্ষেত্রে নিয়ম-কানুনের কিছু পরিবর্তন আনলেই সব সম্ভব। তাতে আমাদের বাড়তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও সুবিধা হবে।


 

কাঙ্ক্ষিত হারে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না

তৌহিদুল ইসলাম

নির্বাহী পরিচালক, ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট (প্রা.) লিমিটেড

বর্তমানে আবাসন খাতের বাজারের অবস্থা ভালো নয়। এ খাতে বিনিয়োগ করতে গেলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করে। ফলে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হন। এ ক্ষেত্রে আয়কর আইনের ১৯-এর ‘খখ’ ধারাটি সংশোধন করতে হবে। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আবাসন খাত কেবল আবাসনেই সীমাবদ্ধ নয়। আবাসন খাতের সঙ্গে উৎপাদনশীল আরও ২৬৯টি সংযোগ শিল্প জড়িত।

আবাসন খাত চাঙ্গা না হলে ওই সব খাতের উন্নতি হবে না। তাই বিনিয়োগকারীদের নানা প্রশ্নে জর্জরিত না করে নির্বিঘ্নে বিনিয়োগ করার সুযোগ দেওয়া উচিত।

এতে মানুষের আবাসনের চাহিদা মিটবে। সংযোগ শিল্পগুলোতে কর্মচাঞ্চল্য পরিবেশ ফিরবে। বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হবে দেশজুড়ে। সারা পৃথিবীতেই বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা হয়। আমাদের দেশে কেবল মুখে মুখে বলা হচ্ছে, বিদেশি বিনিয়োগ আসুক। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগ আনার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে তা দূর করার দিকে কেউ দৃষ্টিপাত করছে না। এ কারণে কাঙ্ক্ষিত হারে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না।


 

বাংলাদেশের আবাসনে বাড়তি মাত্রাযোগ করতে চাই

হিসায়া সুজিয়ামা

স্থপতি ও পরিচালক, এআইএ জাপান

আমি যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত একজন স্থপতি। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশোনা করেছি। ক্রিড গ্রুপের সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমি খুবই আনন্দিত। প্রতিষ্ঠানটি এমন ধরনের ভবন নির্মাণ পছন্দ করে, যা মানুষের জীবনকে উন্নত করে এবং আনন্দ দেয়। বাংলাদেশেও আমরা নতুন ডিজাইন ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভবন নির্মাণ করতে চাই, যা এ দেশের আবাসন খাতে বাড়তি মাত্রা যোগ করবে। মানুষ হয়তো তা গ্রহণও করবে।

এ দেশে আমি দেখেছি নির্মাণের ধরনগুলো মোটামুটি একই রকম। নির্মাণশৈলীতে তেমন কোনো বৈচিত্র্য নেই। যেমন এ দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপকরণ হিসেবে ইট ব্যবহার করা হয়। এতে বাড়তি সৌন্দর্য আনার সুযোগ সীমিত। সময়ও বেশি লাগে, যা নির্মাতার জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশের শপিং সেন্টারগুলোও ক্রেতা-উপযোগী করে তোলার ক্ষেত্রে কিছুটা ঘাটতি আছে। এখানে অফিসের আয়তন ছোট। তার মধ্যেই নিজস্ব টয়লেট থাকে। তা সম্ভবত কর্মকর্তাদের জন্য। কেন এখানে সবার জন্য একটি কমন টয়লেট থাকে না, জানি না।


 

বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ চাই

মো. শাহাদত হোসেন

ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জেমস গ্রুপ

আমাদের দেশে বিনিয়োগের দ্বার উন্মুক্ত হলে আরও অনেক বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। শুধু জাপানই নয়, গোটা বিশ্ব থেকে বিনিয়োগ আসবে। আমরা উন্নতি করতে পারব, এখানে অনেকের চাকরির সুযোগ হবে।

আমরা চাচ্ছি বিনিয়োগ করার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করা হোক। সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করে বিদেশি বিনিয়োগের মূলধন মুনাফাসহ নিজ দেশে নিয়ে যাওয়ার সে ধরনের সুযোগ সরকারের তরফ থেকে করে দেওয়া হোক— এটাই আমাদের প্রত্যাশা।


 

বাংলাদেশে বিনিয়োগের বড় সম্ভাবনা আছে

মাসানোবু কামিয়ামা

বহির্বিশ্ববিষয়ক ব্যবস্থাপনা পরিচালক

ক্রিড গ্রুপ

জাপানের বাইরে পাঁচটি দেশে আমাদের বিনিয়োগ আছে ৩০ কোটি ডলার। বিদেশে এখন পর্যন্ত আমরা ১১ হাজার ইউনিট (অ্যাপার্টমেন্ট) তৈরি করেছি। বাংলাদেশে নির্মাণ করেছি ৪৯টি ইউনিট। এটি মোট বিনিয়োগের ৫ শতাংশও নয়। তবে বাংলাদেশে ব্যবসার বড় সম্ভাবনা আছে। কারণ এখানে জনসংখ্যার বড় অংশ উঠতি বয়সী। এ দেশের অর্থনীতিও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। এখানে আবাসনের বিরাট চাহিদা তৈরি হবে। বাংলাদেশে বিদ্যমান আবাসন কাঠামোর চেয়ে আমরা অনেক ভালোমানের আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারব বলে মনে করি। বিনিয়োগের খুব সামান্য অংশ এ দেশে আসার বড় কারণ বিদেশ থেকে ঋণ আনতে না পারা। একজন বিনিয়োগকারীর জন্য পুরো বিনিয়োগ মূলধন আকারে করা কঠিন। আমরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ তিন-চার গুণ বাড়াতে চাই। এ দেশে আমরা কমপক্ষে ১ হাজার অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করতে চাই। এ জন্য ঋণ আনতে দিতে হবে। সরকার যদি আমাদের শুধু মূলধন বিনিয়োগ করতে বলে, তাহলে আমরা বড় বিনিয়োগ করতে পারব না। বিদেশ থেকে একটি কোম্পানি মূলধন বা ঋণ, যা-ই নিয়ে আসুক— সবই বিদেশি বিনিয়োগ। এ সুবিধা শুধু আমাদের জন্য নয়, সব বিদেশি বিনিয়োগকারীর জন্যই চাচ্ছি। আমাদের এ সমস্যার কথা আমরা ঢাকায় জাপানি দূতাবাস কিংবা ঢাকায় জাপানি বিনিয়োগকারীদের প্লাটফরম ‘জাপানিজ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন ইন ঢাকা’কে জানাইনি। কারণ আমরা মনে করি, এটি বাংলাদেশ সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। আমরা সরকারের কাছেই প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার বিষয়ে সহযোগিতা চাচ্ছি।

সর্বশেষ খবর